‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ কথাটি আমরা সবাই জানি। সেই নুনের দাম ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের বছরে লবণের দাম এক একলাফে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি শোনা যায়, মানুষ লবণের বদলে চিনি খেতে বাধ্য হয়েছিল। কেউ লুঙ্গির গিঁটে সামান্য লবণ বেঁধে নিয়ে আসত।
লবণের গুরুগম্ভীর শাস্ত্রীয় নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলে সমুদ্রের পানি শুকিয়ে তৈরি হয় লবণ। অঢেল প্রাপ্য হলেও সময়ের পরিক্রমায় এ লবণই কখনো মহার্ঘ হয়ে ওঠে। কয়েক দশক আগেও মুদিদোকানিরা নুনের বস্তা বাইরে ফেলে রাখতেন, পাহারার প্রয়োজনই হতো না।
১৯৩৯ সালের মডার্ন রিভিউতে জে কে নাগ লিখেছেন, নবাবি আমলে এই শিল্পের প্রভূত বিকাশ ঘটে। চট্টগ্রাম থেকে জলেশ্বর পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বর্গমাইলজুড়ে বিস্তৃত ছিল লবণশিল্প। অঞ্চলগুলোর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘নুন দ্বীপ’। বিভিন্ন কারিগর, ব্যবসায়ী, জমিদার ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় দীর্ঘ সময়ে এ শিল্প দাঁড়িয়ে যায়।
চট্টগ্রামে মূলত দুই ধরনের লবণ উৎপাদিত হতো—জাট ও তেলিনিয়া। উৎপাদিত লবণের তিন-চতুর্থাংশ ছিল জাট লবণ আর এক-চতুর্থাংশ ছিল তেলিনিয়া। স্বচ্ছতা, শুভ্রতা ও গুণমানে তেলিনিয়া লবণ ছিল জাট লবণের চেয়ে উন্নত। বাইরের জেলা থেকে আসা মালঙ্গিরা জাট লবণ বানাতেন; আর তেলিনিয়া তৈরি করত কর্ণফুলীর উত্তরে বসবাসকারী স্থানীয় মালঙ্গিরা।
অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও ছিল বিপুল। ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার অন্তত একটি হাট বা গঞ্জ পাওয়া যেত। চাষি ও কুলিরা পণ্য মাথায় বা কাঁধে বহন করে কাছের কোনো হাটে নিয়ে যেত।
অন্যদিকে সৈন্ধব লবণ (হিমালয়ান রক সল্ট), সামুদ্রিক করকচ নুন, কালো নুন বা খনিজ নুন—এসবই খনিজসমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী প্রাকৃতিক সম্পদ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চলেও লবণ পাওয়া যেত। ভাঙ্গামুরা ও মাওদাং ক্লাং এলাকায় লবণঝরনা ছিল, যেখান থেকে কুকি ও শেন্দু জাতিগোষ্ঠী মাটির হাঁড়িতে ঝরনা পানি ফুটিয়ে লবণ উৎপাদন করত। সেসব লবণের রং ছিল হালকা ধূসর।
দুই.
১৯৮৬ সাল, ভারতের গুজরাট। টাটা কেমিক্যালসের এক বিশাল কারখানায় উৎপাদনপ্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে টনকে টন রাসায়নিক নুন বেরিয়ে আসত। জমিতে ফেললে কৃষি নষ্ট হয়ে যেত। তাই রেললাইন বসিয়ে সেই নুন সমুদ্রে ফেলে আসা হতো। এই বিপুল ব্যয় থেকেই তারা বুঝল—এখানেই আছে নতুন মুনাফার উৎস।
টাটা গোষ্ঠী ভারতের রাজীব গান্ধীর সরকারের কাছে আবেদন করল আয়োডিনযুক্ত লবণ বিক্রির অনুমতি চেয়ে। যুক্তি দেখানো হলো, উত্তর-পূর্ব ভারতে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত রোগ বাড়ছে, তাই আয়োডিনযুক্ত নুন জরুরি। সরকার রাজি হলো। প্রাকৃতিক সামুদ্রিক লবণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আয়োডিনযুক্ত নুনকে বাধ্যতামূলক করা হলো। মুহূর্তেই বাজার দখল করল টাটা। স্লোগান উঠল ‘টাটা নিমক, দেশ কা নিমক।’
বাংলাদেশেও আগে যেখানে লবণ সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছে যেত, এখন মাঝখানে ঢুকে গেল কোম্পানিগুলো। আইন হলো—আয়োডিন ছাড়া লবণ বিক্রি নিষিদ্ধ। ফলে লবণচাষীরা বাধ্য হলেন কম দামে কোম্পানির কাছে লবণ বিক্রি করতে, আর ভোক্তাকে কিনতে হলো বেশি দামে।
তিন.
আজ উৎপাদন খরচের তুলনায় লবণের দাম অনেক কম। চাষিরা প্রতি মণ ৪০ কেজি ধরলেও মহাজনেরা নেন ৬০ কেজি হিসাবে। সরকারের কোনো নির্ধারিত মাপকাঠি নেই, তদারকিও নেই।
বর্গাচাষিরা বাজারদরের তুলনায় মণপ্রতি ১০০ টাকা কম পান। দাম বাড়লে মহাজনেরা বিক্রি বন্ধ রাখেন, দাম কমলে চাষিদের কাছ থেকে সস্তায় কিনে মজুত করেন। জমির ভাড়া ওঠানো হয় ইচ্ছেমতো। আর মিলমালিকেরা সরাসরি কেনেন না, কিনতে হয় দালাল মারফত। এখানে রাষ্ট্র কার্যত অনুপস্থিত।
১৯৩০ সালের ১২ মার্চ শুরু হয়েছিল গান্ধীর ডান্ডি পদযাত্রা বা লবণ সত্যাগ্রহ। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের একচেটিয়া লবণ নীতির বিরুদ্ধে এ আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন অধ্যায় যোগ করেছিল। অথচ আজ লবণচাষিরা সংগঠিতই হতে পারছেন না।
মানুষ তো তখনই স্বাধীন, যখন তারা নিজের শ্রম ও সম্পদ নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, জীবনের পথ নিজের মতো বেছে নিতে পারে। বড় বড় বুলি শোনা যায়; কিন্তু লবণচাষিরা কি সত্যিই সেই স্বাধীনতা পেয়েছেন?
নাহিদ হাসান, লেখক ও সংগঠক