ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসুর নির্বাচন হয়ে গেল, যেখানে শিবির-সমর্থিত প্যানেল ভূমিধস বিজয় পেয়েছে। শিবিরের বিজয়ের পেছনে বহু অনুঘটক বিভিন্নভাবে ভূমিকা পালন করেছে, তা আমরা বোঝার চেষ্টা করব এবং ছাত্ররাজনীতির রূপরেখা কেমন হবে, সেটিও খানিক বিশ্লেষণের প্রয়াস থাকবে আজকের আলোচনায়।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের সরকার গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে। সেই নির্বাচন নিয়েও বহু ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়; যদিও এ দেশের প্রতিটি নির্বাচন নিয়েই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে বিভিন্ন সময়; সেটা ভিন্ন আলাপ। নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রথম টার্মে তার প্রতিপক্ষ দলগুলোর ওপর একটা সীমিত লেভেলে নির্যাতন চালানো শুরু করে। কিন্তু ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগ মূলধারার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ অটোক্র্যাটিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে যদিও তারা মুখে গণতন্ত্রের কথাই বলতে থাকে। ডেমোক্রেসি থেকে অটোক্রেসিতে জাম্প করার জন্য তাদের প্রথম টার্ম ছিল প্রস্তুতি পর্ব যে সময়ে সরকারের বিভিন্ন অর্গানের সহযোগিতা নিয়েছে কিংবা সরকারের বিভিন্ন অর্গানকে তারা অটোক্রেসির জন্য প্রস্তুত করেছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের গুম-খুনের রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় এবং বিএনপি-জামায়াত-শিবির তাদের মূল টার্গেটে পরিণত হয়, যার ফলে আমরা সিলেটের ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা দেখতে পাই। ইলিয়াস আলীকে গুম করার মিশন সফল হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার গুমকে আরো বেশি প্রায়োরিটি দিতে থাকে এবং তারা সফলও হয় বটে। প্রায় ২০০০ মানুষকে তারা ২০১৪ সালের পর গুম করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র হতে থাকে, যেখানে মূল ভূমিকায় থাকে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির। স্বভাবতই বিএনপি-জামায়াত মূল টার্গেটে পরিণত হয়। এ সময় আন্দোলন দমনের নামে শতাধিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করে আওয়ামী সরকার। এরপরই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিবির মূলত আত্মগোপনে চলে যায় এবং সামনে আসে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর। অন্যান্য ক্যাম্পাসে কিছুটা রাজনীতি করার সুযোগ পেলেও তারা ঢাবি এবং জাবিতে এর আগে থেকেও প্রচার-প্রচারণায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বিভিন্ন রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে। এই দীর্ঘ সময় শিবির তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখেনি বলে তারা দাবি করেন। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে তাদের পদচারণা ছিল নামে-বেনামে। এমনকি ছাত্রলীগের সঙ্গেও তাদের ঘনিষ্ঠতা দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে, যেটাকে তারা তাদের ‘কৌশল’র অংশ হিসেবে দেখেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোয় ছাত্রদলের ভরাডুবির পেছনে ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে না পারা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ না পাওয়াকে দায়ী করছেন; বিষয়টি কতটা যৌক্তিক, সেটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক করার সুযোগ আছে। শিবিরের প্রতি নির্যাতনের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাদের প্রতি একটা সফট কর্নার ছিল, সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং তারা ক্যাম্পাসে নামে-বেনামে থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পেয়েছে, এটাও সত্য। কিন্তু এসবের পরও যেটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো ৫ আগস্টের পর প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়েছে, যেখানে সবগুলো ক্যাম্পাসে সবগুলো ছাত্র সংগঠনের সমান প্রবেশাধিকার ছিল। এক বছর কিন্তু রাজনীতির জন্য যথেষ্ট সময়।

এই এক বছর ছাত্রদল নিজেকে প্রস্তুত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, অগোছানো ছিল তাদের কার্যক্রম, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ছিল প্রকাশ্যে, পক্ষান্তরে শিবির বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে। বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের যথেষ্ট প্রচেষ্টা ছিল। এই ওয়েলফেয়ার রাজনীতি নিয়ে যদিও অনেক মহল থেকে পক্ষে-বিপক্ষে কথা আছে; কিন্তু শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে যে পজিটিভলি নিয়েছে, নির্বাচনে তাদের আচরণই সেটি বলে দিচ্ছে। পক্ষান্তরে দেশব্যাপী ছাত্রদলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রদলের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে, সেটিও ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সামান্য পরিমাণ প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়।

শিবিরের রাজনীতি ভালো কী খারাপ, সেটি ভিন্ন আলাপ। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা শিবিরকে ম্যান্ডেট দিয়েছে, এটাই বাস্তবতা। শিবির যেই ধরনের রাজনীতি করে, সেটি গতানুগতিক দলগুলোর জন্য একটু কঠিন, কারণ এই দলগুলোর এ ধরনের রাজনীতি করার অভ্যাস নেই। তাহলে?

যেহেতু শিক্ষার্থীরা ছাত্রশিবিরের রাজনৈতিক স্টাইল পছন্দ করেছে; সুতরাং তাদের ওয়েলফেয়ার স্টাইল রাজনীতিকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। ক্যাম্পাসে রাজনীতি করে টিকে থাকা খুব একটা কঠিন, যদি আমরা বাম সংগঠনগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে সেটি দেখতে পাব। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑশুধু টিকে থাকাই মূল কি না? আমার কাছে মনে হয় টিকে থাকার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে প্রভাব রেখে নির্বাচন করলে সেটি জেতাও সমানভাবে ইম্পর্ট্যান্ট। কারণ দিনশেষে বিজয়ীরা তাদের চিন্তার আলোকেই ক্যাম্পাসের রাজনীতির গতিধারা ঠিক করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

৫ আগস্টের পর রাজনীতিতে পরিবর্তন আশা করেছিল ক্যাম্পাসগুলো, ছাত্রদল সেই পরিবর্তনের সঙ্গে অ্যাডাপটেশন করতে পারেনি পরিপূর্ণভাবে, যদিও তাদের চিন্তাচেতনার মধ্যেও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষণীয় কিন্তু সেটি যথেষ্ট নয়। রাজনীতিতে অ্যাডাপটেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ টিকে থাকার জন্য কিংবা ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়ার জন্য। ছাত্রদলসহ অন্য সংগঠনগুলোকে অবশ্যই তাদের মৌলিক কার্যক্রমকে আবার রিভিউ করতে হবে এবং ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুনভাবে এজেন্ডা সেট করে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সামনে আসতে হবে। নিশ্চিতভাবেই শিক্ষার্থী গুণগত পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর জন্য সর্বদা প্রস্তুত।

লেখক : আহ্বায়ক, ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসি

সাবেক সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি

সূত্র, আমার দেশ