আকস্মিক অপার এক সম্ভাবনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি ও রপ্তানি বাণিজ্য থেকে শুরু করে সার্বভৌমত্ব সুসংহত করাসহ সার্বিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে বর্তমানে সম্ভাবনার এক সিংহদুয়ার খুলে গেছে। একসঙ্গে একটি দেশের জন্য এতগুলো উজ্জ্বল সম্ভাবনা ধরা দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। ইউক্রেন যুদ্ধ, চব্বিশের আগস্ট বিপ্লব এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব গ্রহণ ও শুল্কযুদ্ধের ঘটনা এক মোহনায় মিলে বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে আজ আবির্ভাব ঘটেছে এক নতুন ‍সূর্যের। বিশ্বের বুকে দ্রুত বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধিশালী আর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে বিপুল এই সম্ভাবনা ঢাকা কতটা কাজে লাগাতে পারছে তার ওপর।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের শুল্কযুদ্ধে ওলট-পালট হয়ে গেছে ঢাকা ঘিরে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন মহলের অনেক নীলনকশা। যেখানে কিছুদিন আগেও আশঙ্কা করা হয়েছিল পোশাক খাতে বড় ধরনের ধস নামার, সেখানে রাতারাতি তা বাংলাদেশের জন্য বড় মাত্রার আশীর্বাদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ছিল অনেকের চিন্তার বাইরে।

বাংলাদেশের সামনে যে অপার সম্ভাবনার আবির্ভাব ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে ভারতকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতির আকস্মিক পরিবর্তন। আর ভারতকে ঘিরে হোয়াইট হাউসের এ পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত আপত্তি ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি উপেক্ষা করে রাশিয়া ও চীনের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ভারতের অবস্থান এখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোরতর শত্রুশিবিরে। ভারত ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আকস্মিক এই ইউটার্ন বাংলাদেশের শুধু পোশাক খাতের জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের সব ষড়যন্ত্র নস্যাতেরও এক পরম সুযোগ এনে দিয়েছে। সাড়ে ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় যে সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার পেছনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক। চীনের বিরুদ্ধে ভারত ছিল এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের কৌশলগত বা প্রতিরক্ষা মিত্র। তাছাড়া ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বাণিজ্য মিত্র। সে কারণে বাংলাদেশ ইস্যুতে অতীতে যুক্তরাষ্ট্র নয়াদিল্লিকে খেপিয়ে ঢাকার পাশে দাঁড়ায়নি। আর এ সুযোগে ভারত শেখ হাসিনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি কলোনিতে পরিণত করে। বিষয়টি এমন পর্যায়ে গড়ায় যে, নয়াদিল্লি যেন ঢাকাকে ইজারা নিয়েছিল ওয়াশিংটনের কাছ থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বলতে কিছুই ছিল না। ঢাকার বিষয়ে ওয়াশিংটনসহ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নয়াদিল্লি যা বলত, যা বোঝাত, তারা সেটাই বুঝত এবং মেনে নিত। পশ্চিমাদের কাছে ঢাকার বিষয়ে দিল্লির কথাই ছিল শেষ কথা।

ঢাকার বিষয়ে নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটনের দীর্ঘকাল ধরে এক লাইনে অবস্থান বাংলাদেশের সামনে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সার্বিক ক্ষেত্রে। বর্তমানে নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন তিক্ততার ফলে দূর হয়েছে এই বাধা, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের বাড়তি পাওয়া।

চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশ অনেকটা মুক্ত হয়েছে ভারতের করাল গ্রাস থেকে। কিন্তু ভারত এখনো মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে আবার বাংলাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার এবং ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসনের। এ ক্ষেত্রে ভারত ও পতিত ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ উভয়ে প্রথমে তাকিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৪ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের দিকে। তাদের বিশ্বাস ছিল মোদির কথিত বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হলে ভারত আবার বাংলাদেশকে কব্জায় নেবে এবং ইউনূস সরকারের পতন ঘটিয়ে আবার আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। সেজন্য ভারতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের জন্য রীতিমতো পূজা-অর্চনার আয়োজন করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হলেন এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ও পলাতক আওয়ামী লীগ উল্লাসে ফেটে পড়ে। নড়েচড়ে বসে নয়াদিল্লি। তারা অপেক্ষায় থাকে ডেমোক্রেটঘনিষ্ঠ ইউনূস সরকারের পতনের। কিন্তু মোদির কথিত বন্ধু ট্রাম্প ও তার প্রশাসন এভাবে আকস্মিক ভারতের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এবং উল্টো তাতে বাংলাদেশের কপাল খুলে যাবে, তা কল্পনায়ও ছিল না ভারতের। ওয়াশিংটন এভাবে ভারতকে পরিত্যাগ করায় কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বরং গোটা বিশ্বে চরম ইমেজ সংকটের মুখোমুখি নয়াদিল্লি। দক্ষিণ এশিয়ায় মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারতের ষড়যন্ত্রনির্ভর আধিপত্যবাদী কূটনীতি। ছোট যেসব প্রতিবেশী দেশের ওপর ভারত দীর্ঘকাল ধরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা একে একে ধসে পড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের এখনো যে ষড়যন্ত্র চলমান রয়েছে, তা নস্যাৎ করতে বড় ধরনের সহায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ওয়াশিংটনের দিল্লিবিমুখতা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত এখনো বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। আওয়ামী লীগকে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের মাধ্যমে চলছে জোর তৎপরতা।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শিকার রাশিয়া-চীন-ভারত নতুন করে জোটবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চিরবৈরী চীন-ভারত সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে দুই দেশের তরফ থেকেই। ১৮ আগস্ট চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের পর চীন আবার ভারতে রেয়ার আর্থ, সারসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। ২০২০ সালে গালওয়ান ভ্যালি সংঘাতের পর এসব পণ্য চীন ভারতে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ২০২০ সালের পর দুই দেশে আবার শুরু হচ্ছে সরাসরি বিমান চলাচল। চীন-ভারত সম্পর্কোন্নয়নেরও একটা প্রভাব পড়তে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়, যদিও এ সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে শিক্ষা দিতে গিয়ে ভারত নিজের জন্য আরো বিপদ ডেকে আনবে। চীনের সঙ্গে নয়াদিল্লির এই সম্পর্কোন্নয়ন কখনো ভালোভাবে নেবে না ওয়াশিংটন। ওয়াশিংটন এ বিষয়কে ভালোভাবে না নিলে সেটা ঢাকার জন্য আরো ইতিবাচক।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের সামনে এখন সুযোগ এসেছে ভারতের খপ্পর থেকে বের হয়ে ওয়াশিংটনসহ গোটা বিশ্বের সঙ্গে সরাসরি দ্বিপক্ষীয় উপায়ে স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের। চীন, পাকিস্তান, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ বর্তমানে হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য। বাংলাদেশকে কৌশলগত কারণেই এসব দেশের সঙ্গে কেবল সম্পর্কোন্নয়ন নয় বরং প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব স্থাপন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন না করা এবং বাণিজ্যিকভাবে চীনের ওপর অধিক নির্ভরশীল না হওয়ার বিষয়ে ঢাকার ওপর ওয়াশিংটনের চাপের বিষয়টি সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে ওয়াশিংটনের চাপ মোকাবিলায় অনেক পয়েন্ট রয়েছে ঢাকার জন্য। যেমন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্ব থেকে যত পণ্য আমদানি করে তার ৩০ ভাগ আসে চীন থেকে। অথচ এই চীনই হলো দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। এই চীনকে মোকাবিলার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ভারতের পাশে ছিল এবং ভারতের কারণে ঢাকাকে গুরুত্ব দেয়নি। ফলে চীন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হতে পারে, তবে ঢাকা কেন চীন থেকে অধিক পণ্য আমদানি করতে পারবে না? এছাড়া ঢাকার সামনে আরেকটি ভালো উদাহরণ পাকিস্তান। সুইডেনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, পাকিস্তান গত পাঁচ বছরে যত অস্ত্র কিনেছে তার ৮০ ভাগই তারা কিনেছে চীন থেকে। পাকিস্তানে বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে চীন-পাকিস্তান যৌথ ১০০ বিলিয়ন ডলারের সিপিইসি প্রকল্প। চীন ও পাকিস্তান উভয়ের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগের ঘটনা। চীনের সঙ্গে এমন গভীর সম্পর্কে আবদ্ধ একটি দেশের সঙ্গে যদি ওয়াশিংটন নতুন করে সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্কোন্নয়ন মেনে নিতে পারবে না কেন ওয়াশিংটন? অবশ্য এটি পরিষ্কার যে, ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক সম্পর্কোন্নয়ন চেষ্টার মূলে রয়েছে পাকিস্তান—যাতে পুরোপুরি বেইজিংয়ের কবলে চলে না যায়, সেটা যতটা সম্ভব ঠেকানো যায়। কারণ ইসলামাবাদের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক যত গভীর হবে, এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্য ততই বৃদ্ধি পাবে।

ইসলামাবাদ যদি বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ না করত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও তার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেত না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ঢাকা যদি নিজেকে চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে গুটিয়ে রাখে, তাহলে একদিন ওয়াশিংটনের কাছেও তার কোনো গুরুত্ব থাকবে না, যেমন ছিল না নয়াদিল্লির কাছে। কাজেই বর্তমানে নয়াদিল্লি থেকে ওয়াশিংটন মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় দক্ষিণ এশিয়াসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশকে তার সার্বিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থে বহুমুখী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ভারতের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় স্বাধীন কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ কাজে লাগানো।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

সূত্র, আমার দেশ