এই আক্রমণের পেছনে রয়েছে ‘সল্ট টাইফুন’ নামের চীনা রাষ্ট্রীয় সমর্থিত একটি হ্যাকিং গ্রুপ। এবং এরা যে দুর্বলতাগুলো কাজে লাগিয়েছে, সেগুলোর এখনও কোন সমাধান হয়নি।
প্রাচীন গ্রীসের মহাকাব্যিক যুদ্ধ, ট্রয়ের যুদ্ধের অন্যতম বিখ্যাত ঘটনা হলো ‘ট্রয়ের ঘোড়া’। এই কাহিনীর মূল কথা হলো প্রতারণা আর প্রযুক্তির যুগল প্রয়োগে শত্রুর অভ্যন্তরে ঢুকে পড়া।
গ্রিকদের সঙ্গে দীর্ঘ দশ বছরের যুদ্ধের পর ট্রয়ের শহর কিছুতেই দখল করা যাচ্ছিল না। অবশেষে ওডিসিউস নামের এক বুদ্ধিমান গ্রিক বীর পরিকল্পনা করলেন এক অভিনব ছলনার। গ্রিকরা যুদ্ধের ভান করে পিছিয়ে গেলো এবং উপহারস্বরূপ এক বিশাল কাঠের ঘোড়া রেখে গেলো ট্রয়ের বাইরে। ট্রয়ের বাসিন্দারা ভাবলো—এ এক বিজয়ের স্মারক! তারা ঘোড়াটিকে শহরে নিয়ে এল এবং উৎসবে মেতে উঠল। কিন্তু রাতে সেই ঘোড়ার পেট থেকে বেরিয়ে এলো গ্রীক সেনারা, যারা সেখানে গোপনে লুকিয়ে ছিল। তারা শহরের ফটক খুলে দেয়, বাইরে অপেক্ষমাণ সৈন্যরা ঢুকে পড়ে এবং ধ্বংস করে দেয় ট্রয়।
এই গল্প প্রাচীন হলেও, এর শিক্ষা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। আধুনিক যুগেও, শত্রুরা প্রযুক্তির ট্রয়ের ঘোড়া ব্যবহার করে আমাদের ঘরের ভিতরে প্রবেশ করছে। এ থেকে নিরাপদ নয় খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্তত তাই মনে করছেন দ্য আটলান্টিক সাময়িকীর লেখক থমাস রাইট। থমাস রাইট যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের জ্যেষ্ঠ গবেষক এবং বাইডেন প্রশাসনের সময় তিনি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে কৌশলগত পরিকল্পনার জ্যেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গত বছর শরৎকাল থেকে থমাস রাইট মোবাইল ফোনের ব্যবহার পাল্টে ফেলেন। সাধারণ কল এবং টেক্সট বার্তা ব্যবহার বন্ধ করে সিগনাল নামক এক এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার শুরু করেন। হয়তো মনের ভয় বা সন্দেহে ভুগছিলেন না —কিন্তু আমি তেমনটা মনে করেন না। বরং তিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে কাজ করার সময় তাঁকে জানান হয়েছিল যে চীনা সরকার ইতিমধ্যেই বড় বড় সব মার্কিন টেলিযোগাযোগ কোম্পানির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তাদের নেটওয়ার্কে গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি অঞ্চলের এক মিলিয়নেরও বেশি আমেরিকান নাগরিকের ওপর নজরদারি চালানো হয়েছে। চীনের হাতে রয়েছে ফোন কল শোনা এবং টেক্সট মেসেজ পড়ার ক্ষমতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আক্রমণের পেছনে রয়েছে ‘সল্ট টাইফুন’ নামের চীনা রাষ্ট্রীয় সমর্থিত একটি হ্যাকিং গ্রুপ। এবং এরা যে দুর্বলতাগুলো কাজে লাগিয়েছে, সেগুলোর এখনও কোন সমাধান হয়নি। চীন এখনও সেখানে রয়েছে, ভেতরে, মার্কিন নেটওয়ার্কের 'ভেতরে গভীরে', দাবি করা হচ্ছে।
শুধু টেলিযোগাযোগ নয়, আরও বহু খাতে ও আমেরিকানদের বিপুল তথ্য চীন সংগ্রহ করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। স্বাস্থ্যবীমা সংস্থা, হোটেল চেইন, এমনকি সরকারি কর্মীদের নিরাপত্তা যাচাইয়ের ডেটাবেজ পর্যন্ত চীন হ্যাক করেছে।
অনেকেই বলতে পারেন, “সব দেশই তো গুপ্তচরবৃত্তি করে, এতে নতুন কী?” কিন্তু ইউক্রেন এবং ইসরাইলের কয়েকটি আকস্মিক এবং অবিশ্বাস্য সফল অপারেশন দেখিয়ে দিয়েছে, এই ধরনের ‘ভিতরে ঢুকে পড়া’ আসলে কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
ইউক্রেনের ‘স্পাইডারওয়েব’ অভিযানে, তারা ট্রাক চালকদের অজান্তেই ড্রোন ভরে রাশিয়ার গভীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে একসাথে চারটি রুশ সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করেছে এবং রাশিয়ার পারমাণবিক ত্রয়ীর অংশ স্ট্র্যাটেজিক বোমার গুদাম ধ্বংস করেছে।
ইসরায়েল ‘হিজবুল্লাহ’-র বৈশ্বিক যোগাযোগ চেইন ধ্বংস করতে হাঙ্গেরিতে সত্যিকারের পেজার কোম্পানি খুলে তাদের ডিভাইসে ফাঁদ বসিয়েছে, যা একসঙ্গে বহু নেতা হত্যা বা পঙ্গু করেছে।
সম্প্রতি, ‘রাইজিং লায়ন’ নামের এক অভিযানে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং শীর্ষ সামরিক নেতাদের একসঙ্গে হত্যা করা হয়েছে। এই অভিযানের মূল চাবিকাঠি ছিল ইরানের ভেতরেই গোপনে নির্মিত একটি ড্রোন ঘাঁটিতে, দাবি ইসরাইলের।
এই সব ঘটনা এক ভয়াবহ সত্য উদ্ঘাটন করে—যে রাষ্ট্র সাহসী, সৃজনশীল, এবং কৌশলী, সে আজকের প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে পারে। আর আমেরিকার শত্রুরাও এই একই বৈশিষ্ট্য রাখে।
ভাবুন তো, যদি আমেরিকা ও চীনের মধ্যে তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধ বেঁধে যায়?
‘ভোল্ট টাইফুন’ নামের আরেকটি চীনা গ্রুপ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলার ছক আঁকছে—যদি কখনো যুদ্ধ বেঁধে যায়। ২০২৪ সালে সাইবার ও অবকাঠামো নিরাপত্তা সংস্থার বা সিআইএসএ প্রধান জেন ইস্টারলি জানিয়েছিলেন, চীন পরিকল্পনা করছে বড় ধরনের সাইবার হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়া, পানির সরবরাহ দূষিত করা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং পরিবহন ব্যবস্থা বিকল করে দেওয়ার।
এই হুমকির প্রেক্ষিতে বাইডেন প্রশাসন কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল। সে সময় মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি বন্ধ। এমনকি টিকটক নিষিদ্ধ করার বিলেও স্বাক্ষর করেছিলেন বাইডেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়েছেন, ফলে টিকটক এখনো চলছে।
তবে বড় প্রশ্ন হলো—যেসব প্রযুক্তির, যেমন রোবট, ড্রোন, ক্লাউড কম্পিউটিং, মাধ্যমে সবকিছুই ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত, সেই ‘ইন্টারনেট অফ থিংস’ যুগে কোন পর্যায়ে এসে আমাদের 'না' বলতে হবে?
চীন একমাত্র সমস্যা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বার্ষিক হুমকি মূল্যায়নে বলা হয়েছে, রাশিয়া এমন একটি ডিভাইস তৈরি করছে যা মহাকাশে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। এর ফলে পৃথিবীর কৃত্রিম উপগ্রহগুলো বিকল হয়ে যাবে, এবং যোগাযোগ, কৃষি, আবহাওয়া পূর্বাভাস, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তাও বিপন্ন হবে।
এর পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের ভিতরেও ড্রোন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নেতৃত্ব নানা পরতে পরতে আক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। ইসরায়েলের কৌশল অনুসরণ করে আমেরিকার শত্রুরা হয়তো হোয়াইট হাউস বা পেন্টাগন লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পারে। এমনকি সমুদ্রের তলদেশে থাকা ইন্টারনেট ক্যাবলও কেটে দিতে পারে। গত বছর, রাশিয়া ও চীনের সাথে যুক্ত জাহাজ ইউরোপে কয়েকবার ক্যাবল কেটে দিয়েছে ‘ঘটনাক্রমে’ বলে দাবি করা হলেও ব্যাপারটি ছিল সন্দেহজনক।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সক্ষমতা রাষ্ট্রীয় শক্তির মতো না হলেও, নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে তারাও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। মুস্তাফা সুলেমান এবং মাইকেল ভাসকার তাঁদের বই দ্য কামিং ওয়েব *-এ উল্লেখ করেছেন—সন্ত্রাসীরা মুখ চিনে গুলি চালানো ড্রোন দিয়ে বহু শহরে হামলা চালাতে পারে, কিংবা একটিমাত্র ড্রোন দিয়ে জনসমাবেশে প্রাণঘাতী জীবাণু ছড়াতে পারে।
এমন বাস্তবতায়, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির হাতে রয়েছে। এ সব প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা জোরদারে ব্যয় করতে আগ্রহী নয়। এই অবকাঠামোকে রক্ষা করতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু যেখানে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসন আইন বাস্তবায়নের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ১৫০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে সাইবার নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন ‘সিআইএসএ’র বাজেট ৪৯৫ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশ কমিয়েছে—যা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
ড্রোন মোকাবেলায়ও আইনগত পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে। সিনেটর র্যান্ড পল এর বিরোধিতা করেছেন ‘অতিরিক্ত নজরদারির ভয়’ দেখিয়ে—যদিও প্রস্তাবিত আইনে তেমন কিছু ছিল না।
ইউক্রেন থেকে ড্রোন প্রতিরোধ এবং ব্যবহারের কৌশল শিখতে পারত আমেরিকা। কিন্তু আগ্রহ দেখানো হয়নি। এর পরিবর্তে, বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—যা শুধু উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে ব্যবহৃত হবে, ড্রোন প্রতিরোধে নয়।
আরও উদ্বেগজনক হলো—নিরাপত্তা বিশ্লেষণের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না, কোন অবকাঠামো সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা দরকার? বিমান কোথায় রাখা উচিত—আকাশে না কি বাংকারে? যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা ড্রোন প্রতিরোধ ঘাঁটি কোথায় গড়ে তোলা উচিত?
৯/১১-র পরে যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে এক বিশাল নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলে। ট্রাম্প প্রশাসন এখন তা ব্যবহার করছে সীমান্ত ও অভিবাসন দমন করতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—আজকের সবচেয়ে বড় হুমকি সন্ত্রাস নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তি-ভিত্তিক আগ্রাসন। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর উচিত হবে কৃষিক্ষেতের শ্রমিক আর রেস্তোরাঁর ওয়েটারদের পেছনে না ছুটে, সাইবার যুদ্ধের বাস্তবতায় প্রস্তুতি নেওয়া।
ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলো আমেরিকাকে এক ঝলক দেখিয়েছে ভবিষ্যতের যুদ্ধ কেমন হতে পারে—এবং তা এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা।
এখনও সময় আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। শুধু আমেরিকা নয় অন্যান্য দেশ যাদের বদ প্রতিবেশী রয়েছে বিশেষ করে তাদেরও সতর্ক হওয়া দরকার, নয়তো ট্রয়ের ঘোড়া একদিন তাদের সবার ঘরের ভেতরই ঢুকে যাবে।
সূত্র: দ্যা আটলান্টিক।