ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কারিগরি সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। সম্প্রতি ইইউর একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ করে ৪০ লাখ ইউরোর বেশি সহায়তা প্যাকেজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই সহায়তা ভোটার শিক্ষা, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সম্ভাব্য পর্যবেক্ষক মিশনের জন্য বরাদ্দ করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার। এটি সহায়তার আবরণে হস্তক্ষেপের সুযোগ কিনা এমন আশঙ্কা করেন অনেকে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত ও দেশের নির্বাচনী স্বাধীনতা এতে ক্ষুণ্ণ হবে কি না তা বিবেচনার অবকাশ আছে।
আমরা ইইউর সহায়তা নিয়ে অনুসন্ধান এবং বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের উদাহরণ উল্লেখ করে এর সম্ভাব্য ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই।
গত ১৯ আগস্ট মঙ্গলবার ইইউর ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাথে বৈঠক করে এই সহায়তার ঘোষণা দেয়। রাষ্ট্রদূত মিলার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পথে রূপান্তরে ইইউ অংশীদার হিসেবে কাজ করছে।’ তিনি ভোটার শিক্ষা, কার্যকর পরিকল্পনা ও বিরোধ নিষ্পত্তির মতো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ সহায়তার উল্লেখ করেন। এছাড়া, আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর সম্ভাবনাও তিনি উল্লেখ করেছেন, যা অন্তর্বর্তী সরকার ও ইসির সাথে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে। ইইউর সাথে ইউরোপীয় পার্টনারশিপ ফর ডেমোক্র্যাসির বিশেষজ্ঞরাও এতে জড়িত, যারা নাগরিক পর্যবেক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছেন।
কিন্তু এই সহায়তা নিয়ে গভীর উদ্বেগের কারণ আছে। কারণ, বিদেশী শক্তির সহায়তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে। রাজনৈতিক উত্তেজনার এই সময়ে, যখন দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি উঠছে, ইইউর ভূমিকা একটি বিচারকের মতো মনে হচ্ছে, যা সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের জন্য আদৌ প্রয়োজনীয় কি না বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে বিপথে পরিচালনায় ইউএনডিপি এবং অন্যান্য ঋণদাতা গোষ্ঠীর (যাদেরকে আমরা উন্নয়ন-সহযোগী বলি) বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অগণতান্ত্রিক সরকারকেও এসব উন্নয়ন-সহযোগী নিজ স্বার্থে ও উচ্চ সুদে ঋণ দেয়ার শর্তে সমর্থন জুুগিয়েছে। তাই ইইউর কারিগরি সহায়তার উদ্দেশ্য আমাদের নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের উদাহরণ উল্লেখ করে আমরা এ সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যার নির্বাচনী প্রক্রিয়া তার নিজস্ব সংবিধান এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে। ইইউর মতো বিদেশী সংস্থার সম্পৃক্ততা এটিকে ঔপনিবেশিক যুগের হস্তক্ষেপের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাত। অতীতের সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যেতে পারে, সহায়তার শর্তগুলো নির্বাচন কমিশনকে ইইউ-পছন্দের সংস্কার গ্রহণে বাধ্য করতে পারে, যা স্থানীয় অগ্রাধিকারকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে, যেমন- আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকায়, আন্তর্জাতিক সহায়তার ফলে অযাচিত প্রভাব পড়েছে, যা স্থানীয় গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এই সহায়তা কি সত্যিই নিরপেক্ষ, নাকি এটি একটি ছদ্মবেশ যা দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে? জিম্বাবুয়েতে ২০০২ সালের নির্বাচনে ইইউর পর্যবেক্ষকদের বহিষ্কার করা হয়। সরকার বিদেশী হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে ওই পদক্ষেপ নেয়। পরে ইইউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা জিম্বাবুয়ের অর্থনীতির যথেষ্ট ক্ষতি করে।
দ্বিতীয়ত, ইইউর নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তৃত, যেমন, বাণিজ্য চুক্তি, শ্রম অধিকার ও চীনের প্রভাব মোকাবেলা। এই প্রেক্ষাপটে তাদের সহায়তা নিরপেক্ষ নাও হতে পারে। পর্যবেক্ষক মিশন ফলাফলকে ইইউর মানদণ্ডের ভিত্তিতে অযাচিত বৈধ বা অবৈধ ঘোষণা করতে পারে। একজন বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, ‘এটি সহায়তা নয়; এটি পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণের ট্রোজান হর্স।’ ইইউর ট্র্যাক রেকর্ড দেখলে বোঝা যায়, তাদের সহায়তা প্রায়ই দাতার স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় গ্রহীতার চাহিদার চেয়ে বেশি। কেনিয়ায় ২০১৭ সালের নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষকরা প্রাথমিকভাবে নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিলেও, পরে দেশের আদালত অনিয়মের কারণে ফলাফল বাতিল করে, যা ইইউর পর্যবেক্ষণের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ায়।
তৃতীয়ত, ভোটার শিক্ষা কর্মসূচি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার করতে পারে, যা স্থানীয় নাগরিক সম্পৃক্ততার পন্থাকে প্রান্তিক করে তুলতে পারে। একজন নাগরিক সমাজের কর্মী বলেন, ‘আমাদের স্বচ্ছ নির্বাচন দরকার, তবে আমাদের স্বায়ত্তশাসনের মূল্যে নয়; স্থানীয় পর্যবেক্ষকই যথেষ্ট।’
চতুর্থত, ইইউর উপস্থিতি রাজনৈতিক বিভেদ বৃদ্ধি করতে পারে। এটি ভোটারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে, যেখানে সরকারপন্থী গোষ্ঠী এটিকে সমর্থন এবং বিরোধী দল হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখবে।
আমরা সরকার ও সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, সরকার সাংবিধানিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সব ব্যয় মেটাতে বাধ্য। সাহায্য দেয়ার নামে ইইউর কোনো অন্যায় আবদার বা শর্ত যেন আমরা মেনে না নিই। সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। কমিশনকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা ঋণ দানকারী গোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থ কেন নিতে হবে?
বাংলাদেশ কোনো ভঙ্গুর দেশ নয়। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী। শুধু রাজনৈতিক হীনম্মন্যতা ও দুর্বল নেতৃত্বের কারণে আমরা অধঃপতিত হয়েছি। উন্নয়ন সহযোগীর কিঞ্চিৎ সহায়তায় কোনো দেশের নির্বাচনব্যবস্থা বা গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই, আমাদের উচিত হবে নিজস্ব মর্যাদা ও স্বকীয়তাকে সুরক্ষা দেয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার ওপর আস্থা রাখা।
লেখক : সাবেক সচিব এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক