আমার দেশ বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা অমিত সম্ভাবনার এক দেশ। তুর্কি বীর ইখতিয়ার মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি (রহ.) এই দেশের মানুষকে অত্যাচারী সেন রাজাদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে শাহজালাল (রহ.), শাহ মখদুম (রহ.)-এর মতো নাম না জানা শত শত অলি-আওলিয়ার পরিশ্রমে দেশটি একটি মুসলিম অধ্যুষিত জনপদে পরিণত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় ইসলামী খেলাফতের সরাসরি শাসন কখনো এখানে পৌঁছায়নি। তাই মুসলিম শাসিত হলেও ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগের পরশ থেকে এই অঞ্চলের জনগণ বঞ্চিত হয়েছেন। শিক্ষা-দীক্ষা, তাহজিব-তমুদ্দুনে আমরা একটি পিছিয়ে পড়া জাতিতে পরিণত হয়েছি।
৪৭-এ ইংরেজ বেনিয়ারা যখন দেশ ছেড়ে যায়, তখন কলকাতা ছিল বাংলার সবচেয়ে অগ্রগামী নগর। একটি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য যা কিছু দরকার, সবই ছিল কলকাতায়। পূর্ববাংলার ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো প্রাচীন শহরগুলো জৌলুস হারিয়ে ছোট শহরে পরিণত হয়েছিল। এ অঞ্চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ছিল না আর কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান । আমাদের নতুন দিনের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় খালি হাতে। তারপর পাকিস্তানি আমলের কুশাসনে আমাদের জাতি গঠনের প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখনো আমরা তার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের জাতি কৃত্রিম বিভাজনে দ্বিধাবিভক্ত। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি দলবাজির ডামাডোলে পথ হারিয়ে বসে আছে।
জাতীয় সংস্কৃতিতে ঐক্যের ধারণা সুসংহত না হলে ভৌগোলিক স্বাধীনতা টেকসই হয় না। বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণার মধ্যেই আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতার রক্ষাকবচ নিহিত রয়েছে। রক্তক্ষয়ী জুলাই অভ্যুত্থানে হাজার হাজার তরুণ-যুবার রক্তের বিনিময়ে আজ সুযোগ এসেছে নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ইসলামি মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এই দেশের সাংস্কৃতিক কাঠামো বিনির্মাণের। এই সুযোগ হেলায় হারিয়ে যেতে দিলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
সংস্কৃতি বিনির্মাণের মূল সোপান হলো শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিকে মজবুত করে শক্তিশালী জাতি গঠন সম্ভব। জাপানের ইতিহাস এর বড় উদাহরণ। বাংলা সালতানাত যখন সারা দুনিয়ায় একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে সুপরিচিত, পৃথিবীর মানুষ তখন জানতই না যে জাপান নামে একটি দেশ আছে। এই সেদিনও জাপান ছিল একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে মেইজি যুগে জাপানিরা সংস্কারে হাত দেয়। জাপানি জনগণ পশ্চিমা শক্তির ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ঝুঁকিতে থাকা একটি বিচ্ছিন্ন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে একটি আধুনিক, শিল্পোন্নত জাতিরাষ্ট্র এবং উদীয়মান শক্তিতে পরিণত হয়। নতুন ধারার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণের ফলে জাপানে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলোর প্রভাব গভীর ও সুদূরপ্রসারী হয়েছে। মাত্র ৫০ বছরেই জাপান পৃথিবীর একটি অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে।
জাপানিদের জাতীয় ঐক্য কত মজবুত, তার একটি উদাহরণ দিই। ৩০-৩৫ বছর আগে একবার জাপানে চালের সংকট তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চালের দাম অনেক বেড়ে যায়। সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য থাইল্যান্ড থেকে চাল আমদানি করে। এতে কৃষকরা চাপে পড়ে যান। উৎপাদন কম হওয়ায় এমনিতেই কৃষকদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। তার ওপর ফসল বিক্রি করতে না পারলে অনেকের পথে বসার উপক্রম হয়। কিন্তু দেশের খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রাজনীতিবিদরা এক হয়ে এগিয়ে এলেন কৃষকদের পক্ষে। তারা জনগণকে বোঝালেন, সস্তা পেয়ে থাই চাল কিনলে দেশের কৃষকরা বিপাকে পড়বেন। এতে অনেকে নিরুৎসাহিত হয়ে চাষাবাদ ছেড়ে দিলে দীর্ঘ মেয়াদে বিপদে পড়বে দেশ। মজার ব্যাপার হলো, ধনী-গরিব নির্বিশেষে জাপানিরা রাজনীতিকদের কথা মেনে নিয়েছিলেন। থাই চাল তারা খাননি, গুদামে পচেছে।
জাপানি শিশুদের মাথায় এই ধারণা গেঁথে দেওয়া হয় যে, তাদের দেশ একটি দ্বীপরাষ্ট্র। বেশির ভাগ ভূমিই চাষাবাদের অনুপযুক্ত। কাজেই অল্প জমিতেই তাদের বসবাস করতে হবে, চাষাবাদ করতে হবে। তাই তারা চাষের উপযোগী এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখে না। ছোট বাড়িতে বসবাস করে। বড়দের তারা অসম্ভব রকম শ্রদ্ধা করে থাকে। মিথ্যা বলা, কুতর্ক করা, কাজে ফাঁকি দেওয়া আর চুরিদারির অভ্যাস তাদের সংস্কৃতিতে নেই। আমি ১৯৯৪ থেকে প্রায় চার বছর টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। এ সময় জাপানি শিশু-কিশোরদের সততা আর নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি নিষ্ঠা দেখে অভিভূত হয়েছি। আমার বারবার মনে হয়েছে, এ রকম সমাজ তো আমাদের স্বপ্নের সমাজ। এ রকম সমাজই তো আমরা চাই।
আমাদের ধর্ম যেই ধরনের আদর্শ মানুষ তৈরি করতে চায়, জাপানিরা সেই ধরনের আদর্শ মানুষ তৈরি করতে পারছে। এটা তাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্যারিশমা। আমরা রেগে গেলে চরম অশ্রাব্য গালাগাল করি। এমনকি আরেকজনের গায়ে হাত তুলতে পর্যন্ত বিব্রতবোধ করি না। অথচ জাপানি ভাষায় মনের ঝাল মিটিয়ে গালি দেওয়ার মতো তেমন কোনো শব্দ পর্যন্ত নেই। রাগের সময় তারা আরেকজনকে চরমভাবে অপমান করতে চাইলে বোকা বলে ডেকে থাকে। দুজন সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে বাগবিতণ্ডা করলেও কখনো আরেকজনের গায়ে হাত তোলে না।
তাদের সংস্কৃতির প্রভাব খাবার টেবিল থেকে কর্মক্ষেত্র সর্বত্রই দৃশ্যমান। বিভিন্ন সময় ছোট ছোট বাক্যে তাদের মনের অবস্থা প্রকাশ করে থাকে। আমাদের সংস্কৃতিতেও এমনটি আছে। যেমন : খাবার শুরুতে তারা সমস্বরে বলে ওঠে, ‘ইতাদাকিমাছ’, মানে (স্রষ্টার দেওয়া খাবার) গ্রহণ করছি। আমাদেরও বলার কথা বিসমিল্লাহ; অথচ আমরা ভুলে যাই। কারো কাছ থেকে কোনো অনুগ্রহ পেলে তারা সশব্দে বলে ওঠে, ‘আরিগাতো গোজাইমাছ’, মানে আপনাকে ধন্যবাদ। আমাদেরও এমন পরিস্থিতিতে বলার কথা ‘শুকরিয়া’; অথচ আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে প্রায়ই কার্পণ্য করে থাকি।
জাপানিদের দেশপ্রেম অনন্য। দেশের জন্য জীবন দিতে তারা কখনো কার্পণ্য করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো যুদ্ধে জাপান হারেনি। তাদের জনসংখ্যা আমাদের মোটামুটি কাছাকাছি। অথচ পড়াশোনা থেকে খেলাধুলা কোনো জায়গাতেই তাদের সাফল্যের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না। জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বমানের, গবেষণাগার বিশ্বমানের, এই পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন প্রায় ৩০ জন। আমাদের মাত্র একজন। কাজেই ধরে নেওয়া যায় আমাদের নোবেল কোনো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার ফসল নয়, একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। অলিম্পিকে জাপান পদক জিতেছে প্রায় ৬০০টি। আমাদের নেই একটিও। আমাদের কোনো কিছুতেই যেন মনোযোগ নেই। না শিক্ষায়, না খেলাধুলায়, না কাজকর্মে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, মেইজি যুগের জাপানিদের মতো আমাদের পূর্বপুরুষরা পরিকল্পিত জাতি গঠনের লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা নিতে পারেননি। এই দায়িত্ব এখন আমাদের কাঁধে এসে পড়েছে। আমাদের অবিলম্বে শিক্ষা সংস্কারে হাত দিতে হবে। আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, যেখানে সৎ, সুশৃঙ্খল ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়। জাপানিদের মতো ধর্ম-কর্মে অমনোযোগী একটি জাতি এই কাজে সফল হতে পারলে আমাদের মতো ধর্মবিশ্বাসী জাতি পারবে না, তা হতেই পারে না। আমাদের ধর্ম তো আমাদের সৎ, সুশৃঙ্খল ও দক্ষ হওয়ার শিক্ষাই দেয়।
আসলে আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা সৎ ও সুনাগরিক চাই, না বারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। আমরা দেশপ্রেমিক নাগরিক চাই, না দেশ থেকে সম্পদ পাচারকারী চাই। দেশের দুর্দিনে পথ দেখাতে পারে এমন লোক চাই, নাকি দেশের বিপদে পালিয়ে যাবে, এমন লোক চাই। জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষা সংস্কারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বুয়েট