সমাজ বা জাতিকে শ্রেণিবিন্যাস করার বিজ্ঞান মূলত ঔপনিবেশিক জ্ঞানব্যবস্থার অংশ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সায়েন্স অব ক্লাসিফিকেশনের নাম করে মুসলমানদের ‘মার্শাল রেস’ বা ‘লয়ালিস্ট’ বলা হতো। তাদের মার্শাল রেস থিওরি মুসলিমদের সামাজিকভাবে বিভাজিত করেছে। সুন্নি-ওহাবি বর্গীকরণ ধর্মীয় সঙ্ঘাতকে আরো বিপজ্জনক করেছে। বর্গীকরণের মাধ্যমে তারা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য ও বিভাজননীতিকে ধারাবাহিক করেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মুসলিম সমাজকে কমই শিখিয়েছে। মুসলিম সমাজের উচিত বাইরের টেমপ্লেট ছুড়ে ফেলা, পশ্চিমা রাষ্ট্র-নীতির কৌশলগত প্রয়োজনে তৈরি শব্দ ফাঁদগুলো পরিহার করা এবং নিজের পরিচয় ও সংজ্ঞার কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেয়া। এটি সম্ভব ইসলামী সমাজ বিশ্লেষণের কাঠামো অবলম্বনে র্যান্ড করপোরেশন একটি মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক। এটি প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, সমাজ ও পররাষ্ট্রনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে সহায়তা করে। মুসলিম বিশ্ব নিয়ে তারা বেশ কয়েকটি গবেষণা করেছে।
র্যান্ড করপোরেশনের গবেষণা রিপোর্টগুলোতে মুসলিম সমাজকে সাধারণত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে : Fundamentalists (মূল্যবাদী/মূলবাদী) : এরা ইসলামের ঐতিহ্যগত, অপ্রয়োগযোগ্য ও অপরিবর্তনযোগ্যরূপে বিশ্বাস করে এবং আধুনিকতা ও পশ্চিমা গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী। Traditionalists (প্রথাগত) : এরা ধর্মীয় রীতিনীতির অনুসরণে আগ্রহী, তবে পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নয়; ধর্মীয় কর্তৃত্ব মান্য করে। Modernists (আধুনিকতাবাদী) : এরা ইসলামের উদার, যুক্তিনির্ভর ও আধুনিক ব্যাখ্যা সমর্থন করে; পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সহানুভূতিশীল। Secularists (ধর্মনিরপেক্ষ) : এরা ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক রাখতে চায় এবং পশ্চিমা আদর্শে বিশ্বাস করে। এ ধরনের বর্গায়ন শুধু ইসলামেই নয়, বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ও হয়েছিল। মডারেট কমিউনিস্ট ও রিফর্মিস্ট কমিউনিস্ট বিভাজনের মাধ্যমে কমিউনিস্টদের মধ্যে তৈরি করা হয় দ্বন্দ্ব, সংশয় ও বিতণ্ডা। মুসলিম বিশ্ব নিয়ে র্যান্ড করপোরেশনের এই শ্রেণিবিন্যাস ওয়েস্টার্ন রাজনীতির প্রয়োজন পূরণ করে এবং মডারেট মুসলিম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরামর্শ দেয়। র্যান্ডের এই বর্গায়ন গভীর খেলার অংশ। এটি মুসলিম সমাজ ও জীবনে কৌশলগত হস্তক্ষেপ, যা মুসলিম সমাজকে ভেতর থেকে বিভক্ত ও দুর্বল করতে চায়। এই বর্গায়ন ওরিয়েন্টালিস্টিক ও কলোনিয়াল মাইন্ডসেটের প্রতিফলন, যেখানে মুসলিমদের ব্যাখ্যা বা শ্রেণিবিন্যাস করা হচ্ছে পশ্চিমা রাজনৈতিক প্রয়োজনে। এই বর্গায়ন ইসলামী নৈতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের উপর ভয়াবহ বহিরাগত চাপ, যেখানে ইসলামকে একটি পলিটিক্যাল কন্ট্রোল সিস্টেম হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইসলামের আত্মিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ঐতিহ্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে তাওহিদ-ভিত্তিক ঐক্যকে। কারণ ইসলামে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তাওহিদ একটি অবিচ্ছেদ্য বিশ্বাস। র্যান্ডের প্রকল্প এই ঐক্যকে খণ্ডিত করতে চায়। মুসলিম সমাজে ideological fragmentation ঘটিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকে সহজ করতে চায় এবং তা বড় অর্থে ঘটছেও। ইসলামী দার্শনিক ঐতিহ্যে সংস্কার বা তাজদিদ সর্বদা আত্মজ মুক্তি ও নৈতিক পরিশুদ্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত, যা মুসলিম সমাজের নানা প্রবণতা ও অংশ নিয়ে কাজ করে। কিন্তু র্যান্ড গোটা ব্যাপারটিকে রাজনৈতিক ও জিওস্ট্র্যাটেজিক অস্ত্রে পরিণত করল। পশ্চিমা থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর রাজনৈতিক বয়ানে মুসলিম শব্দটি প্রায়ই অর্থ ও অভিধা বদলে ফেলে। এখানে মুসলিম পরিচিতি ‘উগ্র’ অথবা ‘সহযোগী’ এ দু’টি মাত্রায় পড়ে। এর মানে হলো মুসলিমরা কেবল গ্রহণযোগ্য অথবা নির্মূলযোগ্য এই দুই চূড়ান্ত বিভাজন। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেন এক ধরনের পূর্বস্থির কল্পনা, যার প্রকৃত লক্ষ্য হলো মুসলমানদের ভবিষ্যৎ চিন্তার জিনোম বা ভাবনার মৌল কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করা। র্যান্ড করপোরেশনের এই বর্গায়ন একটি বৌদ্ধিক ভূরাজনীতি (Intellectual Geopolitics), যা মুসলিম সমাজে জ্ঞানতাত্ত্বিক পরাধীনতা সৃষ্টি করতে চায়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এটি শুধু বিভক্তির কৌশল নয়; বরং আত্মচিন্তা ও আত্মমর্যাদার বিরুদ্ধে এক প্রকার নীরব উপনিবেশবাদ। র্যান্ডের ‘মডারেট মুসলিম’ হয়ে উঠেছে একটি আত্ম-পরিত্যাগের ফর্মুলা। তথাকথিত মডারেট অংশকে প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন ও তাদের পক্ষে ন্যারেটিভ গঠনের মাধ্যমে একে প্রক্সি আইডেন্টিটিতে পরিণত করা হয়েছে। ‘মডারেট’ শব্দটি একটি মানসিক জেলখানা, যেখানে মুসলমানকে তার নিজস্ব পরিপূর্ণতা ভুলে যেতে শেখানো হয়। প্রকৃত অর্থে এটি এক প্রকার ‘মনোবিশ্বাসঘাতকতা। সুফি, সালাফি, আহলুস সুন্নাহ সবাইকে আলাদা গেট বানিয়ে র্যান্ড সেই গেটে ‘পছন্দনীয়’ ও ‘অপছন্দনীয়’ ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে। তারা মুসলিমদের শরীরকে স্বাধীনতা দিতে চায়, যেন আত্মা তাদের অধীনে থাকে। র্যান্ডের মডেল দাবি করে, ধর্মনিরপেক্ষতা একটি সর্বজনীন ও নিরপেক্ষ কাঠামো এবং ‘মডারেট ইসলাম’ বলতে এমন ইসলাম বোঝায় যা সেক্যুলার কাঠামোর সাথে একাত্ম। কিন্তু সেক্যুলারিজম আসলে একটি রাজনৈতিক ও ইতিহাসগত নির্মাণ, যা নিরপেক্ষ নয়; বরং ক্ষমতার বাস্তবায়ন। আর সেই ক্ষমতা কাজ করে পশ্চিমা চিন্তা, মনোভঙ্গি ও রাজনীতির একচ্ছত্রতা তৈরিতে। ‘মডারেট মুসলিম’ সেই মুসলিম, যার ধর্মীয় অবস্থান রাষ্ট্র-সমর্থিত সেক্যুলার কাঠামোর সেবায় নিয়োজিত। মডারেট হওয়া মানে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির শিথিলতা, আর রাজনীতি ও তাওহিদের প্রশ্নে আত্মসমর্পণ। যারা মুসলিম মনকে এভাবে গঠনের চেষ্টা করছে, তারা ইসলামকে ‘স্নায়ুশূন্য, প্রতিবাদহীন ও আত্মসমর্পণকারী’ ধর্ম বানাতে চায়। র্যান্ডের কৌশল কথিত মডারেট ধারার মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজে এমন শ্রেণী করতে চায়, যারা নিজেদের ঐতিহ্যিক প্রাণশক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন। যারা রাজনীতি, জিহাদ, শরিয়াহ বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামের ভূমিকা অবজ্ঞা করে। অন্যদিকে র্যান্ডের মডারেট তত্ত্ব মুসলিম সমাজে প্রায়ই বিচারহীন সাধারণীকরণের কবলে পড়ে। মডারেট মুসলিম-তত্ত্বের বিরোধীরাও মডারেট আখ্যার শিকার হন। যারা নিজেদের ফান্ডামেন্টালিস্ট বলেন, তারা ধরে নেন প্রকৃত ইসলাম তারাই অনুশীলন করছেন। কারণ আমেরিকা তাদেরকে পছন্দ করে না। তারা প্রায়ই নিজেদের সাথে ভিন্নমতকারী ক্ষেত্রগুলোতে হরেদরে মডারেট পরিভাষার প্রয়োগ করেন। ব্যক্তি ও চিন্তার জটিল বাস্তবতা অনেক সময় অতিসরলীকৃত হয়। পাঠক ভিন্নমতের হলেও সেখানে কোনো সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার সুযোগ পান না। র্যান্ড রিপোর্ট ইসলামকে যে অর্থে ব্যাখ্যা করে, তাতে শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র-ধারণা অনুপস্থিত। সে তার মডারেট প্রকল্পের মাধ্যমে সবচেয়ে বিপদে ফেলে মুসলিম সমাজের ওয়াসাতিয়া বা মধ্যপন্থাকে। কারণ মধ্যপন্থাকে আমেরিকার পছন্দের প্রকল্প হিসেবে প্রচার করে র্যান্ড। এর সাথে যুক্ত করে এমন সব বৈশিষ্ট্য, যা আরোপিত। ইসলামের মধ্যপন্থা আল্লাহ নির্ধারিত; এটি পশ্চিমা ব্যুরোক্রেসির মানদণ্ডে নির্ধারিত হতে পারে না। মুসলিমদেরকে অবশ্যই মধ্যপন্থী হতে হবে এবং তা ইসলামের মানদণ্ডে। র্যান্ড এই মানদণ্ডকে নাই করে দিতে চায়। তার বর্গায়ন মুসলিম রাজনৈতিক ঐক্য ও আত্মনির্ধারণের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে চায় এবং এক ধরনের cognitive imperialism বা চিন্তাগত সাম্র্রাজ্যবাদ তৈরি করে, যেখানে মুসলমানরা পরস্পরকে সংজ্ঞায়িত করবে আমেরিকার বাতলানো তরিকায়। তারা পরস্পরকে আক্রমণ করবে, চিত্রিত করবে এবং মুসলিম হওয়া-না হওয়ার মাত্রা পরিমাপ করবে। র্যান্ড প্রথাগত সুফিবাদের প্রশংসা করে তার সর্বনাশ করতে চায়। মুসলিমদের ভেতরে উসকে দিতে চায় গুরুতর দ্বন্দ্ব- যাতে সুফি ও সালাফি একে অপরের চরম শত্রুতে পরিণত হয়। র্যান্ড সুফিবাদকে জীবন থেকে পালাবার পথ হিসেবে দেখায়। কিন্তু প্রকৃত সুফিবাদ হচ্ছে ইসলাহ (পরিশুদ্ধি) ও আখলাক (চরিত্র মহিমা)। র্যান্ড চায় সুফিবাদ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হোক; কেবল ‘সহনশীল’ মুসলিম তৈরির জন্য। কিন্তু এমনটি হলে সেটি তাসাউফ থাকবে না, কারণ সেখানে ‘তাজকিয়াহ’ নেই; বরং আছে আত্মবিস্মৃতি। র্যান্ড ইসলাহ, তাসাউফ, তাজকিয়াহ, ইখলাসের মতো ইসলামের সংশোধনী প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করেছে এবং দার্শনিকভাবে একটি শূন্যতাবাদী কৌশল গ্রহণ করেছে। ফলে রিপোর্টটি ইসলামী সংস্কারকে যেভাবে কাঠামোবদ্ধ করে, তাতে মনে হয় ধর্মের প্রয়োজন শুধু ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার উপকরণ হিসেবে। যে স্থিতিশীলতা কাজ করবে পশ্চিমের অনুকূলে। র্যান্ড করপোরেশন যেসব প্রবণতার উল্লেখ করে মুসলিমদের একটি অংশকে ট্র্যাডিশনালিস্ট বা মডার্নিস্ট বলল, সেসব প্রবণতা মুসলিম জীবন ব্যবস্থার ধারাবাহিক অনুশীলনে গভীর ধস ও ভাঙনের বার্তা দিচ্ছে। মুসলিম উম্মাহর নানা অংশকে মূল্যায়নের মানদণ্ড ইসলাম নিজেই দিয়েছে। কোনো প্রবণতার মূল্যমান ও বাস্তবতা কী, তা ব্যাখ্যা করেছে উসুলে দ্বীন (তথা ধর্মের মূলনীতি) উসুলে ফিকহ (আইনমূল) ইত্যাদি। র্যান্ড করপোরেশনের ব্যাখ্যা আপনাকে এমন একটি চশমা দেয়, যেটি চোখে নিলে আপনি ইসলামী তুরাসের ধার না ধেরেই চার পাশের মুসলিমদের বিচার করতে পারেন। র্যান্ড মুসলিমদের নানা অংশকে বিভাজন করে আমেরিকার নিরাপত্তা নীতির আলোকে। এমনটি চাইলে রাশিয়াও করতে পারে, চীনও করতে পারে। করতে পারে ভারতও। আমরা এমনতর বিভাজনের অনুমতি দেবো না। কারণ এর মাধ্যমে বিভাজনকারীরা ধর্মীয় পরিচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণে একটি সার্বভৌম দাবি করে। এই সব বিভাজন আরো ভয়াবহ হয় তখন, যখন মুসলিমরা এই বিভাজনের সাপেক্ষে নিজেদের দেখতে, ভাগ করতে ও রায় দিতে শুরু করে। এর মাধ্যমে তারা আমেরিকার তরফে মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচয় নির্ধারণের ‘কর্তৃত্বের’ প্রতি সম্মতি জানান! ভাবুন তো, অনেকগুলো পরাশক্তি এভাবে মুসলিমদের বর্গীকরণ করল, কিছু আলামতের ভিত্তিতে। আর মুসলিমরা তাদের রিপোর্ট হাতে নিয়ে অন্য মুসলিমদের মধ্যে আলামত খুঁজে খুঁজে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রায় দিচ্ছে! এটি কেবল সম্ভব এমন সমাজে, যেখানে দেউলিয়াত্ব সীমা ছাড়িয়েছে এবং জ্ঞান ও আত্মসচেতনতার সর্বনাশ হয়ে গেছে! র্যান্ডের মতো বর্গায়ন প্রকল্প একটি বায়োপলিটিক্যাল কৌশল, যেখানে ধর্মীয় পরিচয়কে ‘ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার’ ভাষায় রূপান্তর করা হয়। এতে সাড়াদানের মধ্য দিয়ে মুসলিমরা নিজের ইতিহাস, দর্শন ও তুরাস বা ট্র্যাডিশন ভুলে, পশ্চিমের ভাষা ও চিন্তার কাঠামো দিয়ে নিজেদের ব্যবচ্ছেদ করে। সাম্প্রতিক মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজের বড় অংশ যে আত্মপরিচয়ের অনুশীলনের বদলে আত্মপ্রতিক্রিয়ায় আটকে আছে, এর মাত্রা র্যান্ড আরো বাড়িয়ে দেয়। এতে সাড়াদানের স্রোত দেখে বোঝা যায়, আমাদের বৃহত্তর অংশ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বন্ধ্যা হয়ে পড়েছে। এটি সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিক শক্তির সামর্থ্যরে গভীরতা প্রমাণ করে। কারণ তাদের আসল শক্তি বোমারু বিমানে নয়; বরং তা নিহিত উপনিবেশিত বা টার্গেট জনগোষ্ঠীর আত্মা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত ও চালিত করার ক্ষমতায়। র্যান্ডের শ্রেণিবিন্যাস দাবি করে, কিছু মুসলিম ‘ভদ্র’, ‘সহনশীল’ এবং রাজনীতির বাইরে এবং কিছু ‘চরমপন্থী’, ‘হুমকিস্বরূপ’। এই বর্ণনা কৌশলের মাধ্যমে চরমপন্থী বলে চিত্রিত অংশের প্রতি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও নিপীড়নকে আমন্ত্রণ করা হয় এবং বৈধতা উৎপাদনের ভাষাতাত্ত্বিক কৌশল কাজে লাগানো হয়। র্যান্ড মুসলিমদের শ্রেণিবিন্যাস করে বাহ্যিক চিহ্নের ভিত্তিতে। অথচ ইসলামে বাহ্যিক চিহ্নের ভিত্তিতে এভাবে সরলীকরণের সুযোগ নেই। ইসলামের কাছে বাহ্যিক চিহ্ন একমাত্র অনুষঙ্গ নয়; বরং তা নানা পরিস্থিতি, শর্ত এবং আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাস্তবতার সাথে যুক্ত। এমনতর বর্গায়নে অন্তর্নিহিত বাস্তবতা ও গুণাবলির অস্বীকৃতি ঘটে। বাহ্যিক আলামতের কিছু ফর্মেটে ভর করে মানুষকে বিচার করা হলে তাদের ঈমান, চরিত্র, জ্ঞান, নৈতিকতা, ইচ্ছার গভীরতা-অগভীরতা এবং পরিস্থিতিগত বাস্তবতা অগ্রাহ্য হয়। এতে যথেচ্ছ অপচর্চার সুযোগ তৈরি হয় এবং সবচেয়ে বেশি অপদস্ত হয় আদল বা ইনসাফ। অথচ আদলই মানুষের ঈমান ও আমল বিচারের চিফ জাস্টিস, যাকে পথ দেখায় ইসলামের উসুল বা মূলনীতিগুলো। র্যান্ড চায় রাষ্ট্র-সহায়ক মুসলিম কিন্তু ইসলামে রাষ্ট্রের সাথে সহায়তা-অসহযোগিতার নিজস্ব মানদণ্ড আছে। ইসলাম চায় আত্ম-সচেতন মুসলিম। র্যান্ডের গুড মুসলিম ব্যাড মুসলিম নিছক পশ্চিমা কল্পনার ফল। ইসলামের কাছে মুসলিম হওয়া মানেই ঈমান-আমলের অনুশীলনে নির্দিষ্ট কালচারাল ও সিভিলাইজেশনাল উত্তরাধিকার বহন। র্যান্ড করপোরেশন মুসলিম সমাজে ‘আইডিওলজিকাল ফ্র্যাগমেন্টেশন’ ঘটিয়ে মুসলিম সমাজকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, আত্মপরিচয়ে বিভ্রান্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আরো বেশি পরনির্ভরশীল করে তুলছে। মুসলিমদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, শব্দের মাধ্যমে চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হয়। পশ্চিমের Linguistic Conditioning ‘মডারেট’ বা ‘এক্সট্রিমিস্ট’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে মুসলিমদের আত্মোপলব্ধি নির্ধারণ করছে। তারা শ্রেণিবিন্যাস করছে, এর মধ্যে আছে প্রিস্ক্রিপটিভ অ্যাজেন্ডা। কারণ শ্রেণিবিন্যাস কেবল বর্ণনামূলক নয়; বরং কীভাবে সমাজকে পরিচালনা করতে হবে, তারও দিকনির্দেশনা। সমাজ বা জাতিকে শ্রেণিবিন্যাস করার বিজ্ঞান মূলত ঔপনিবেশিক জ্ঞানব্যবস্থার অংশ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সায়েন্স অব ক্লাসিফিকেশনের নাম করে মুসলমানদের ‘মার্শাল রেস’ বা ‘লয়ালিস্ট’ বলা হতো। তাদের মার্শাল রেস থিওরি মুসলিমদের সামাজিকভাবে বিভাজিত করেছে। সুন্নি-ওহাবি বর্গীকরণ ধর্মীয় সঙ্ঘাতকে আরো বিপজ্জনক করেছে। বর্গীকরণের মাধ্যমে তারা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য ও বিভাজননীতিকে ধারাবাহিক করেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মুসলিম সমাজকে কমই শিখিয়েছে। মুসলিম সমাজের উচিত বাইরের টেমপ্লেট ছুড়ে ফেলা, পশ্চিমা রাষ্ট্র-নীতির কৌশলগত প্রয়োজনে তৈরি শব্দ ফাঁদগুলো পরিহার করা এবং নিজের পরিচয় ও সংজ্ঞার কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেয়া। এটি সম্ভব ইসলামী সমাজ বিশ্লেষণের কাঠামো অবলম্বনে। লেখক :
কবি, গবেষক [email protected]