ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ একদিকে যেমন নতুন মোড় নিয়েছে, তেমনি এই আক্রমণকে কেন্দ্র করে বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে ইরান প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত অন্যান্য সামরিক ঘাঁটিতেও আক্রমণ চালানোর হুমকি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইরান হরমুজ প্রণালিও বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে, যা আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য দুঃস্বপ্ন বয়ে আনবে। কারণ এই পশ্চিমা সভ্যতার মূল শক্তি হচ্ছে জ্বালানি, যা সরবরাহ হয়ে থাকে এই প্রণালি দিয়ে। ফলে যুদ্ধ আরো বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং সেইসঙ্গে এতে জড়িয়ে পড়তে পারে শক্তিধর আরো অনেক দেশ। এমনকি এই যুদ্ধ আরো দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দুই সপ্তাহের সময় বেঁধে দেওয়ার পর মাত্র দুদিনের মাথায় ইরানে আক্রমণের ঘটনা বিশ্ববাসীকে হতভম্ব করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এটাকে প্রতারণামূলক আচরণ বলে অভিহিত করেছেন। আর এই আক্রমণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে যেমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তেমনি এই হামলা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সব আইনকানুন না মানার ইসরাইলি ঔদ্ধত্য ও অহংকারকে আরো উসকে দিয়েছে। এ ছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্প বিগত মার্কিন নির্বাচনের সময় বলেছিলেন, তিনি বিজয়ী হলে যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু ইরানে তার হামলার মধ্য দিয়ে তার ওই অঙ্গীকারের ব্যত্যয় ঘটেছে। তার চার বছর মেয়াদের এক বছরের অর্ধেক সময় পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনে ও গাজায় যুদ্ধ চলছে। শুধু তাই নয়, আরেকটি যুদ্ধ উসকে দেওয়ার জন্য ইরানে তিনি হামলা চালিয়েছেন।
তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যে পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে ইরানের ওপর ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র হামলা করেছে, তা নিছক একটি অজুহাত ছাড়া কিছুই নয়। কারণ পারমাণবিক বোমা না বানিয়েও তা নিক্ষেপ করতে ইরান সক্ষম। যে দেশটি হাইপারসনিক মিসাইল ও ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রযুক্তি অর্জন করেছে, সে দেশটির পক্ষে এদিক-সেদিক থেকে দু-একটা পারমাণবিক ওয়ারহেড জোগাড় করা অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। সুতরাং ওই দু-একটা ওয়ারহেড দিয়েই একটি দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা যায়। আর এটা যে আমেরিকা ও ইসরাইলের পারমাণবিক বিশেষজ্ঞরা জানেন না, তা নয়।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, ইরানে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রে হামলা পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য নয়, বরং এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে অপ্রতিরোধ্য ইসরাইলি সামরিক শক্তির প্রতি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে হতাশাগ্রস্ত দেশটির মনস্তাত্ত্বিক শক্তি বৃদ্ধি করা। আজ এ কথা স্বীকার করতে হবে, ইসরাইল বহু বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের যে মিথ সৃষ্টি করেছে, তাকে ইরান ধীরে ধীরে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বলা যায়, ইরান খুব কৌশলে অনেক বছর ধরে লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুতি মিলিশিয়া, গাজায় হামাস ও সিরিয়ায় অবস্থিত দু-একটি সশস্ত্র সংগঠনের মাধ্যমে ইসরাইলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করে আসছিল, যার মাধ্যমে কার্যত ইসরাইল দেশটির দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল নানাভাবে। ঠিক এ রকম একটা হতাশাজনক পটভূমিতে ইসরাইল ইরানে হামলা চালিয়েছে এবং তাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাঙা করার জন্য শামিল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের অধিবেশনে ইরানের প্রতিনিধির ওপর ইসরাইলি প্রতিনিধির হামলা সেই হতাশার চরম বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।
ইরানের অতীত ইতিহাস বলে, এত সহজে ইরানকে স্তব্ধ করা যাবে না; কারণ দেশটির রয়েছে তিন হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস ও সভ্যতা, যা অন্য কোনো দেশের নেই। চীনের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস থাকলেও লিখিত ইতিহাস পারস্যের মতো নয়।
যাহোক, আরো অতীতে না গিয়ে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম দেশগুলো কতবার কতভাবে ইরানকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছে, তার হিসাব নেই। দেশটির ওপর বারবার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক অবরোধ, নানাভাবে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে বাকি বিশ্ব থেকে। এমনকি পশ্চিমারা তৎকালীন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে লেলিয়ে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি একটি যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানকে পরিপূর্ণভাবে পর্যদুস্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস—আজ সাদ্দাম হোসেন ও তার সরকার বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্য দিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেই পশ্চিমাদের হাতেই। এমনকি সাম্প্রতিক কালে জনগণকে উসকিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বর্তমান ইসলামি সরকারকে পরিবর্তনের চেষ্টাও করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু ইরান শুধু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নেই; বরং সভ্যতার চমক দেখিয়ে যেকোনো শক্তিশালী শত্রুকে মোকাবিলা করার দৃঢ়তা প্রদর্শন করছে।
আন্তর্জাতিক বিষয়-সংক্রান্ত বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত ১৬ জুন ইরানের ফরদো, নাতানজ ও ইস্পাহানে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছেন, তা কেবল হাস্যকরই নয়, বরং পারস্য সভ্যতা সম্পর্কে অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। ট্রাম্প বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ‘সম্পূর্ণ ও পুরোপুরিভাবে নিশ্চিহ্ন’ হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পারস্যের এই প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে জানা থাকলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ ধরনের আক্রমণে যেমন যেতেন না, তেমনি সে রকম মন্তব্যও করতেন না। সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে তার হোয়াইট ভোটার ও ইসরাইলি উগ্রবাদী শাসকদের আশ্বস্ত করার জন্য ওই মন্তব্য করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মার্কিনিরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে এ রকম সামরিক হস্তক্ষেপ করে বিশ্ববাসীকে তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করে বিপর্যয়ের মুখেও পড়েছে বহুবার। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৫০ সালে কোরীয় উপদ্বীপে আক্রমণ চালিয়ে প্রাথমিক সাফল্যের পর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। সে সময় মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে কোরীয় উপদ্বীপে সফলভাবে অবতরণের পর হ্যারি ট্রুম্যানকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন, কোরীয় যুদ্ধ খুব স্বল্পমেয়াদি হবে এবং মার্কিন সৈন্যরা বড়দিনের মধ্যেই বাড়িতে ফিরে যাবে। ঠিক যেমন করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন, ইরানি নিউক্লিয়ার স্থাপনা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলি জেনারেল ম্যাকআর্থারের জন্য জন্য ছিল বিপর্যয়কর। তিনি জানতেন না, আগে থেকেই চীনা সৈন্যরা ইয়োলো নদী পার হয়ে ওত পেতে ছিল। মূল বিষয় হচ্ছে, জাতিসংঘ বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী জেনারেল ম্যাকআর্থার কোরীয় উপদ্বীপে নেমেই শুরুতে একটা বিশাল বিজয় পেয়েছিল, তাই প্রেসিডেন্টকে সেভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রবল পাল্টা আক্রমণে ম্যাকআর্থারের বাহিনী ভয়াবহ পরাজয়ের মধ্যে পড়ে যায়। ব্যাপক হতাহতের ঘটনায় মার্কিন প্রশাসন স্তম্ভিত হয়ে যায়। ফলে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান যুদ্ধ চলাকালেই ম্যাক আর্থারকে তার কমান্ড থেকে অপসারণ করেন।
ঠিক সেভাবেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কতটা ধ্বংস হয়েছে, কিংবা আদৌ পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষতি হয়েছে কি না, তা জানার আগেই বিজয়ের ডঙ্কা বাজিয়েছেন। অতীতে অনেকবার বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের অভিযানে প্রাথমিকভাবে সাফল্য পেলেও পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মার্কিন হস্তক্ষেপ মানে সবকিছু থেমে যাওয়া—এ ধারণা বারবার মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও দেশটি সব আন্তর্জাতিক আইনকানুন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালিয়ে আসছে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেনে বেশ কয়েক দফা মার্কিন আক্রমণ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মার্কিন প্রশাসন ভেবেছিল, ইয়েমেনে কয়েক দফা আন্দোলন চালালেই হুতি মিলিশিয়া থেমে যাবে; কিন্তু তা হয়নি, বরং হুতিরা পাল্টা মার্কিন নৌবহরে হামলা চালিয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯২-৯৩ সালে সোমালিয়ায় ‘অপারেশন রেস্টোর হোপে’ মার্কিন সৈনিকরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল। ব্যাপক হতাহতের ঘটনার পর শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এখানেও দেখা যাচ্ছে, প্রথম দিকে মার্কিন বাহিনী ত্রাণ বিতরণে যথেষ্ট সফল হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে গৃহযুদ্ধরত সোমালিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার পর মার্কিন বাহিনী প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তখন বিভিন্ন উপদলের মধ্যে যুদ্ধ চললেও মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের পর সেখানকার জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা এখন ইরানে দেখা যাচ্ছে। যাহোক, ওই সময় জেনারেল আইদি বাহিনীর ভয়াবহ হামলায় মার্কিন বাহিনী ব্যাপকভাবে হতাহত ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর মার্কিন বাহিনীতে এত ব্যাপক হতাহতের ঘটনা মার্কিন প্রশাসনকে বিচলিত করেছিল। তাই ঠিক এবার ইরানে হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্য প্রাথমিক একটা সাফল্যের ইঙ্গিত বহন করে বটে; কিন্তু এই হামলার ফলে বিশ্বের অনেক শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রকাশ্যেই ইরানের পক্ষ নিয়েছে; যেমন রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি অনেক দেশ। অতীতে এ রকম ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। এখন দেখা যাচ্ছে, বহু বছর ধরে ইরানকে নিঃসঙ্গ করার মার্কিন প্রচেষ্টা কেবল ব্যর্থই হয়নি, বরং ইরান বিশ্বের বুকে শক্তিশালী একটি দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
লেখক: গবেষক