গাজা ইস্যু নিয়ে তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ ছিল। গত ডিসেম্বরে তুরস্কের সহায়তায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আর শাম (এইচটিএস) বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঘটানোর পর সিরিয়ায় নিজ নিজ অবস্থান সংহত করা নিয়ে তুরস্ক-ইসরাইল সম্পর্ক বর্তমানে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইসরাইল সিরিয়ায় অব্যাহতভাবে হামলা করে দেশটির সামরিক শক্তি ধ্বংস করার পাশাপাশি অনেক এলাকাও দখল করেছে। ইহুদি বর্ণবাদী এই দেশটি এখন সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সুয়েইদা প্রদেশকে সংখ্যালঘু দ্রুজদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র করার অপতৎপরতা শুরু করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে তুরস্ক সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কারণ তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তবর্তী সিরীয় এলাকায় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই তুরস্কে প্রবেশ করে হামলা করে আসছে। ফলে সিরিয়া ইস্যুতে ইসরাইলকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি নয় তুরস্ক। ফলে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে দুই দেশ। সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্কায় তুরস্ক সরকার এরই মধ্যে বেশকিছু প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। একইসঙ্গে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করে ইসরাইলকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।

হাকান ফিদান বলেছেন, আঙ্কারা কারো সঙ্গে সংঘাত চায় না, কিন্তু কারো শত্রুতা বা বৈরিতার মুখে পিছু হটবে না তুরস্ক, দৃঢ়তার সঙ্গে যেকোনো হুমকির পাল্টা জবাব দেবে। তুর্কি সংবাদমাধ্যম টিজিআরটিকে দেওয়া এক লাইভ সাক্ষাৎকারে তিনি এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এ সময় তিনি গাজা, সিরিয়াসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেন এবং ইসরাইলকে সম্প্রসারণবাদী রীতি অনুসরণের জন্য অভিযুক্ত করেন। ফিদান বলেন, ইসরাইল ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর নির্ধারিত সীমানা লঙ্ঘন করে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূখণ্ড দখল করছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এই সম্প্রসারণবাদী নীতি ‘হিটলারের পাগলামির’ সমতুল্য।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের সাম্প্রতিক ‘একবার তরবারি হাতে তুলে নিলে তখন আর কলম বা কথার কোনো প্রয়োজন থাকে না’ মন্তব্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে হাকান ফিদান বলেন, ‘তুরস্কের নিরাপত্তানীতি দেশের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। আমরা টার্গেটে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত কারো সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ি না। কিন্তু টার্গেটে পরিণত হলে আমরা কখনো পিছু হটি না।’

তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘অতীতে আমরা কঠিন সময় অতিবাহিত করেছি, এখনো কঠিন সময় পার করছি এবং আমাদের সামনে সম্ভবত কঠিন সময়ই অপেক্ষা করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না কারো বৈরিতা সরাসরি আমাদের দিকে আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সভ্যতা, রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কোনো কারণেই কোনো রাজনৈতিক সংগঠন, গ্রুপ বা ব্যক্তির সঙ্গে শত্রুতা করার জন্য সম্মতি দেয় না। কোনো রাষ্ট্র আমাদের হুমকি না দেওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের জন্য কোনো হুমকি নই। কিন্তু যখন কোনো রাষ্ট্র বা সংগঠন তুরস্কের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ এবং জনগণের শান্তি ও কল্যাণকে হুমকির মুখে ফেলবে, তখন আমরাও তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেব।’

হাকান ফিদান আরো বলেন, ‘আমাদের সীমান্তের বাইরে যখন কোনো হুমকি তৈরি হয়, তখন সেই হুমকি আমাদের ওপর আঘাত হানা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব না। তখন অবশ্যই আমরা আমাদের সীমান্তের বাইরে গিয়েই সেই হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমাদের বার্তাটি স্পষ্ট—তোমরা শত্রুতা না করলে আমরাও করব না।’

ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশটির আগ্রাসনের এই নীতি ফিলিস্তিনকে মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি ভূরাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে ইসরাইলকে থামানোর যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও তারা এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ ইসরাইলের এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের রক্ত বিশ্বের সব অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটানোর ভিত্তি তৈরি করবে।’

বিএনপি গড়বে জাতীয় ঐক্যের সরকারবিএনপি গড়বে জাতীয় ঐক্যের সরকার

তুরস্কের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য যুদ্ধ বা দুর্যোগের সময় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য প্রতি প্রদেশে আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরদোয়ানের সরকার। দেশটির মন্ত্রিসভা ৮১টি প্রদেশে আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে টেকসই প্রযুক্তি ও আধুনিক অবকাঠামোর আদলে তৈরি করা হবে, যাতে জরুরি অবস্থার সময় দ্রুত এগুলোয় আশ্রয় নেওয়া যায়। তুরস্কের স্থানীয় সম্প্রচার মাধ্যম এনটিভির খবর অনুযায়ী, রাজধানী আঙ্কারাসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী ও শহরে বাঙ্কারের নির্মাণকাজ শুরু করেছে সরকার। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি যুদ্ধ বিশেষ করে পারমাণবিক হামলার হুমকির ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী দেশ ইরানে গত জুন মাসে ইসরাইলের আকস্মিক হামলার পর তুরস্ক এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে।

এসব পদক্ষেপ ছাড়াও তুরস্ক তার অত্যাধুনিক ‘স্টিল ডোম’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মোতায়েন করেছে। ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমের মতোই বহুস্তরের এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন দেশটিকে ইসরাইলি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে সুরক্ষা প্রদান করবে। ভ্রাম্যমাণ এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুরস্কের প্রতিরক্ষাশিল্পের সক্ষমতাও প্রমাণ করছে। তুরস্কেও প্রতিরক্ষা শিল্প অত্যাধুনিক সামরিক ড্রোন নির্মাণ করে সারা বিশ্বেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি যুদ্ধে তুরস্কের ড্রোন ব্যাপক সফলতা অর্জনের পর এগুলোর চাহিদা এখন তুঙ্গে।

স্টিল ডোম নামের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জল-স্থল দুই অবস্থান থেকেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্ম ও রাডার সিস্টেমগুলোকে একক নেটওয়ার্কের মধ্যে একত্র করে এটি নিজেদের আকাশসীমায় শত্রুর অস্ত্র শনাক্ত করে সেগুলোকে প্রতিহত করতে সক্ষম।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান গত বুধবার রাজধানী আঙ্কারায় প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠান আসেলসানের নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘যে দেশ তার নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে না, তারা বর্তমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ভবিষ্যৎপানে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাকাতে পারবে না। আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে ৪৭টি যানবাহন-সমন্বিত স্টিল ডোম সিস্টেম প্রদান করেছি। অত্যাধুনিক এই সমরাস্ত্র আমাদের বন্ধুদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পাশাপাশি শত্রুদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে।’

এরদোয়ান বলেন, স্টিল ডোম বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে বিমান প্রতিরক্ষায় এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে তুরস্ক। মাঝারি পাল্লার তিনটি হিসার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে ২১টি অতিরিক্ত যানবাহন যুক্ত হওয়ায় দেশের মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ সক্ষমতা আরো শক্তিশালী হবে বলে। তিনি বলেন, তুরস্ক তার প্রতিরক্ষাশিল্পের প্রযুক্তি বন্ধুদেশ এবং মিত্রদের জন্যও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, আসেলসান স্টিল ডোম গড়ে তোলা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কমান্ড ও কন্ট্রোল সফটওয়্যারসহ, যেটি যুদ্ধের ময়দানে সব সিস্টেমকে সমন্বিত ও তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালনায় সক্ষম করবে। এতে করে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটি সিস্টেমের আওতায় কাজ করবে।

পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তির দেশ তুরস্ক। দেশটির সামরিক সক্ষমতা, ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং কৌশলগত মনোভাব তুরস্ককে এই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। অন্যদিকে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় সমরাস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তির দিক থেকে খুবই শক্তিশালী। দেশটির বিমানবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যাধুনিক। এই পরিস্থিতিতে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান এই দুই দেশের মধ্যে যেকোনো ধরনের সামরিক সংঘাত কেবল এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পুরো অঞ্চলকেই অগ্নিগর্ভ করে তুলবে।

ডেইলি সাবাহ থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

সূত্র, আমার দেশ