যেকোনো জাতি-রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তার নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাসের দ্বারা। আর সেসব বিষয় প্রায়ই সে দেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখিত থাকে। এই নীতি-আদর্শের ভিত্তিতেই জাতি গড়ে ওঠে, সমাজ নির্মিত হয় ও জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে চারটি মূলনীতি নির্ধারিত হয়।

এসব নীতি হচ্ছে—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। অভিযোগ আছে, এসব নীতিমালা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পাদিত অথবা বোঝাপড়ার মাধ্যমে চিহ্নিত বিষয়। প্রবাসী সরকার তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল বলে জানা যায়। যেভাবেই হোক বাংলাদেশের এই সংবিধানের মূলনীতি ছিল অনেকটাই আরোপিত। উল্লিখিত চার নীতির দুটি বাদে অন্য দুটির সঙ্গে এদেশের মানুষের লালিত বিশ্বাস, জীবনবোধ ও জন-আকাঙ্ক্ষার মিল ছিল না। ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল এমন একটি বিষয়, যা গরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের বিরোধী ছিল। আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী প্রমাণ করতে চেয়েছিল, পাকিস্তানের ঘোষিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র বা ইসলামি ভাবধারা বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল। পাকিস্তানের শাসন, শোষণ ও ত্রাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ছিল। কিন্তু আচরিত ধর্মবিশ্বাস অর্থাৎ ইসলামের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের কোনো বিতর্ক, বিদ্বেষ বা বিভেদ ছিল না। এই শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান ও ইসলামকে গুলিয়ে ফেলেছিল। এখনো যখনই ইসলামের কথা বলা হয়, তখন তারা এটিকে পাকিস্তানবাদ বা তাদের ভাবধারা অনুসৃত নীতিমালা হিসেবে চিহ্নিত করে।

আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের ভালো-মন্দআনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের ভালো-মন্দ

আওয়ামী লীগের পতনের পর এখনো দেশের অবিশ্বাসী অংশ এবং বাম ধারার কতিপয় লোক ইসলামের অনুশাসনের কথা বললে তারা এর মধ্যে ‘পাকিস্তান’ আবিষ্কার করেন। মূলত পৃথিবীব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও ইহুদিবাদ লালিত ঘৃণার বাহক হিসেবেই তারা কথা বলে। দর্শন হিসেবে একসময় ধর্ম নিরপেক্ষতা লালিত হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমগ্র পাশ্চাত্যে একটি অংশ জোরালোভাবেই উচ্চারণ করছে ‘ব্যাক টু দ্য বাইবেল’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের ১৩ রাজ্যে ‘ইভেন জালিকা’ বা খ্রিষ্টবাদ যথেষ্ট প্রবল। ইউরোপে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় খ্রিষ্টবাদ আবার ফিরে এসেছে। এমনকি সমাজতন্ত্র-শাসিত পূর্ব ইউরোপীয় ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট প্রবল। গোটা বিশ্ব থেকে সমাজতন্ত্র পরিত্যক্ত হলেও এদেশে কিছু মৌলবাদী, কমিউনিস্ট বা বাম ধারার মানুষ রয়েছেন। তারা মনে করেন, মার্কসবাদ-লেলিনবাদ এখনো জরুরি।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের মূলনীতি ছিল জনগণের বিশ্বাসবিরোধী। স্বাধীনতার পরপরই গোটা বাংলাদেশে ইসলামিক সেন্টিমেন্ট প্রবলভাবেই ফিরে আসে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বলা হয়—‘They don’t act but react.’ মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ভারতবিদ্বেষ ছিল অনেকটাই প্রশমিত, বিজয় লাভের পরে তা ঊর্ধ্ব ধারায় প্রবাহিত হয়। ভারতীয় বাহিনীর লুটপাট, নির্লজ্জ কর্তৃত্ব এবং সবকিছুতে তাদের নিয়ন্ত্রণ দেখে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে মুসলিম বাংলার স্লোগান উত্থিত হয়। বসন্ত চ্যাটার্জী বিজয়লাভের পরপরই তার লিখিত ‘Inside Bangladesh’ নামক গ্রন্থে এর বর্ণনা দেন। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ রকম সেন্টিমেন্টও লক্ষ করা যায় যে, জওহরলাল নেহেরু এক পাকিস্তান বানিয়েছিলেন; তার কন্যা ইন্দিরা দুটো পাকিস্তান বানিয়েছেন। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতে যে বাংলাদেশবিরোধী ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে, আসলে এটি সেখানে সু-সুপ্ত ছিল। পরিবেশভেদে তার প্রবল প্রকাশ ঘটেছে মাত্র। ১৯৭২ সাল থেকে ভারতবিরোধী তথা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ বিরোধিতা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর ঘটনাবলিতে মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে। সে দৃশ্য দেখার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ‘History repeats itself.’—ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কী বিস্ময়ের ব্যাপার—২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে গণরোষে উৎপাটিত হয় সব মূর্তি এবং ওই ধারার যাবতীয় চিহ্ন, এমনকি পোস্টারটিও!

সংবিধানের মূলনীতি প্রসঙ্গে এসব কথা উল্লেখিত হলো বাস্তব অবস্থা বোঝানোর জন্য। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে প্রফেসর আলী রীয়াজের নেতৃত্বে একটি সংবিধান সংশোধন কমিশন গঠিত হয়।

আলী রীয়াজ সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই কমিশনটি ২০২৪ সালে গঠিত হয়েছিল এবং এর প্রধান কাজ ছিল বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই তিনটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন আগের মূলনীতি গণতন্ত্র বহাল রেখে নতুন চারটি মূলনীতি সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে এই পাঁচটি নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে এই কমিশন তাদের প্রণীত সুপারিশমালা পেশ করেছে। এখন প্রণীত সুপারিশমালার আলোকে ঐকমত্য সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে। সংবিধানের অন্যান্য সংশোধনীর পর সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছে।

১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি ঠিক রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ত্রুটি, দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা দূর করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সম্প্রতি সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে নিজেদের লিখিত প্রস্তাব দেয় সিপিবি।

অন্যদিকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

ইসলামি আন্দোলন তথা চরমোনাইয়ের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতায় সঠিক নয়। সেই সংবিধান জনগণের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়নি। এজন্য অধিকাংশ দল এই মূলনীতি বাতিলের পক্ষে। সেজন্য বাহাত্তরের মূলনীতি বাদ দিয়ে নতুন মূলনীতি নিয়ে আসতে হবে। সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে থাকা তিনটি বিষয় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার সংবিধানে যুক্ত করলে কোনো আপত্তি নেই। তবে গণতন্ত্র যুক্ত রাখতে হলে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস যেটি ছিল সংবিধানে, সেটি যুক্ত করতে হবে।

জামায়াতে ইসলামী সংস্কার কমিশন প্রদত্ত সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করেছে। সংবিধান থেকে মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র রেখে অন্যসব নীতিমালা, অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জ্ঞাপন করেছে তারা। তাদের সমর্থন এতটাই সতত ও স্বাভাবিক যে তারা এ নিয়ে কমিশনের বিপরীতে কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেনি। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার যে সুপারিশ করেছে, সেখান থেকে ‘বহুত্ববাদ’ শব্দটি বাদ দিতে বলেছে জামায়াত। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’-এর আগে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ’ কথাগুলো যুক্ত করার মতামত তুলে ধরেছে দলটি।

সংবিধান সংস্কারে বিএনপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে লিখিতভাবে যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছিল, কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় নানা যুক্তি-ব্যাখ্যায় দলটি সে অবস্থানই প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি পরিবর্তনে কমিশনের করা সুপারিশগুলোয় বিএনপির জোরালো আপত্তি রয়েছে। তবে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, কিছু কিছু বিষয়ে কমিশনের যুক্তিসংগত সুপারিশ গ্রহণের জন্য বিবেচনা করছে বিএনপি। সে বিষয়গুলো দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে।

বিএনপি সংবিধানের মূলনীতির ব্যাপারে যেমন আছে তেমন থাকার পক্ষপাতী। তাদের যুক্তি হচ্ছে, সংবিধান পরিবর্তিত হয়ে এখন আর ’৭২-এর ভিত্তিমূলে প্রোথিত নয়। বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হয়েছে। শেখ হাসিনার দ্বারা পরিবর্তিত মূলনীতিগুলোয় অনেক সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত সংবিধানে দেখা যায়, এর দ্বিতীয় ভাগ—রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বিষয়ে উল্লেখিত হয়েছে। এসব মূলনীতির মধ্যে রয়েছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। এসব মূলনীতির পরে আরো কিছু বিষয় যেগুলো আলংকারিক এবং রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যবাধকতামূলক, এ রকম বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। যেমন মালিকানার নীতি, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষিবিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন—এ রকম করণীয় বিষয়ের পর আরো কিছু উল্লেখিত হয়েছে, যা মূলনীতি-বিষয়ক নয়। যেমন সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম, নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণ, জাতীয় সংস্কৃতি, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, জাতীয় স্মৃতি নিদর্শন, আন্তর্জাতিক শান্তি নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন—এসব বিষয় মৌলিক অধিকার-বিষয়ক। এগুলো মূলনীতি হিসেবে উল্লেখিত হওয়ায় বিভ্রান্তি বেড়েছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, বাকশাল তথা চতুর্থ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনয়ন করেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার ষষ্ঠ দিনে পঞ্চম সংশোধনী রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ফিরে আসবে বলে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন উল্লেখ করেন। এবার দেখা যাক, পঞ্চম সংশোধনীতে কী কী ছিল? সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, যা ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সংশোধনীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের গৃহীত কার্যক্রমকে বৈধতা দেওয়া হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর প্রধান দিকগুলো হলো—১. সংবিধানের শুরুতে প্রস্তাবনার ওপরে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম (দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহের নামে)’ কথাগুলো সংযোজন করা হয়; ২. ‘বাঙালি’ জাতিকে ‘বাংলাদেশি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়; ৩. রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’কে রাষ্ট্রীয় ‘সকল কাজের ভিত্তি’ বলা হয়; ৪. রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়, সমাজতন্ত্র বলতে বোঝাবে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ এবং ৫. সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান আনা হয়।

বিএনপি যদি পঞ্চম সংশোধনীতে যে সংশোধন আনা হয়েছিল, সেখানে অনড় থাকে, তাহলে মূলনীতি-বিষয়ক বিতর্কের অবসান ঘটবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। ইসলামি দলগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিসমিল্লাহ বা আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলেছে, তা দৃশ্যত অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। বিএনপির আরো স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, পঞ্চম সংশোধনীতে আনীত সাংবিধানিক সংযোজনই যথেষ্ট। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জনগণের নাড়ির টান বুঝতেন। প্রারম্ভে উল্লেখিত মুসলিম সেন্টিমেন্ট বা ইসলামি মূল্যবোধ যে ধারণ করে বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্র, তা জিয়াউর রহমান অনুধাবন করেন। সে লক্ষ্যে এই সংশোধনী আনা হয়। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৭ সালে গৃহীত গণভোটে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ওপর আস্থা জ্ঞাপনের পর ওই ব্যালটে সংবিধানের পক্ষে মতামত চাওয়া হয়। অর্থাৎ ওই সংশোধনীতে জনগণের সতত স্বাভাবিক সমর্থন ছিল। শেখ হাসিনা ২০১১ সালে একরকম গায়ের জোরে সংবিধানের মূলনীতি বাতিল করে নিজের মতো করে তা লিখে নেন। সেটি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও জন-আকাঙ্ক্ষায় পরিত্যক্ত হতে বাধ্য।

সুতরাং সংবিধানের মূলনীতি-বিষয়ক বিতর্কের অবসান হতে পারে পঞ্চম সংশোধনীতে ফিরে গেলে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জনগণের আকাঙ্ক্ষায় ও অনুমোদনে যে বিষয়টি স্থির করে গেছেন, তা নিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ থাকে না। তবে স্বাধীনতার মূল ঘোষণায় সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা যদি কেউ মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে চায়, সেখানে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। সংবিধান যদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ তথা প্রতিধ্বনি হয়ে থাকে, তাহলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতেই তা সংশোধিত ও সংযোজিত হবে—এটাই শেষ কথা।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

সংবিধান

সূত্র, আমার দেশ