বাংলাদেশের ইতিহাস যেন এক চক্রাকার পথে ঘোরে-ফেরে, যেখানে কিছু তারিখ নিছকই স্মৃতির স্মারক নয়, বরং তা জাতির গভীর ক্ষতচিহ্ন। ২৮ অক্টোবর, ২০০৬; ৯ ডিসেম্বর, ২০১২ (বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড); ৭ অক্টোবর, ২০১৯ (আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড); এবং সর্বশেষ গতকাল ১১ জুলাই, ২০২৫ (ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ড)—এই প্রতিটি তারিখ যেন এক ধারাবাহিক বর্বরতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর সম্মিলিত নীরবতার এক ভয়ংকর গাথা। আরো ভয়ংকরভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে এমন এক সময়, যখন মাত্র কয়েক মাস আগেই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান দেশ থেকে এক ফ্যাসিস্ট খুনিকে উৎখাত করে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নের সঙ্গে বর্তমানের নির্মম বাস্তবতার সংঘাত যেন আরো বেশি হতাশাজনক।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার রাজপথে আমরা যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তা ছিল সভ্যতার মুখে এক তীব্র চপেটাঘাত। প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে তৎকালীন আওয়ামী হায়েনারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। সেদিন টিভি ক্যামেরার সামনেই লগি-বৈঠার তাণ্ডবে প্রাণ যায় অন্তত পাঁচজনের। সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্য ছিল যখন আওয়ামী হায়েনাদের কতিপয় উন্মত্ত কর্মী নিহতদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করছিল, বিজয়ীর বেশে নৃত্য করছিল। এই ঘটনা প্রমাণ করেছিল, আমাদের সমাজে হিংসা আর প্রতিহিংসার বিষ কত গভীরে প্রোথিত এবং কীভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষকে অমানবিক করে তুলতে পারে। এই হত্যাকাণ্ডের পর বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি শুরু হলো, তা যেন পরবর্তী সব অপরাধীদের জন্য এক অলিখিত লাইসেন্স হয়ে দাঁড়াল। সেই দিনের সেই উল্লাস যেন পরবর্তী সব অপরাধীর জন্য এক অশুভ অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছে।
এরপর মাত্র ছয় বছর পর ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বরে ঢাকার শাঁখারিবাজারের কাছে আবারও আমরা সভ্যতার আরেক চরম অবক্ষয় দেখলাম। প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের চোখের সামনে বিশ্বজিৎ দাস নামের একজন নিরীহ দর্জিকে শিবির সন্দেহে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন কর্মী (সন্ত্রাসী) বিশ্বজিৎকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে একের পর এক কোপাতে থাকে। এই হত্যার সময়ও আশপাশে অসংখ্য মানুষ উপস্থিত ছিল, কিন্তু কেউই বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। এই ঘটনা প্রমাণ করেছিল, বিচারহীনতার সংস্কৃতি কীভাবে সাধারণ মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয় এবং মানবিকতাকে বিলুপ্ত করে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অনেককেই চিহ্নিত করা গেলেও তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং পরবর্তী সময়ে অনেকের খালাস হয়ে যাওয়া বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আরো পাকাপোক্ত করে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ও পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতিইরানের পরমাণু কর্মসূচি ও পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি
এর দীর্ঘ সাত বছর পর ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড আমাদের বিবেককে আবারও তীব্রভাবে ঝাঁকুনি দিল। কক্ষের ভেতর একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো কেবল ভিন্নমত পোষণের অপরাধে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী (সন্ত্রাসী)। এটি শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতার অপব্যবহার, টর্চার সেলের সংস্কৃতি এবং বিচারহীনতার ভয়ংকর চিত্র উন্মোচন করে। দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ হলেও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বহু প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। আবরারের নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে সেদিনও যে নির্লিপ্ততা দেখা গিয়েছিল, তা যেন আজকের সর্বব্যাপী নীরবতারই পূর্বাভাস ছিল।
সর্বশেষ ২০২৫ সালের ১১ জুলাইয়ের ভয়াবহ ঘটনাটি। পুরান ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় একজন ব্যবসায়ী মো. সোহাগকে (৩৯) পিটিয়ে এবং মাথার ওপর থেকে উপর্যুপরি ভারী পাথর মেরে শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম কায়দায় নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হলো, যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং চাঁদা দাবির বিষয়টি জড়িত। পুলিশ এজাহারনামীয় দুই আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১) ও তারেক রহমান রবিনসহ (২২) চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের মধ্যে মহিন চকবাজার থানা যুবদলের নেতা বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজগুলো দেখলে গা শিউরে ওঠে। শত শত পথচারীর সামনে দিবালোকে একদল ঘাতক একজন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করছে, আর তারপর উল্লাস করছে। কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয়টি হলো, এই বর্বরতা চলার সময় উপস্থিত অসংখ্য মানুষ ছিল নীরব দর্শক—কেউ এগিয়ে আসেনি, কেউ প্রতিবাদ করেনি, একটি ফোন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি। এই নিস্তব্ধতা আসলে ভয় থেকে সৃষ্ট এক অসহনীয় পরিবেশে মানুষের অসহায়ত্বের প্রতীক। এই নীরবতা যেন ২৮ অক্টোবরের লাশের ওপর নৃত্যেরই এক প্রতিধ্বনি। তখন উল্লাসকারীরা ছিল প্রকাশ্যে, আজ তারা মিশে গেছে নীরব দর্শকদের ভিড়ে।
এই ঘটনাগুলো যখন ঘটছে, তখন আমাদের স্মরণে আসে মাত্র কয়েক মাস আগের ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের কথা। সেই সময়ে ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ একযোগে একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল। তারা চেয়েছিল একটি শোষণমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থাকবে না। দীর্ঘ ১৫ বছরের একছত্র শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং আকাঙ্ক্ষা সেদিন রাজপথে নেমে এসেছিল। রক্তক্ষয়ী সেই আন্দোলনে বহু প্রাণের বিনিময়ে মানুষ ক্ষমতা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছিল। সেই অভ্যুত্থানের মূলমন্ত্র ছিল বৈষম্যহীনতা, ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।
কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের কয়েক মাস পরই যখন আমরা বিশ্বজিৎ ও আবরারের মতো হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হিসেবে ১১ জুলাইয়ের ঘটনা দেখি, তখন প্রশ্ন জাগে—সেই গণঅভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষা কি তাহলে অধরাই রয়ে গেল? দেশের পরবর্তী সার্বিক পরিস্থিতি কি সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই গণদাবির প্রতি কতটা সংবেদনশীল? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছিল ছাত্র-জনতা, তা কি শুধু একটি ইউটোপিয়া? যখন প্রকাশ্য দিবালোকে একজন ব্যবসায়ীকে পাথর মেরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং জনতা নীরব থাকে, তখন আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের সমাজে এতটাই জেঁকে বসেছে যে, তা একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অতীতে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের বিচার বিলম্বিত হওয়া বা অপরাধীদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দায়মুক্তি পাওয়ার প্রবণতা মানুষকে হতাশ করেছে। যখন অপরাধীরা দেখে যে তারা কোনো শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছে না, তখন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতা আমাদের সমাজকে এক গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থান সরকার পতনের পথ তৈরি করলেও বিচারহীনতা ও নৈতিক অবক্ষয় দূর করতে হলে প্রয়োজন গভীর ও কাঠামোগত সংস্কার। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এখনো অস্থিরতা বিদ্যমান। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো প্রকট। এই পরিস্থিতিতে ১১ জুলাইয়ের ঘটনা যেন এক অশনি সংকেত। এটি মনে করিয়ে দেয়, শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ, বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ের সংস্কার এবং সর্বোপরি মানুষের মধ্যে মানবিকতার পুনরুদ্ধার।
যদি আমরা এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি, যদি আমাদের সমাজ এই নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা থাকে, তাহলে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সব অর্জন মূল্যহীন হয়ে পড়বে। ২৮ অক্টোবরের লাশের ওপর নৃত্য-উল্লাস থেকে বিশ্বজিৎ ও আবরারের হত্যাকাণ্ড হয়ে ১১ জুলাইয়ের সর্বব্যাপী নীরবতা—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এই ঘুম ভাঙাতে হবে, কারণ ইতিহাস সাক্ষী—যে সমাজ নীরব থাকে, সেই সমাজের পতন অনিবার্য। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বাস্তবায়িত করতে হলে এই নীরবতা ভেঙে জেগে ওঠা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।