আজ আমাদের প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা মতবিরোধে নয়; বরং পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে পরমতসহিষ্ণুতা (Tolerance towards differing opinions) একটি মৌলিক ও অপরিহার্য মূল্যবোধ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে যে অশালীন স্লোগান ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের একটি উদ্বেগজনক চিত্র। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষার আসরে, যেখানে যুক্তি, জ্ঞান ও ভদ্রতাকে সর্বাধিক স্থান দেয়ার কথা, সেখানে অশ্রাব্য ও অপমানজনক স্লোগান উচ্চারণ শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে না; বরং প্রজন্মের জন্যও একটি ভুল উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।

অশালীন স্লোগানের ক্ষতিকর প্রভাব

ক. নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি– অশ্লীল ভাষা তরুণদের মধ্যে সহিংসতা ও বিদ্বেষকে উসকে দেয়।

page-top-ad

খ. শিক্ষা পরিবেশ ধ্বংস– শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার বদলে ভয় ও বিভাজনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

গ. রাজনীতির মান অবনতি– নীতি, আদর্শ ও যুক্তির জায়গা নেয় অপমান, গালিগালাজ ও ঘৃণা।

কোরআনের দৃষ্টিতে পরমতসহিষ্ণুতা

ইসলাম ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণকে গুরুত্ব দিয়েছে। কোরআনের নির্দেশ- ‘তোমরা মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ৮৩) এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, সকলের সাথে ভদ্র ও সুন্দর ভাষায় কথা বলা ঈমানদারের পরিচয়।

মতভেদের ক্ষেত্রে কোরআনের শিক্ষা

মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের প্রভুর পথে আহ্বান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশ দ্বারা, এবং তাদের সাথে এমনভাবে বিতর্ক কর যা সর্বোত্তম।’ (সূরা নাহল, আয়াত : ১২৫) এখানে যুক্তি, জ্ঞান ও নৈতিকতার মাধ্যমে মতবিনিময়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অপমান বা গালিগালাজের মাধ্যমে নয়।

হাদিসে সহিষ্ণুতার শিক্ষা

রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে বা চুপ থাকে।’ (বুখারি ও মুসলিম) এই হাদিস আমাদের শেখায় যে, ভিন্নমত বা প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষেত্রেও কেবল ভালো ও ভদ্র কথা বলা উচিত।

আরেক হাদিসে এসেছে- ‘মুমিনরা ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতিতে এক দেহের ন্যায়।’ (মুসলিম) অর্থাৎ, সমাজে এমন আচরণ করতে হবে, যা ঐক্য ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করে, বিভেদ ও ঘৃণা নয়।

ইতিহাসে সহিষ্ণুতার উদাহরণ

তায়েফবাসী যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিয়েছিল, তখন প্রতিশোধ না নিয়ে তিনি তাদের জন্য দোয়া করেছিলেন।

যুদ্ধে শত্রু যখন খলিফা হজরত আলী রা:–কে অপমান করা হয়েছিল, তখন ব্যক্তিগত রাগের কারণে তিনি আক্রমণ বন্ধ করেছিলেন, যাতে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা ইসলামী আদর্শকে ছাপিয়ে না যায়।

সমাধানের পথ

রাজনৈতিক শিক্ষায় নৈতিকতা সংযোজন– ছাত্র রাজনীতিতে শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও সংযমের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।

অশ্লীল স্লোগানের আইনগত দমন– শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অশালীন স্লোগান বা বক্তব্য দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।

বিতর্ক সংস্কৃতির প্রসার– যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিতে মতবিনিময়ের জন্য বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন।

ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা– কোরআন, হাদিস ও ইতিহাস থেকে সহিষ্ণুতা ও ভদ্রতার উদাহরণ তুলে ধরা।

নৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি— শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়, বরং নৈতিকতা, সহিষ্ণুতা ও নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নয়ন— দলীয় নেতাদের দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে কর্মীরা শালীনতা বজায় রাখে।

শিক্ষাঙ্গনে কঠোর নীতিমালা— অশালীন ভাষা ও আচরণের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

পরমত সহিষ্ণুতা রক্ষায় উক্তি

মহাত্মা গান্ধী: ‘অসহিষ্ণুতা নিজেই এক ধরনের সহিংসতা এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য একটি বাধা।’

ভলতেয়ার: ‘আমি তোমার মতের সাথে একমত নই, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রক্ষা করব।’

কোরআন: ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৫৬)

প্রবচন: ‘ভদ্রতা এমন এক ভাষা যা বধির শুনতে পায় আর অন্ধ দেখতে পায়।’

পরমতসহিষ্ণুতা : সভ্যতার ভিত্তি ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

সমাজে মতভেদ স্বাভাবিক বিষয়। মানুষের চিন্তা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যই মানব সভ্যতাকে বহুমাত্রিক করেছে। কিন্তু যখন এই মতভেদ পরিণত হয় ঘৃণা, অশালীনতা এবং বিদ্বেষে, তখন তা সমাজকে বিভক্ত করে এবং ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহসভাপতি পদের ছাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখে উচ্চারিত অশালীন স্লোগান এই সঙ্কটের একটি প্রতিফলন। এমন পরিস্থিতি কেবল ব্যক্তিগত মর্যাদাকে নয়; বরং গোটা শিক্ষাঙ্গনের সুনামকেও কলঙ্কিত করে।

ইসলামে পরমতসহিষ্ণুতা

ইসলাম এমন এক ধর্ম যা মতভেদকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে এবং ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণু আচরণকে নৈতিক কর্তব্য হিসেবে শিক্ষা দিয়েছে। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম।’ (সূরা কাফিরুন, আয়াত : ৬)

এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ভিন্ন ধর্ম বা মতের মানুষদের প্রতি জোর-জবরদস্তি করা নয়; বরং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই ইসলামের শিক্ষা। আরেক জায়গায় আল্লাহ বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ২৫৬) এখানে স্বাধীন মত প্রকাশ ও বিশ্বাসের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশনা রয়েছে।

হাদিসে সহিষ্ণুতার শিক্ষা

রাসুলুল্লাহ সা: ভিন্নমতের মানুষদের সাথে অত্যন্ত সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। এক বিখ্যাত হাদিসে এসেছে—‘যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ মুসলিম) এখানে প্রতিবেশী কেবল মুসলিমই নয়; বরং অমুসলিম, ভিন্নমতের অনুসারী—সবার ক্ষেত্রেই এই নির্দেশ প্রযোজ্য। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও শালীনতা বজায় রাখা অপরিহার্য।

আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যার আচরণ উত্তম।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) এই শিক্ষা রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রযোজ্য—মতভেদ থাকলেও ভাষা ও আচরণ হতে হবে মর্যাদাপূর্ণ।

পরমতসহিষ্ণুতা কেন জরুরি

সামাজিক শান্তি রক্ষা— সহিষ্ণুতা ছাড়া সমাজে বিরোধ, হিংসা ও বিশৃঙ্খলা বাড়ে।

শিক্ষাঙ্গনের মর্যাদা— শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে জ্ঞান ও যুক্তির স্থান, গালিগালাজের নয়।

ব্যক্তিগত উন্নতি— সহিষ্ণু মনোভাব ব্যক্তিকে পরিণত, প্রজ্ঞাবান ও মর্যাদাবান করে।

দার্শনিক ও ঐতিহাসিক উক্তি

মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘সহিষ্ণুতা কোনো দুর্বলতার চিহ্ন নয়; বরং এটি সবচেয়ে বড় শক্তি।’

ভলতেয়ার বলেছেন, ‘আমি তোমার কথার সাথে একমত নই, কিন্তু তোমার বলার অধিকারকে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রক্ষা করব।’

ইমাম শাফেয়ী রহ: বলেছেন, ‘আমার মতামত সঠিক হলেও তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে, আর তোমার মতামত ভুল হলেও তা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

এই উক্তিগুলো প্রমাণ করে যে ইতিহাসের মহান ব্যক্তিরা ভিন্নমতকে শত্রুতা নয়; বরং আলোচনা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছেন।

শিক্ষাঙ্গনে অশালীনতার প্রভাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যদি অশালীন স্লোগান উচ্চারিত হয়, তাহলে এর প্রভাব শিক্ষার্থী সমাজে ভয়াবহ হতে পারে। নতুন প্রজন্ম শালীন ভাষার গুরুত্ব হারাবে। মতভেদ মেটাতে যুক্তি নয়, বরং হিংসাত্মক ও অপমানজনক পদ্ধতির দিকে ঝুঁকবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘সদাচরণ ও পরহেজগারিতে একে অপরকে সাহায্য কর; পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরকে সাহায্য করো না।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত : ২)

রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা চায়, তা-ই তার ভাইয়ের জন্যও কামনা করে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) অতএব, মতভেদ থাকলেও আমাদের আচরণ হতে হবে এমন, যা আমাদের ঈমান, সংস্কৃতি ও মানবিকতার পরিচয় বহন করে।

উপসংহার

রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু সেই পার্থক্য প্রকাশের ভাষা ও ভঙ্গি হতে হবে সভ্য ও ভদ্র। অশালীন স্লোগান শুধু ব্যক্তিকে নয়, গোটা সমাজের মানসিকতা ও সংস্কৃতিকে কলুষিত করে। ইসলাম, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র—সবই আমাদের শেখায় যে, ভিন্নমতকে সম্মান জানানো, যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করা এবং ভাষায় সংযম প্রদর্শন করা একটি সভ্য সমাজের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।

আজ আমাদের প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা মতবিরোধে নয়; বরং পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

লেখক : প্রফেসর, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, রয়েল ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা।

সূত্র, নয়া দিগন্ত