বহু বছরের উত্তেজনার পর ভারত ও চীন আবার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই দিল্লিতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পাঁচ বছর পর প্রথমবারের মতো প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সরাসরি উড়োজাহাজ চলাচল ফের চালু করার প্রস্তুতি চলছে।
২০২০ সালে সীমান্ত সংঘাতে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা ও ৪ জন চীনা সেনা নিহত হওয়ার পর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (এস জয়শঙ্কর) সর্বশেষ বৈঠকটি ছিল মাত্র দ্বিতীয় বৈঠক।
ওয়াং ইর এই ‘ইতিবাচক’ বৈঠকগুলো সাত বছর পর মোদির চীন সফরের আগে একটা ভালো পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। এ মাসের শেষে চীন সফরে মোদি দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
ভারত–চীন সম্পর্কের পুনর্মিলনকে ট্রাম্পীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এর কারণ হলো ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে অস্থিরতা বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের আমদানির ওপর বিস্ময়করভাবে ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা চাপিয়েছেন, যেটি এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো অভিযোগ করেছেন, ভারত আসলে ‘বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার তেলের সংগ্রহ ও বিতরণের কেন্দ্র’ হিসেবে কাজ করছে। নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ভারত শোধন করে বিশ্বের নানা দেশে উচ্চ মূল্যে রপ্তানি করছে। এর মাধ্যমে মস্কো তার অতি প্রয়োজনীয় ডলারের জোগান পাচ্ছে।
শীতল যুদ্ধের সময়কার হুমকির ভাষা পুনরাবৃত্ত করে নাভারো সতর্ক করে বলেন, ‘ভারত যদি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হতে চায়, তবে দেশটিকে ঠিকমতো আচরণ শুরু করতে হবে।’
এটা সত্যি যে ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অনেক বাড়িয়েছে। কিন্তু এর আগে বাইডেন প্রশাসনই দিল্লিকে বলেছিল বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার স্থিতিশীল রাখতে রাশিয়া থেকে তেল কিনতে।
কিন্তু ভারতে খুব কম লোকই আছেন যাঁরা চীন–ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন। অতীতে বহুবার সম্পর্ক ফের চালু করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থাকুক বা না থাকুক, ভারত চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে সতর্ক থাকবে। কারণ, দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের মৌলিক প্রকৃতি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং দিল্লি চায় এমন একটি প্রতিরোধ–কাঠামো গড়ে তুলতে, যাতে ২০২০ সালের মতো পরিস্থিতি আর সৃষ্টি না হয়।
কিন্তু ট্রাম্পের কাছে এই ধরনের যুক্তির কোনো মূল্য নেই। ট্রাম্প আশা করেছিলেন ভারত তার সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি একটি বাণিজ্যচুক্তি করবে, কিন্তু আলোচনার শর্তের ওপর দিল্লির কঠোর অবস্থানের কারণে সেই আশা পূরণ হয়নি। যে ব্যক্তি ইউক্রেনের চেয়ে প্রায়ই রাশিয়াকে বেশি প্রশংসা করেন তাঁর কাছে ভারতের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক বসানোর পেছনে এটাই সত্যিকারের যুক্তি।
যাহোক, ট্রাম্প যখন প্রকাশ্যেই একটি দেশ ও তার নেতৃত্বকে অপমান করেছেন, তখন যা–ই ঘটুক না কেন, ভারতের জনগণের মধ্যে ট্রাম্পের প্রতি মনোভাব তিক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বাণিজ্যের মতো কঠিন বিষয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ভারতীয় কর্মকর্তাদের চুক্তি করতে পারার সক্ষমতা আরও কমে আসছে।
শুধু তা–ই নয়, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত খুব সাবধানে যে ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিমালা তৈরি করেছিল, সেটাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে। কারণ, কোয়াড জোটের ভবিষ্যৎ (ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র এই জোট গড়ে তুলেছে) নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
ভারত–যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিভক্তি তাই বেইজিংয়ের জন্য এমন একটি সুযোগ হিসেবে এসেছে, যার জন্য দেশটি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করে ছিল। ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করার জন্য চীনের সামনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। সম্পর্ক পুনর্গঠন করার পাশাপাশি একসময় দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ভারত–মার্কিন অংশীদারত্বের তীক্ষ্ণ প্রভাব কমানোর সুযোগও চীনের সামনে তৈরি হয়েছে।
এরপরও ট্রাম্পের আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটাকে দেখা প্রাথমিকভাবে ভুল হবে। যদিও ট্রাম্পের পদক্ষেপ চীন–ভারতের সম্পৃক্ততাকে ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে খুব সতর্কভাবে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া চলছিল গত অক্টোবর মাস থেকে। সে সময় ভারত ও চীন বিতর্কিত হিমালয় সীমান্তে উত্তেজনা কমানোর উদ্দেশ্যে টহলব্যবস্থা নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছিল।
২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে দিল্লি বারবার দাবি করেছে যে সীমান্তের বর্তমান অবস্থান, বেইজিং নিজেদের পাশে তাঁবু ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করে একতরফাভাবে পরিবর্তন করেছে।
গত বছর চীন যখন সীমান্ত–সংক্রান্ত অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে সম্মত হলো, তখন সেটিকে একধরনের অপ্রকাশিত স্বীকারোক্তি হিসেবে ধরা হলো যে প্রকৃতপক্ষে সংকটের কারণ ছিল বেইজিংয়ের কর্মকাণ্ড। ফলে দিল্লি চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পদক্ষেপ নেয়।
এর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চীন এ বছর তিব্বত অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় তীর্থস্থানে যেতে ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের অনুমতি দিয়েছে। ভারত চীনা পর্যটকদের জন্য ভিসা সেবা আবার চালু করেছে। নির্দিষ্ট পাসের মাধ্যমে সীমান্ত বাণিজ্য ফের চালুর আলোচনা শুরু করার ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হয়েছে।
ওয়াং ইর সাম্প্রতিক সফরে দুই পক্ষ সীমান্ত নির্ধারণের জন্য নতুন বিশেষজ্ঞ ও কার্যনির্বাহী দল গঠনের সিদ্ধান্তও নিয়েছে। এর পাশাপাশি ভারতকে সার, বিরল খনিজ ও টানেল বোরিং মেশিন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে চীন। দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে এই আমদানিতে প্রভাব পড়েছিল।
কিন্তু ভারতে খুব কম লোকই আছেন যাঁরা চীন–ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন। অতীতে বহুবার সম্পর্ক ফের চালু করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থাকুক বা না থাকুক, ভারত চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে সতর্ক থাকবে। কারণ, দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের মৌলিক প্রকৃতি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং দিল্লি চায় এমন একটি প্রতিরোধ–কাঠামো গড়ে তুলতে, যাতে ২০২০ সালের মতো পরিস্থিতি আর সৃষ্টি না হয়।
এবারে ভারত–চীন সম্পর্ক আবার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের যদি কোনো ভূমিকা থেকে থাকে, সেটা একেবারেই প্রান্তিক।
হার্স ভি পান্থ ভারতের দিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি এবং কিংস কলেজ লন্ডনের ভিজিটিং অধ্যাপক
টাইম থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে