২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী ও আলেম সমাজ অসাধারণ ত্যাগ ও সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাদের অবদান শুধু রাজপথের সংগ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মানবিক ও নৈতিক অবস্থান এই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ঢাকার যে কয়টি এলাকা অবিস্মরণীয় ত্যাগ, সাহস আর শাহাদাতের ক্ষেত্রে প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে, যাত্রাবাড়ী তার মধ্যে অন্যতম। জালিম শাসক হাসিনার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ীর এই গণবিস্ফোরণের ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্র-জনতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রেখেছেন ওই এলাকার কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
যাত্রাবাড়ীতে ‘সাধারণ আলেম সমাজ’-এর ব্যানারে আয়োজিত সংহতি সমাবেশে মাওলানা রিদওয়ান হাসানের নেতৃত্বে এই সমাবেশে মাওলানা মূসা আল-হাফিজ, মাওলানা আবদুল্লাহ আল-মাসউদ, মাওলানা উসামা সিরাজসহ অনেক আলেম জালেমের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। এই সমাবেশ থেকে মিছিল বের হয়, যা কাজলা থেকে কুতুবখালী খাল পার হয়ে এগিয়ে যায়। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তারা ‘গাশত কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন। ফারসি ‘গাশত’ (মার্চ) শব্দের মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশিত হয়। এই আন্দোলনে শতাধিক আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন। কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা মাওলানা শিহাব উদ্দীন জুমার নামাজের পর বাসার বারান্দায় ঘাতকের বুলেটে শহীদ হন। একইভাবে যাত্রাবাড়ীর আরেক তরুণ আলেম রোকন রাইয়ান রাস্তায় হাঁটার সময় বুলেটের আঘাতে প্রাণ হারান। এই ত্যাগের গল্পগুলো কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের অদম্য সাহস ও দেশপ্রেমের প্রতীক। ১২ বছর বয়সি মাদরাসা শিক্ষার্থী আরাফাতের শাহাদাত এই আন্দোলনে ত্যাগের আরেক হৃদয়বিদারক সাক্ষ্য হয়ে আছে। তার মতো অসংখ্য মাদরাসা শিক্ষার্থী তাদের প্রাণ দিয়ে দেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়কে সম্ভব করেছেন।
জুলাই বিপ্লবে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা শুধু রাজপথেই সক্রিয় ছিলেন না, তারা মানবিকতার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বারিধারার জামিয়া মাদানিয়া মাদরাসা আন্দোলনকারীদের জন্য তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল। মুফতি মনির হোসাইন কাসেমীর নির্দেশে মাদরাসার ছাত্ররা আন্দোলনকারীদের জন্য পানি, শরবত, স্যালাইন, বিস্কুট ও বিরিয়ানি বিতরণ করেন। মাদরাসার গেট সর্বদা উন্মুক্ত ছিল বিশ্রাম ও প্রয়োজনীয় সুবিধার জন্য। এমনকি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও রাস্তা পরিষ্কারের কাজেও তারা অংশ নিয়েছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ আহতদের চিকিৎসার জন্য পাঁচ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন এবং আরো পাঁচ কোটি টাকা পরে দেওয়ার কথা বলেন । এই মানবিক সহায়তা কওমি মাদরাসার সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
জুলাই আন্দোলনের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলেও কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা মন্দির পাহারা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এই কার্যক্রমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আপ্লুত হয়েছেন এবং এটি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাম্যের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।
কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা শুধু রাজপথেই নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। মাওলানা উসাইদ মুহাম্মদের আঁকা ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ গ্রাফিতি দেশব্যাপী সাড়া জাগিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি পুরোনো দেয়ালে এই ক্যালিগ্রাফি জুলাই বিপ্লবের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরামের আয়োজিত জুলাই কবিতা প্রতিযোগিতায় আলেম কবিরা তাদের স্বরচিত কবিতার মাধ্যমে বিপ্লবের স্মৃতি অমর করে রেখেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক