২০২৪ সালের জুলাইয়ের মনসুন রেভাল্যুশন বা বর্ষাবিপ্লবের গ্রাফিতি হচ্ছে—১. স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু; ২. মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু; ৩. যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ/ যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবেই তুমি বাংলাদেশ; ৪. স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনব; ৫. চলো রাষ্ট্র সংস্কার করি; ৬. রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলমান, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।

উপরোক্ত পটভূমি ও বর্ষাবিপ্লবের দেয়ালচিত্রকে সামনে রেখে আমার প্রতীকী ও অকৃত্রিম উপস্থাপনা আপনার, আমার, আমাদের সবার, কোটি জনতার স্বপ্নের, মূর্ত আকাঙ্ক্ষার, জীবনচর্চার, করণীয় নির্ধারণের ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে একেবারেই প্রাথমিক ব্যাখ্যা নির্যাস। কেবল ফ্যাসিস্ট হাসিনার ও ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের উৎখাত এবং সরকার বদলের জন্যই ২০২৪ সালের বর্ষাবিপ্লব সংঘটিত হয়নি; বরং চিন্তার অগভীরতা এবং তথ্য ও বোধের অজ্ঞতার কারণে বুঝি বা না বুঝি কিংবা পরগাছা নটবর, আলগা মাতব্বর, রাজনৈতিক ব্যক্তি-নেতা-দলদাস আর সুশীল কিংকররা যেভাবেই ঢেকে রাখতে বা দৃষ্টি ঘোরাতে অপচেষ্টা করুক না কেন, জন-আকাঙ্ক্ষার তীব্র উচ্ছ্বাস ও দাবিকে এবার আর লুকিয়ে রাখা যাবে না, পদতলে পিষ্ট করা যাবে না।

নেতাবন্দনা, পরিবারতন্ত্রের সংকীর্ণতা, গোষ্ঠীতন্ত্র, অলিগার্ক কনগ্লোমারেশন, দলদাসত্ব, রাজনৈতিক চক্রের মস্তানি, চোপাবাজি, হুমকি-ধমকি, কৃতিত্ব ছিনতাই, অশিক্ষিতের অহং ও আস্ফালন, নিছক রাহাজানি আর রাজনৈতিক ক্যারিকেচারের ম্যাজিক দেখিয়ে ক্রীড়ানুষ্ঠান চাপিয়ে দিয়ে এবার বর্ষাবিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের উত্থিত জন-আকাঙ্ক্ষা ও নতুন জীবনের স্বপ্নকে ঠেকানো একেবারেই দুঃসাধ্য। কোটা সংস্কার, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, বর্ষাবিপ্লব, ৩৬ জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদের নিকৃষ্টতম দালাল ফ্যাসিস্ট হাসিনা রেজিমের পতন এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সঙ্গে সংস্কার, রাষ্ট্রের জনমালিকানা ও জুলাই ঘোষণা অবিচ্ছেদ্য।

নতুন জীবনের জন্য দীর্ঘকালের আকাঙ্ক্ষা ২০২৪ সালের বর্ষাবিপ্লবের মাধ্যমে এত জীবনদান, পঙ্গুত্ববরণ, চোখ হারানো, ত্যাগ, কান্না ও লড়াই-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আল্লাহর অপার করুণায় ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট উৎখাত এবং জনবিজয়ের মাধ্যমে উচ্চকিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে—আমরা বাংলাদেশের জনগণ পুরোনো রাষ্ট্র বন্দোবস্তকে যাবতীয় বৈষম্যের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন হিসেবেই প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা এবার নতুন জীবনের দিকে এগোনো এবং তা নির্মাণের উদ্দেশ্যে নতুন এক রাষ্ট্র বন্দোবস্ত ও সমাজগঠনের আকর ভাবনাকে সমগ্র সমাজ, জনভূগোলের আদিগন্ত তটরেখা এবং সচেতন নাগরিক সত্তার সাধারণ ইচ্ছা হিসেবে আমাদের সর্বোচ্চ সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের ন্যাশনাল চার্টার আমানতরূপে সামনে এনেছি। আর যেকোনো মূল্যে কোনো ভাঁড়, প্রতারক, মাতব্বর শ্রেণি, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক চক্র, এলিট, পাওয়ার এলিট, রুলিং এলিট, কাউন্টার এলিট, অলিগার্ক এলিট এবং ব্যুরোক্রেটিক এলিটের অপতৎপরতা ও হুমকি অগ্রাহ্য করে আমরা নতুন এক জনসম্পৃক্ত, জননিয়ন্ত্রিত, সমাজকল্যাণমুখী, বৈষম্যবিরোধী ও সমতা প্রতিষ্ঠাকারী রাষ্ট্র বন্দোবস্ত গড়ে তুলবই ইনশাআল্লাহ। পুরোনো রাষ্ট্রের খোলনলচে বদল, টোটাল আপসাইড ডাউন, বিদ্যমান এস্টাব্লিশমেন্ট ও স্ট্যাটাস কো’র উৎপাটন, নয়া সাংবিধানিক কাঠামো, নতুন প্রক্রিয়ায়-বিধানে-নিয়মে প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্বিন্যাস; আইনি কাঠামোর নবায়ন ও রুলস অব বিজনেসের বদল; অর্থনীতি-পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি-সামাজিকীকরণ; সংসদ, শাসন, বিচার, প্রশাসন, পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী; রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব, নির্বাচন, প্রতিনিধিত্ব, দলান্ধ অনুসারী কাঠামো—সবকিছুতেই পুরোনোকে ডিকনস্ট্রাক্ট করে সম্পূর্ণ নয়া দিনের উপযোগী রিকনস্ট্রাকশন করতে হবে। বিদ্যমান সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’—এটা প্রহসনে রূপান্তরিত হয়েছে সংবিধানের পরতে পরতে পরস্পরবিরোধিতা এবং জনমালিকানা, জনঅধিকার ও জনক্ষমতায়নকে সার্বিকভাবে খর্ব করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। এখানেই ফ্যাসিবাদের শিকড় ও জনগণের দাসত্বের শৃঙ্খলসূত্র বিধৃত।

আর এসব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই রাষ্ট্রের নয়া বন্দোবস্ত ও আমূল বদল অনস্বীকার্য। পুরোনো বন্দোবস্ত পাল্টে ফেলা তাই জাতির সামনে এক নম্বর এজেন্ডা। ২০২৪ সালের বর্ষাবিপ্লবের মূর্ত আকাঙ্ক্ষা তাই নতুন এক সমষ্টি-কল্যাণকর জনজীবন নির্মাণের লক্ষ্যে নতুনভাবে রাষ্ট্রের ওপর চূড়ান্ত, সর্বোচ্চ ও সর্বমুখী জনমালিকানা প্রতিষ্ঠায় অনিবার্যভাবে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ পুনর্গঠন তাই এখন বর্ষাবিপ্লব-উত্তর সবচেয়ে গভীর জন-আকাঙ্ক্ষার যথার্থ উচ্চারণ। জাতীয় নির্বাচন নতুন বন্দোবস্ত, নতুন বদলে যাওয়া প্রকৃত জনমালিকানাধীন রাষ্ট্রের জমিতেই কেবল কাম্য হতে পারে, বৈধতার সূত্র, জন-ইচ্ছার যাচাই, জন-বাছাইয়ের উপায় ও জনসম্মতির স্মারক হতে পারে। এটা কেবলই সংসদে, সরকারে ও ক্ষমতায় নিছক সাময়িক সেবক প্রতিনিধি পাঠানোর অর্থেই সত্য। নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ক্ষমতায় আরোহণ কোনো অবস্থাতেই জনগণের দিক থেকে ক্ষমতাহীন ক্রীতদাস হয়ে থাকার বিষয় নয়। এটা সরকারে যাওয়া দল বা ব্যক্তিদের জন্য স্বেচ্ছাচারের লাইসেন্সও নয়। মনে রাখতে হবে, ক্ষমতা লাভেচ্ছুদের উদগ্র বাসনা ও দখলদারত্ব চরিতার্থ করার জন্য নতুন বন্দোবস্তের আবশ্যকতা রয়েছে, যাতে করে বর্ষাবিপ্লবের মাধ্যমে উত্থিত নতুন জনমালিকানাধীন রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্ত জন-আকাঙ্ক্ষাকে হেলায় কেউ সরিয়ে দিতে না পারেন। বর্ষাবিপ্লবের স্পিরিট এবং দেশজুড়ে তার গ্রাফিতি এ কথাই স্পষ্ট ব্যক্ত করছে। বারংবার মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে ৩৬৫ দিনের গণতন্ত্র ও সম্মতির বদলে এক দিনের ভোটরঙ্গকে সমাধান হিসেবে দেখানোর দিন শেষ।

স্পষ্টতই, জনগণই রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক ও একমাত্র নিয়ন্ত্রক। আর বিপরীতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পাবলিক সার্ভেন্ট, জনকৃত্যক, জন-ইচ্ছাধীন সম্পূর্ণ অস্থায়ী এবং জন-ইচ্ছায় অপসারণযোগ্য। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ বারংবার এত বেশি ত্যাগ স্বীকারের পর এবার যদি ভুল করে, ভুলে যায়, তামাশার তমশায় পড়ে, তাহলে তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা, মুক্তি, নতুন জীবনের স্বপ্ন, বৈষম্যবিলোপ, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আমানতদারী ও ইনসাফভিত্তিক নতুন রাষ্ট্রবন্দোবস্ত ও জীবনব্যবস্থার মূর্ত আকাঙ্ক্ষা পথ হারাবে অন্ধকারের অমানিশায়। এটা হবে এদেশের সমষ্টি জনগণের জন্য সম্মিলিতভাবে আত্মবিনাশ ও আত্মহনন, যা কোনোক্রমেই হতে দেওয়া যাবে না। এই আহ্বান রাখছি, সেই জানা আর নাম না জানা অগণিত বনি আদমদের কাছে, যারা রাব্বুল আলামিনের প্রতি ঈমান রেখে জীবন হাতে করে ফ্যাসিবাদ উৎখাতের জন্য, জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য, নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় দিনের পর দিন রাতের পর রাত রাজপথে ও জনপদে লড়াই করেছেন।

অতএব, শুধুই নির্বাচনের কালকূটকে গ্রহণ করে নতুন কুলার আশাকে আমরা জনগণ কোনো অবস্থাতে ভেঙে দিতে পারি না। নির্বাচন বাছাই প্রক্রিয়া মাত্র, অতি সাময়িক কৃত্যক প্রতিনিধি স্থিরীকরণের জন্য। কিন্তু দীর্ঘকালের অমানিশায় ডুবে যাওয়া যে মানবকুল আজও আলোর মুখ দেখল না; এখনো যখন হাজার বছর ধরে পথ চলার পর আমাদের সম্মিলিত স্বপ্ন ১৮৫৮, ১৯০৫, ১৯৪০, ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৯০ এবং সবশেষে ২০২৪ হয়েও স্বাধীনতা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, আমানতদারি ও ইনসাফের নতুন রাষ্ট্র কায়েম পারল না, তখন রাষ্ট্রবদল, রাষ্ট্রসংস্কার, রাষ্ট্রপুনর্গঠন ইত্যাকার একই কাঠামো-সংহতি-সংযুক্তির বৃহত্তম লক্ষ্যকে আড়ালে নিয়ে যাওয়ার সব অপচেষ্টা কেন রুখে দাঁড়াবে না জনগণ? কেন তারা নিছক নির্বাচনকেই নতুন জনমালিকানাধীন রাষ্ট্রগঠন এবং নয়া সংবিধানের ও এত আশাবাদের জুলাই ঘোষণার সঙ্গে তুল্যমূল্য করে নেবে? কেন তারা ছেড়ে দেবে গণভোটের মাধ্যমে তাদের প্রাথমিক ও প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগকে?

নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু তা জনগণের মালিকানাধীন রাষ্ট্রবন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার চেয়ে বড় নয়। নির্বাচিত সরকার ওই কাজ করে দেবে বলে আমরা যদি অসচেতন হয়ে পড়ি, মৌখিক বোলচালে ভুলে যাই, তবে আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি। জনগণকে তাদের কাজ ও মৌলিক দায় নিজেদেরই সচেতনতা ও সক্রিয়তার সঙ্গেই সমাধা করতে হবে। কৃত্যক বা প্রতিনিধি তা করে দেবে ভাবলে মারাত্মক ভুল হবে। কুহকের ডাক আর বিবরের অচলায়তন থেকে বেরোতে হলে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই নির্মাণ করতে হবে। আপনারা কি ভুলে গেছেন—মাত্র ১১ মাস আগে আপনারাই সারা দেশে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লড়াই চালিয়ে, জীবন দিয়ে এবং ত্যাগ স্বীকার করে ফ্যাসিস্ট সরকার ও দলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছেন? নির্বাচনের বরকন্দাজ কারবারিরা তখন কোথায় ছিল? কীভাবে পার হয়েছে ২০০৯, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নজিরবিহীন নির্বাচনী প্রহসন? ভয়াবহ নির্লজ্জ ধান্ধাবাজ সুশীল গোষ্ঠী, সাংঘাতিক মিডিয়াচক্র আর আমলা-ফয়লারা তখন কী করেছিল, কাদের সঙ্গে ছিল, কাদের হয়ে কাজ করেছিল?

এখন তাই নতুন বন্দোবস্তের, নতুন জনমালিকানাধীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রশ্নে যেটা আমাদেরকে, আমজনগণকে অত্যন্ত স্পষ্ট করে বুঝতে হবে, তা হচ্ছে, রাষ্ট্রের সৃষ্টি মানুষেরই প্রয়োজনে; রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানুষ নয়। মানুষের কল্যাণার্থে মানুষেরই সম্মিলিত ইচ্ছায় আলোচনা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, লড়াই, যুদ্ধ, আন্দোলন-অভ্যুত্থান, জনউত্থান-বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্ট হয়। আর তা জনমানুষের অস্তিত্ব, বাস্তবতা ও স্থায়িত্বের সঙ্গে একেবারেই তুলনীয় নয়। অর্থাৎ জনগণ সমষ্টিগতভাবে কর্তাসত্তা ও মৌলিক ভিত্তি। তাই রাষ্ট্র, এর অস্তিত্ব, আদর্শ, সংবিধান, রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব, এলিট, আমলা, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, সংগঠন-কাঠামো, প্রতিষ্ঠান, আইন ব্যবস্থা, সরকার, নিয়মবিধান, নির্বাচন, ক্ষমতাপরিসর, ক্ষমতাসম্পর্ক, বরাদ্দব্যবস্থা প্রভৃতিকে একদিকে উপযোগ এবং অন্যদিকে বিধিব্যবস্থার ভীতির শর্তে আইন মান্যতার বিবেচনায় মানা হয়। তবে এগুলো মানুষের, সমষ্টি নাগরিক সত্তার মৌলিকত্ব তথা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট চার্টার বিবেচনায় অতি অবশ্যই অধস্তন, কৃত্যক, করণিক, অনুগত, অনুগামী, সেবক এবং এককথায় পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারির জন্য নিয়োজিত পাবলিক সার্ভেন্ট বিধায় সর্বাবস্থায় জননিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য এসব। সমস্যাটি ঘটে তখন, যখন কেন্দ্রীয় এ সত্য বিষয়ে সচেতন না হওয়ায়, চিন্তা না থাকায়, অধিকার প্রয়োগ না করায়, জনকর্তৃত্ব না ফলানোয় পরিস্থিতি এগোয় প্রতিকূল ধারায়। এ অবস্থায় স্টাফ ও প্রপঞ্চগুলো মানুষের ওপর প্রভুত্ব করে এবং মানুষকে ও জনমণ্ডলীকে দাসে রূপান্তরিত করে।

আদতে সত্য হচ্ছে, রাষ্ট্রের মালিকানা একমাত্র জনগণের আমানত। এখানে কোনো ভাগ থাকতে পারে না জননিয়ন্ত্রিত কোনো কাঠামো বা কৃত্যকের দিক থেকে। রুল মেকিং, রুল অ্যাপ্লিকেশন, রুল অ্যাডজুডিকেশন, পলিটিক্যাল এলিট, পাওয়ার এলিট, কাউন্টার এলিট, পলিটিকাল বস, পার্টি বস, পাওয়ার সিকার্স—সবাই এখানে পাবলিক স্ফিয়ার এনহেনসমেন্টের আওতায়, সিভিক কন্ট্রোলে, লিমিটেড জুরিসডিকশনে, একযোগে সেপারেশন ও প্রক্সিমিটি নিয়ে, রোল ডিফারেনসিয়েশন ও রোল স্পেসিফিসিটি নিয়ে স্বচ্ছতা, দায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহির মাঝে থাকবে। এমন পরিস্থিতি সভ্যসমাজ, হাই পলিটিক্যাল কালচারনির্ভর রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তের স্মারক। সরকার, প্রতিনিধি, আমলাতন্ত্র, ক্ষমতা কাঠামো—এসবই আমাদের কাম্য রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় জনমানুষের প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট সম্মতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে জনগণের পাবলিক সার্ভেন্ট ও পাবলিক এক্সচেকার বা জনকোষাগার থেকে বেতনপ্রাপ্ত ও কাজের বিনিময়ে সুবিধাভোগী। এহেন ক্ষেত্রে জনগণ ইচ্ছা করলেই এবং সমর্থন প্রত্যাহার করলেই রাষ্ট্রের কথিত অন্য সবার অবস্থান অবৈধ ও অন্যায্য হতে বাধ্য, যদি যে কেউ জন-ইচ্ছার বিপরীতে যায়। এ অবস্থায় নিয়মানুগ পথে অথবা বল প্রয়োগ করে উপরোক্তদের অপসারণ কিংবা অস্তিত্বহীনতা নিশ্চিত করাটাই জনগণের একান্ত করণীয় সর্বোচ্চ বৈধতা উৎপাদনকারী।

তাই কেবল ক্ষমতার হাত বদল, এদল থেকে সেদলই শেষ কথা নয়, সব কথা নয়; বুঝতে হবে রাষ্ট্র ও সরকারের যেকোনো ভূমিকা, দায়িত্ব ও ক্ষমতা একান্তই সাময়িক ও জনসম্মতিনির্ভর আমানত। এর খেয়ানত করলে জনগণ মৌলিক অস্তিত্ব হিসেবে সত্তাগত অবিচ্ছেদ্য অধিকার, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাবলে উপরোক্ত সব শর্তের বদল ও উৎপাটন ঘটাতে সক্ষম। এ অবস্থা বোঝা ও এক্ষেত্রে সচেতন ক্রিয়াশীলতাই জনস্বাধীনতা, জনক্ষমতায়ন, জনপ্রবেশগম্যতা, জন-অন্তর্ভুক্তি, জনকল্যাণ ও জনস্বার্থ সংরক্ষণের একমাত্র উপায়। বর্ষাবিপ্লব তাই নতুন আশা জাগিয়েছে। জনগণ জানিয়ে দিয়েছে, ‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কার আনব।’ ছাত্র-জনতা এটাকে তাই আখ্যা দিয়েছে—‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’। ১৯৭১ সালে আমরা পেয়েছি নতুন স্বাধীন দেশ, ২০২৪ সালের বর্ষাবিপ্লব তারই জনবিস্তৃতি ও জনজাগৃতি। একই ধারাবাহিকতা ও পরম্পরায় দুই ক্ষেত্রেই স্বপ্ন একই—স্বাধীনতা, বৈষম্য ও শোষণমুক্তি, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, উন্নয়ন এবং ইনসাফের জীবন; আর সেজন্যই অনিবার্য জরুরত হচ্ছে নতুন জনমালিকানাধীন জনসম্মতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন। আসল সংস্কার তো এটাই।

মনস্টার পলিটিক্স আর ককরোচ পলিটিক্সের আনইভেন রেইসে পারপিচুয়েটিং এলিট ও অলিগার্ক কনগ্লোমারেশন যে সার্কাস দেখাচ্ছেন, সেটার প্রতিবিধান প্রকৃত জনমালিকানাধীন আমানতদারি রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া অসম্ভব। এখন তাই ঠিকানা, নিশানা, লক্ষ্য ও মঞ্জিল হতে হবে নির্ভুল। ভার্টিক্যাল হিউম্যান বিয়িং হয়ে আমরা জনগণ ঊনজনের কোনো প্রতিনিধিত্বের দাবিদার তঞ্চকচক্রের লাথি খাওয়া ফুটবল হব না। কারণ ভীষণ ঝোড়ো এক ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের দুস্তর পথ পরিক্রমার মাঝ দিয়ে দ্রোহের আগুনে, শোণিতের আখরে আঁকা ও লেখা হয়েছে বাংলাদেশ জনপদে বিস্তীর্ণ মানবভূগোলের গ্রাফিতি। এটাই বর্ষাবিপ্লবের ক্লেয়ারিয়ান কল। সভ্যতা, মানবতা, বৈষম্যহীনতা, দীন ও ইনসাফের প্রতিশ্রুতি ও প্রেরণা এখানেই। এজন্য ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও নির্যাস থেকে আদিগন্ত বাংলাদেশের মানচিত্রকে ভিত্তি করে এর টোটাল টেক্সচারকে ধরে রেখে নতুন জনমালিকানাধীন রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে হবে জনমানুষের বিশ্বাসের জমি, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, ভূখণ্ডগত নিরাপত্তা, জনভূগোল, সমাজ তটরেখা, জাতীয় স্বার্থ, ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের যথার্থ বিবেচনাগুলোকে সঙ্গী করে। এজন্য সম্পূর্ণ নতুন ভিন্নধর্মী উপস্থাপনা ও প্রকৌশল প্রয়োগযোগ্য হবে, যার কেন্দ্রে থাকবে আমাদের জনগণ, সমষ্টিমানুষ, তাদের স্বপ্ন, আশা, নিয়ন্ত্রণ ও স্বনিয়ন্ত্রিত মালিকানা। এটাই প্রতিফলিত হতে হবে আগামী জুলাই ডিক্লারেশন বা জুলাই ঘোষণায়। ঘোষণাটি কেবল নীতিতেই নয়, বরং সর্বাবস্থায় আদালতে বলবৎযোগ্য হতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, আমার দেশ