২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ২৪০ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার করা হয়েছে। টিআইবি ও বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই বিশাল অর্থ পাচার দেশের মুদ্রা স্থিতিশীলতা, ব্যয়ক্ষমতা, শিক্ষাবিনিয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিল্পে বিনিয়োগে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে এবং গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে দেশের অর্থনীতিতে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়েছে। যদি এই টাকা দেশে ফেরত আনা যেত, তবে তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নয়ন এবং কৃষিবান্ধব অবকাঠামো, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে বিপুল অগ্রগতি সাধন করা যেত। অতএব পাচার হওয়া ওই বিপুল অর্থের পুনরুদ্ধার কেবল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয় নয়, এটি সামাজিক ন্যায্যতার ও নৈতিক দায়িত্বের বিষয়ও বটে।

বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় আয় রক্ষা ও অর্থপাচার প্রতিরোধে ন্যায়সংগত আইনি কাঠামো ও আন্তর্জাতিক সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ১৮৫ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার স্তরে সম্পত্তি বর্তমানে ফ্রিজ করেছে এবং ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের অভিযোগ রয়েছে, যার একটি অংশ ব্রিটেনে সন্ধান মিলেছে। আবার ৮৫৪ মিলিয়ন ডলারের এক ফিন্যান্সিয়াল স্ক্যাম মামলা অনেকটাই চলমান। এই অর্থ ফেরত প্রক্রিয়ায় সময়সীমা, প্রমাণ সংগ্রহ ও বিচারিক জটিলতা ছাড়াও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ‍সঠিক কর্মপন্থায় এগোলে ধাপে ধাপে টাকা ফিরে আসবে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিসি সেই ইঙ্গিত, সেই পথ ও মূলনীতি দিয়েছে।

বর্তমানে দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধিত ২০১৫ ও ২০১৯), দুর্নীতি দমন কমিশন আইন (২০০৪), বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৪৭) এবং দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ কার্যকর রয়েছে। এসব আইনের মাধ্যমে অর্থ পাচারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং তদন্ত, মামলা ও দণ্ডের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে । এ ছাড়া ‘আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪’-তেও অঘোষিত বৈদেশিক সম্পদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ২০০৭ সালে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে, যা পাচারকৃত অর্থ ফেরতের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ দেয়। এ ছাড়া বিএফআইইউ ইগমন্ট গ্রুপের সদস্য হওয়ায় ১৫০টিরও বেশি দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। যদিও কিছু দেশ যেমন ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহায়তা এমএলএটি চুক্তি থাকলেও উন্নত দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি এখনো সীমিত।

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অগ্রগতি হয়েছে, যেমন ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফআইইউ ১ হাজার ২৭৬টি সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করেছে এবং ৭৬টি বিদেশি ব্যাংকে বাংলাদেশি অ্যাকাউন্টের তথ্য সংগ্রহ করেছে । সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অ্যাকাউন্ট বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে এবং কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে টাকা পাচারের বিষয়ে তদন্ত চলছে।

সম্পদ পুনরুদ্ধারে সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়া

সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়া হলো অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি/আদালত-নির্দেশিত একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে পাচার করা টাকা পাচারকারী পুরোটা বা আংশিক ফিরিয়ে দেবে। এর ফলে তার বিরুদ্ধে বিচার হতে পারে বা হতে নাও পারে, কোনো ফাইন ধার্য হতে পারে এবং কখন, কীভাবে, কোন ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ফেরত আসবে, তা নির্ধারিত হয়। অধিকাংশ দেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরতের জন্য এমএলএটি অনুযায়ী কাজ করতে হয়। যদি এই চুক্তি না থাকে, তবে সেটেলমেন্ট আরো জটিল হয়, তখন ‘সফট ডিপলোমেসি’ বা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করা হয়। অর্থ পাচারকারী দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ফেরত আনা অর্থ বাজেটে যুক্ত হয়। মাঝে মাঝে বিশ্বব্যাংক, ইউএনওডিসি বা ওইসিডি পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে সহায়তা করে।

বাংলাদেশের পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে এখন পর্যন্ত কার্যকর সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়া খুব দুর্বল। তবে কিছু দেশ, যেমন কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই, সুইজারল্যান্ড—এই দেশগুলোর সঙ্গে এমএলএটি বা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সেটেলমেন্টের পথ খোলা থাকতে পারে। ২০২৪ সালে দুদক বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কিছু মামলায় সেটেলমেন্টের সম্ভাব্য পথ খুঁজেছে, তবে সেগুলো এখনো কার্যকর হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার যে ১০০ কোটি টাকার মতো আইনি ও প্রশাসনিক ব্যয় ধরে ১১টি মামলার জন্য পরিকল্পনা করছে, সেটি মূলত আন্তর্জাতিক লিটিগেশন ফান্ডিং মডেলের অনুসরণে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার এই ফান্ডের মাধ্যমে এক থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয়ের মামলা চালিয়ে এক থেকে দুই হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদ ফেরত আনার উচ্চাভিলাষ ব্যক্ত করা হয়েছে। যদি লিটিগেশন ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয় এবং মাত্র এক হাজার কোটি টাকা ফেরত আনা যায়, তাহলে রিটার্ন রেশিও হবে প্রায় ১০ অনুপাত ১, যা আর্থিক দক্ষতার দৃষ্টিতে যথেষ্ট ভালো। এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—বহু বছরের নিষ্ক্রিয়তা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পর সরকার এখন পাচারকৃত অর্থ ফেরতের ক্ষেত্রে সক্রিয়, সংঘবদ্ধ ও কৌশলগতভাবে একমুখী। এতে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া যায়, যেমন ব্রিটেনের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি বা এনসিএ এরই মধ্যে চলতি বছর ১৩ থেকে ১৯ জুন ১৮৫ মিলিয়ন পাউন্ডের অর্থ ও সম্পদ ফ্রিজ করার কার্যক্রম চালিয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় অনেক সময় তৃতীয় পক্ষ অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান মামলা চালানোর খরচ বহন করে এবং মামলা জিতলে সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ পায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একটি আন্তর্জাতিক ফান্ডের সঙ্গে আলোচনা চলছে, যারা এই ১১টি মামলায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।

এ পদ্ধতির সুবিধা হলো, সরকারের নিজস্ব বাজেট থেকে বিপুল অর্থ খরচ না করে বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে দ্রুত মামলা পরিচালনা করা সম্ভব। তবে এই ফান্ডিংয়ের শর্তাবলি স্বচ্ছভাবে নির্ধারণ না করলে দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রের অংশ কমে যেতে পারে। অসুবিধা হলো আইনি প্রক্রিয়া ধীরগতি হওয়া, কারণ প্রমাণ সংগ্রহ, ফ্রিজ অর্ডার ও আন্তর্জাতিক এমএলএটি দরকার, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে পতিত সরকারের লোকজন এই পদক্ষেপকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ বলছে, যা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও নেতিবাচক ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যদি সম্পদ পাচারের প্রমাণ অস্বীকার করেন এবং প্রমাণপত্র সংগ্রহ দুর্বল হয়, তাহলে সেটেলমেন্ট চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক পরিবেশ যদি প্রতিশোধপ্রবণ হয় বা মামলা নির্বাচনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বিবেচিত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আদালত বা প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগিতায় গড়িমসি করতে পারে।

বিশ্বের অনেক দেশ যেমন পাকিস্তানের রিয়াজ হুসেইন ২০১৯ সালে ব্রিটিশ এনসিএ’র সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তির আওতায় ১৯০ মিলিয়ন পাউন্ড ফেরত দিতে সম্মত হন। নাইজেরিয়ার সামরিক শাসক সানি আবাচার পরিবারের কাছ থেকে সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার ফেরত আনা হয়। মালয়েশিয়ায় এমডিবি কেলেঙ্কারির পর বিভিন্ন দেশে থেকে প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার সম্পদ জব্দ এবং পরে ফেরত আনা হয়েছে। এ ধরনের উদাহরণ বাংলাদেশকেও আশা জোগায়, যদি যথাযথ তথ্যপ্রমাণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায়।

অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে এই উদ্যোগকে একটি সরকারের সীমিত মেয়াদের পদক্ষেপ হিসেবে না দেখে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে স্থায়ী করতে হবে। দেশের উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা এবং জনগণের অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষার জন্য বিদেশে পাচার হওয়া প্রতিটি টাকার হিসাব নেওয়া এবং সম্ভব হলে তা ফেরত আনার বিকল্প নেই। এই পথ দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু সুসংগঠিত পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকলে বাংলাদেশের হারানো সম্পদ ফেরত আনা অসম্ভব নয়। বরং আজকের সাহসী পদক্ষেপ ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ উন্মোচন করতে পারে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

সূত্র, আমার দেশ