ভারতজুড়ে মোদিবিরোধী আন্দোলন দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। প্রতিটি রাজ্যের হাজার হাজার মানুষের পদভারে রাজপথ এখন কাঁপছে। তাদের স্লোগানের ভাষা হচ্ছে : ‘মোদি হটাও সংবিধান বাঁচাও’। বলা যায়, অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে পুরো ভারত। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের আঁচ লেগেছে সেখানে। সম্ভবত এই আন্দোলন বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের ইঙ্গিত প্রদান করছে।
অভিযোগ উঠেছে, শ্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে ভারত একদিকে যেমন বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে তেমনি তার অর্থনৈতিক দুরবস্থা তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় ভারতের পণ্যের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। ভারতের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরিতা ভারতের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে আসা ১৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্সের ক্ষতির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম দেশটিতে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
এদিকে জুলাই বিপ্লবের মুখে শেখ হাসিনা তার দলবল নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া, ভারতীয় ভিসা জটিলতা ও বিজেপি নেতাদের কর্তৃক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারের ফলে বাংলাদেশিদের পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে সেখানে বড় ধরনের ধস নেমেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এ জন্য তারা বেশি করে দায়ী করছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং তথাকথিত সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জনকে। তাদের প্রচণ্ড বাংলাদেশবিরোধী প্রচারের কারণে বাংলাদেশিরা আতঙ্কিত হয়ে সেখানে যাচ্ছেন না বলে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন। এ রকম একটি পটভূমিতে কলকাতায় আওয়ামী লীগের অফিস খোলা এবং সম্প্রতি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতার বাংলা ভাষাকে অপমান করার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে।
আসন্ন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতি বিজেপির অবস্থাকে আরো কঠিন করে তুলেছে। সেখানে স্লোগান উঠেছে এভাবেÑডাক দিয়েছে বাংলা ভাষা/ রাজ্য বিজেপি কোণঠাসা। বাংলা ভাষার এই অপমানকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের আপামর জনগণ যেভাবে ফুঁসে উঠেছে, তাতে রক্তপাতের মতো ঘটনা ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মূলত কেন্দ্রীয় বিজেপির আইটিপ্রধান অমিত মালব্যের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে পুরো পশ্চিমবঙ্গ এই অগ্নিগর্ভ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শ্রী মালব্য বলেছেন, বাংলা কোনো ভাষা নয়। আর ভারতের জাতীয় সংগীত সংস্কৃত বাংলায় লেখা। অন্যদিকে দিল্লি পুলিশের একটি চিঠিতে বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশিদের ভাষা হিসেবে উল্লেখ করায় পশ্চিম বাংলার প্রতিটি বাঙালি ফুঁসে উঠেছে। সেখানে বাঙালি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, অতি সাধারণ মানুষ অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার সর্বস্তরের মানুষ একাট্টা হয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা রীতিমতো ভিলেনে পরিণত হয়েছে। বিজেপি ছাড়া এই ইস্যুতে তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম, কংগ্রেস দলসহ সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ। এটিকে তারা ভাষা আন্দোলন বলছে, যা আমরা ১৯৫২ সালে করেছিলাম। এখন বিজেপি তথা মোদির বিরুদ্ধে যে জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি কোনো গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তাহলে সেখানে জামাই আদরে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কী অবস্থা দাঁড়াবে, সেটিও একটা ভেবে দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতীতে ভারতে আশ্রয় পাওয়া তিব্বতের ধর্মগুরু দালাইলামা ও তার দলবল গোড়া থেকেই ভারতের সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন লাভ করেছিল। এমনকি শেখ হাসিনাও ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর একই ধরনের সমর্থন উপভোগ করেছিলেন। কারণ সে সময় ভারতের আপামর জনগণ একাত্তরের যুদ্ধবিজয়ের সুখস্মৃতি নিয়ে দিনাতিপাত করছিলেন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন। বিশেষ করে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, নিবর্তনমূলক শাসন ও গণহত্যায় জড়িত থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আশ্রয় দেওয়ায় তারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আদর-আপ্যায়নে সহায়তাকারী বিজেপি নেতারাই যখন জনরোষের মধ্যে পড়েছে, তখন কলকাতায় স্থাপিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অফিস কতটা সুরক্ষা পাবে, তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি বিজেপি ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রতি গণধিক্কারের ঘটনাবলি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ ভাইরাল হয়েছে। তিনি যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই ধাওয়া খাচ্ছেন। আর সেই তথাকথিত সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জনের অবস্থাও একই ধরনের।
একদা ভারতের জনসংখ্যার বিরাট যে অংশটি নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারা আজ চরমভাবে হতাশ। শুধু তাই নয়, এক দশক তিন মাস আগে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ অর্থাৎ ‘প্রতিবেশী প্রথম’, তখন প্রতিবেশী দেশগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু ওটা যে একটা কথার কথা ছিল, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তা প্রমাণ হয়ে যায়। এ সম্পর্কে বিবিসি বাংলাকে দিল্লির জেএনইউ ও সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বিশ্বের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এস ডি মুনি বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় এসেই যে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বলেছিলেন, তার গোড়ায় গলদ ছিল।
তিনি বলেন, এ ঘোষণার পেছনে কোনো গভীর চিন্তাভাবনার ছাপ ছিল না, বরং ওটি ছিল একটা ‘জার্ক রিঅ্যাকশন’ বা দুম করে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত।
কারণ ঘটা করে সার্ক দেশগুলোর নেতাদের মোদির শপথগ্রহণে আমন্ত্রণ জানানোর কিছুদিন পরই আমরা দেখলাম, পাকিস্তান থেকে একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল দিল্লিতে এলো, তাদের সঙ্গে কাশ্মীরের হুরিয়ত নেতাদের দেখা করতে দেওয়া হলো না। অথচ ওই বৈঠকের জন্য হুরিয়ত নেতারা আগেভাগেই দিল্লিতে এসে অপেক্ষা করছিলেন।
এখন পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যদি হুরিয়ত নেতাদের দেখা করতে না দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তাদের শ্রীনগর থেকে দিল্লি আসতে দেওয়াটাই উচিত হয়নি। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো আলোচনা ভারত যদি না-ই করতে চায়, তাহলে নওয়াজ শরিফকে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এ ধরনের উদাহরণ আরো কয়েকটি দিতে পারি, যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় নেইবারহুডের দেশগুলোকে গুরুত্ব দেওয়াটা কখনোই এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল না। সোজা কথা ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নয়, আসলে ওটা ছিল একটা ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট পলিসি’।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আরো অনেক ভুলের কথা উল্লেখ করে তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সে দেশে সঠিক রাস্তায় এগোচ্ছেন না এবং তার বিরুদ্ধে জনরোষ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, ভারত কখনো তা স্পষ্ট ভাষায় খেয়াল করিয়ে দেয়নি। তিনি যদি ভারতের ভালো বন্ধু হন, তাহলে তাকে সিরিয়াসলি নার্স করার দরকার ছিল। কিন্তু সেটি কখনো করা হয়নি। তার ওপর গোয়েন্দা ব্যর্থতা তো ছিলই। তা ছাড়া আমি বলব, শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করে ভারত কার্যত একটি ‘ব্ল্যাংক চেক’ লিখে দিয়েছিল, সেটিই এখন বুমেরাং হয়ে ভারতের কাছে ফিরে এসেছে।