রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনা ও দর-কষাকষির পর গতকাল শুক্রবার ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। রক্তক্ষয়ী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সর্বমহলে রাষ্ট্র সংস্কারের যে জোরালো দাবি উঠেছিল, জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

এখন আমাদের প্রত্যাশা, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী আমরা বহুল কাঙ্ক্ষিত একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাব। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস নিজের বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আমরা যে ঐক্যের সুর বাজালাম, সেই সুর নিয়েই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাব।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই পর্বে আলোচনা করে জুলাই সনদ তৈরি করেছে। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে তারা। শুক্রবার জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ২৫টি দলের নেতারা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। তবে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে গঠিত হওয়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ সনদে স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়নি। দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার নতুন সূচনার পথে তাদের এমন অবস্থান দুর্ভাগ্যজনক।

গণতন্ত্রের পথ কেবল স্বাক্ষরের মাধ্যমে শুরু নয়, এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া, যেখানে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই জাতীয় সনদ মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা। অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশা করেছেন, এই দলিলের দ্রুত বাস্তবায়ন ঘটবে এবং এটিই বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে পরিচালনা করবে।

রাজনৈতিক দলগুলো এক জায়গায় বসে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়ায় অংশ নিল, তা এককথায় ঐতিহাসিক বলতে হবে। বিএনপি, জামায়াতসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এই দলিল স্বাক্ষরের ঘটনা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে।’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই সনদকে ‘নাগরিকের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ও রাষ্ট্রের একটি সামাজিক চুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

তবে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের দিনে অনুষ্ঠানস্থলে জুলাই যোদ্ধা পরিচয় দেওয়া এক দল লোক যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করলেন, তা কোনোভাবে কাম্য ছিল না। সেখানে যে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে; তা নাগরিক সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা রোধের ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

গণতন্ত্রের পথ কেবল স্বাক্ষরের মাধ্যমে শুরু নয়, এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া, যেখানে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই জাতীয় সনদ মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা। অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশা করেছেন, এই দলিলের দ্রুত বাস্তবায়ন ঘটবে এবং এটিই বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে পরিচালনা করবে।

যেসব রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি, ভবিষ্যতে তাদেরও সম্পৃক্ত করার চেষ্টা থাকবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। আমরা আশা করব, এনসিপিসহ অন্যান্য দল পরবর্তী সময়ে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে।

জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে অঙ্গীকার করেছে, তা বাস্তবে রূপ দেওয়া নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো দল ভবিষ্যতে এর থেকে সরে যেতে না পারে। সনদে থাকা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শগুলো বাস্তবায়নে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জুলাই সনদ একটি বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যাশা জাগিয়েছে। এই প্রত্যাশা রক্ষা করতে হলে নেতাদের কেবল কাগজে সই করলেই হবে না, সব ধরনের অনিশ্চয়তা ও সংকট নিরসন করে ঐক্য ও সদিচ্ছার সঙ্গে একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

সূত্র, প্রথম আলো