নিউ ইয়র্ক শহরে একটি ভূত তাড়া করে ফিরছে। জোহরান মামদানির ভূত। তিনি আসন্ন মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের পদপ্রার্থী। ভূতটিকে তাড়াতেই হবে। তাই পুঁজিবাদী ডাকাত, সামরিক ফ্যাসিবাদী আর গণহত্যার দোসর জায়োনিস্টরা মিলে একটা জোট গঠন করেছে।

জোটের প্রিয় পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস মামদানির পেছনে লেগেই আছে। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাবেক কিছু ডেমোক্র্যাট নেতা। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র এন্ড্রু কুমো দুজনেই ডেমোক্র‍্যাট নেতা। দুজনই নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে অভিযুক্ত। তারা খুব চেষ্টা করেছিলেন যাতে মামদানি প্রার্থী হতে না পারেন। কিন্তু সফল হননি। বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান হওয়া সত্ত্বেও ডেমোক্র‍্যাটদের অভ্যন্তরীণ খেলা নিয়ে মাথা ঘামান। কারণ মামদানি তারও চক্ষুশূল।

এদিকে নিউকনজারভেটিভ, ‘মাগা’ রিপাবলিকান এবং নিউ ইয়র্কের কংগ্রেসম্যান হাকিম জেফরিজের মতো প্রতিক্রিয়াশীল লিবারেলগুলো মিলে জোট বেঁধেছে। অর্থাৎ রিপাবলিকানরা একজোট হয়েছেন নৈতিকভাবে দেউলিয়াত্বে ভুগতে থাকা ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে। পরিচিত ইসলামবিদ্বেষীগুলো দলে দলে এতে যোগ দিচ্ছে, বর্ণবাদীগুলো হাইহিল আর কোট-টাই পরে এই জোটে ভিড় করছে।

ফেনীর বন্যা, মিটফোর্ডের নৃশংসতা, দায় ও দায়িত্বফেনীর বন্যা, মিটফোর্ডের নৃশংসতা, দায় ও দায়িত্ব

যারা মামদানির বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন, তারা পরস্পরের পরিচিত। এরিক এডামস আর কুমোর মতো দুর্নীতিবাজ নেতারা রাজনীতিকে কলুষিত করে রেখেছেন। বহুদিন ধরেই তারা দেশ-বিদেশে নিজেদের গড়ে তোলা সাম্রাজ্যের দেখভাল করছেন। তাদের বিরোধিতা শুধু ব্যক্তি মামদানির কারণে নয়। বরং মামদানি যে ধরনের রাজনীতি করতে চাচ্ছে, সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে।

যেসব কাঠামোর মধ্য দিয়ে বর্ণবাদ আর অর্থনৈতিক আধিপত্য টিকে আছে মামদানিরা, সেগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান না। অন্যদিকে লিবারেলরা এসব ব্যাপার এড়িয়ে যেতে চান। লাখ লাখ নিউ ইয়র্কার মামদানির পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছেন। তাদের আশা, মামদানি এ শহরের পরবর্তী মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবেন।

মামদানি তার প্রাথমিক বিজয়ের মাধ্যমে ডেমোক্রেটিক দলের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীটিকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে কেন ডেমোক্র‍্যাটরা ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।

তথাকথিত ‘প্রজ্ঞাবান’ ডেমোক্র্যাট নীতিনির্ধারক জেমস কারভিল বলেছিলেন, ‘আমাদের পক্ষে জোরালো কোনো কণ্ঠস্বর নেই, সরকারের কোনো অংশও আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এমতাবস্থায় আমাদের দলের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃসাহসিক রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করা উচিত।

একই মানসিকতার কারণে গত আগস্টে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের অভিষেক অনুষ্ঠানে একজন ফিলিস্তিনিকেও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। কারণ নেতারা তাদের পাশে বসা গণহত্যাকারী জায়োনিস্টদের ভয়ে ভীত হয়ে ছিলেন। ফিলিস্তিনিদের কথা বলতে দিলে পাছে জায়োনিস্টরা রাগ করে।

তাই যখন গাজার নিহতদের নাম উচ্চারণ করা হচ্ছিল, তখন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা কানে আঙুল দিয়ে বসেছিলেন। যখন হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হচ্ছিল, কমলা হ্যারিস তখন গণহত্যার পক্ষে স্লোগান তুলেছিলেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ‘ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।’ তখন কল্পনাতেও আসেনি, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন রাজনীতির জাতীয় প্রতীক হয়ে উঠবেন জোহরান মামদানি।

সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে পিটার বেইনার্ট ডেমোক্র্যাটদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘ইসরাইল সম্পর্কে মতামত দ্রুত বদলে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামদানির বিজয় কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটি ভবিষ্যতের পূর্বাভাস।’

জোহরান মামদানিকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই করতে হচ্ছে। এই শক্তিগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে প্রোপাগান্ডা চালাতে সিদ্ধহস্ত জায়োনিস্টরা। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো তথাকথিত এই ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া জায়ান্টগুলোর তুলনা চলতে পারে শুধু প্রাচীনকালের নিয়ান্ডারথাল মানুষের সঙ্গে। এসব মিডিয়া অতি প্রাচীন, বাস্তবতা-বিবর্জিত এবং অকার্যকর। এগুলো এখন বড়জোর নৃ-তাত্ত্বিক কৌতূহলের বিষয় হতে পারে।

টাইমস মামদানির বিরুদ্ধে প্রথমে একটি বিদ্বেষপূর্ণ সম্পাদকীয় ছাপল। দেখলে মনে হবে এটা কোনো সম্পাদকীয় নয়, বিজ্ঞাপন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মামদানি যে এজেন্ডা নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন, তার সঙ্গে এই শহরের সুবিধা-অসুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই। তার মধ্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মানিয়ে চলার মতো মানসিকতাও নেই। অথচ এসব গুণাবলির কারণে তার মতোই আরেকজন ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট বার্নি স্যান্ডার্স কত সফল।’

এরপর একটার পর একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে লাগল। এসব প্রবন্ধের বক্তব্য হলোÑ মামদানি ডেমোক্র্যাট পার্টির ঐক্যে ফাটল ধরাবেন এবং ইহুদি ভোটারদের দূরে ঠেলে দেবেন। মামদানির অভূতপূর্ব সাফল্যের পরপরই নিউ ইয়র্ক টাইমস সবচেয়ে নোংরা আক্রমণাত্মক প্রতিবেদনটি ছেপেছিল।

পত্রিকাটি একটি হ্যাকড হওয়া ডাটাবেসের ওপর ভিত্তি করে মামদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল। তিনি নাকি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার সময় নিজের জাতিগত পরিচয় নিয়ে চালাকি করেছেন। অথচ মামদানি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে খাপ খাওয়ানোর জন্য ওভাবে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন।

টাইমস একটি সাদামাটা প্রশাসনিক বিষয়ে রঙ চড়িয়ে সেটিকে কেলেঙ্কারি বানিয়েছে। অথচ এ খবরটি তারা নিয়েছে একজন কুখ্যাত শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী জর্ডান লাসকারের কাছ থেকে। এই লাসকার যে ইউজেনিক্সভিত্তিক ভুয়া বিজ্ঞানচর্চার দায়ে অভিযুক্ত, সে তথ্যটি পাঠকদের কাছ থেকে চেপে গিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমস মামদানিকে নিয়ে এত ভীতসন্ত্রস্ত কেন? পত্রিকাটি যে ফিলিস্তিনের বিরোধিতা করে এবং ইসরাইলের প্রতি অন্ধ সমর্থন দেয়, সচেতন পর্যবেক্ষক মহল তা বহুদিন ধরেই লক্ষ করছে। তবে অনেকে মনে করেন, মামদানির প্রতি টাইমসের এই বৈরিতার পেছনে দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু রাজনৈতিক সমীকরণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি বিষয় আলাদাভাবে উল্লেখ করার মতো। সেটা হলো টাইমস পত্রিকার আতঙ্ক।

টাইমস আতঙ্কিত, কারণ এর সম্পাদকরা জানেন যে তারা এমন একটি শহরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন, যার নামে তাদের পত্রিকার নামকরণ করা হয়েছে। এ কারণে টাইমস ও তাদের মিত্ররা মামদানির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সবকিছুই করছেন। ভেতরে ভেতরে তারা ঠিকই জানেন যে গণহত্যার সমর্থক জায়োনিস্টরা নিউ ইয়র্কের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।

ইসরাইলের গণহত্যার বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদকে তারা ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। অথচ এসব প্রতিবাদের অনেকগুলোতেই নেতৃত্ব দিয়েছিল ইহুদি ছাত্ররা। ছাত্রদের প্রতিবাদকে এভাবে চিত্রিত করে তারা ট্রাম্প ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জায়োনিস্টদের একটু সুবিধা করে দিয়েছিলেন। যাতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ দমন করতে পারে। তারা মনে করেছিলেন এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা প্রতিবাদকে বাগে আনতে পেরেছেন।

কিন্তু তারপর তাদের চোখের সামনেই উঠে এলেন মামদানি। সাহসী, মেধাবী, আকর্ষণীয় এবং অদ্ভুত রকম শান্ত স্বভাবের এক তরুণ মুসলমান। দুর্নীতিবাজ ডেমোক্র্যাট পদপ্রার্থী কুওমোকে তিনি নির্বাচনী লড়াই থেকে ছুড়ে ফেলে দিলেন। এখন টাইমস ও তার মিত্ররা মামদানির বিরুদ্ধে সব অস্ত্র ব্যবহার করছেন। যেমনটা ইসরাইল করে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে।

মামদানি ঘোষণা দিয়েছিলেন, যদি যুদ্ধাপরাধী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিউ ইয়র্কে পা রাখেন, তবে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এমন একজন মেয়র পদপ্রার্থীর চরিত্রহননে তারা সফল হলেও হতে পারেন। তবে তারা এটাও জানেন, গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত জায়োনিস্টরা শুধু নিউ ইয়র্কেই নয়, পুরো আমেরিকাতেই তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।

যতবারই কোনো লিবারেল প্রতিষ্ঠান মামদানিকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে চিত্রিত করতে চেয়েছে, একবারও হালে পানি পায়নি। কারণ মামদানিকে নিউ ইয়র্কের বহু নীতিবান, প্রগতিশীল ইহুদি সমর্থন দিচ্ছে। এদের মধ্যে তরুণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষও রয়েছে।

বহু আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন নীতিবান ইহুদি নিজেকে আর নিপীড়নের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে দিতে চায় না। এর বদলে তারা এক নীতিনিষ্ঠ এক জোটে যোগ দিয়েছে, যার লক্ষ্য হলো একজন প্রগতিশীল মুসলমানকে মেয়র নির্বাচিত করা। রাজনীতির ময়দানে যখন ইসলামবিদ্বেষ ও ইহুদিবিদ্বেষ দুটিই প্রবলভাবে উপস্থিত, তখন এ ইহুদিরা একজন প্রগতিশীল মুসলিমকে মেয়র নির্বাচিত করতে জোট বেধেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ও তাদের দোসররা ভেবেছিল, জেরি সাইনফেল্ড এবং তার স্ত্রীর মতো উগ্র জায়োনিস্টরাই নিউ ইয়র্কের ইহুদি সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

সাধারণ জনমতেও বড়সড় পরিবর্তন আসছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র আট বছরে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ইসরাইল সম্পর্কে সমালোচনামূলক মনোভাব বেড়েছে ৫৬ পয়েন্ট। সিএনএনের জনমত বিশ্লেষক হ্যারি এন্টেন এই পরিবর্তনকে বলেছেন, ‘সি চেঞ্জ’ বা গভীর পরিবর্তন। হ্যারি এন্টেন বলেছেন, ‘জনমত জরিপে এত বেশি পরিবর্তন খুব বিরল ঘটনা।’

বর্তমানে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ ইসরাইলিদের প্রতি ও ৬০ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এ ধরনের জরিপে এটি ইসরাইলিদের জন্য ইতিহাসে সর্বনিম্ন এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য সর্বোচ্চ স্কোর। টাইমস এখনো এই পরিবর্তনের তাৎপর্য বুঝতে পারছে না। তবে তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে যদি তারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শিখতে পারে।

যে রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী কণ্ঠকে তারা স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল, তাদেরই একজনের পুত্র সাহসী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে উঠে এলেন। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং পুরো শহরের জায়োনিস্টদের তিনি কল্পনার জগৎ থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছেন। জায়োনিস্টরা মনে করত, এই শহর আর ক্যাম্পাসগুলো সব তাদের দখলে। এ কারণেই নিউ ইয়র্ক টাইমস এখন প্রায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।

এখন শুধু কয়েকটা কলেজ ক্যাম্পাস নয়, সারা শহর, এবং সম্ভবত সারা দেশ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একসময় তারা নিজেদের এ শহরের হর্তাকর্তা ভাবত। কল্পনার সেই তাসের ঘরটি এখন ভেঙে পড়ছে।

মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা

সূত্র, আমার দেশ