সাবেক নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা প্রকাশ্যে জুতাপেটা খাওয়ার পর মব শব্দটি এখন আবার ভাইরাল হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে একদল বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল মিডিয়া মব শব্দটিকে আমাদের সামনে এনেছে। কেউ কেউ মনে করেন, কোথাও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আক্রমণের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে মব জাস্টিস বলে জোরেশোরে প্রচারণা চালানোও এক ধরনের মব জাস্টিস। কারণ, তারা মব জাস্টিসরে অভিযোগের নামে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল কিংবা সেফ করতে চান। মব জাস্টিস কাকে বলে? মিডিয়ার কল্যাণে মব জাস্টিসের সংজ্ঞা সম্ভবত সবাই এখন জেনে গেছেন। মব জাস্টিস হচ্ছে, কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী মনে করে একদল লোক কর্তৃক মারধর, অপমান এবং তার বাসাবাড়ি কিংবা মালামালের ক্ষতি করে নিজেদের মধ্যে থাকা ক্ষোভ নিবারণ করা। মোটকথা, কোনো ব্যক্তিকে সন্দেহ হোক কিংবা নিশ্চিত অপরাধী জেনে হোক, আইন-আদালতের বিচার ছাড়াই উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক মারধর করা। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে, মব জাস্টিস গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কোনো সভ্য মানুষ আরেকজন মানুষকে; সে যত বড় অপরাধী হোক না কেন, তাকে প্রকাশ্যে অপমান, অপদস্থ, মারধর কিংবা তার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে এটা অপরাধ আবার ধর্মীয় দৃষ্টিতেও চরম অপরাধ। ইসলামি শরিয়াহর অন্যতম মাকসাদ বা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের ইজ্জত রক্ষা করা। একজন মানুষ অপরাধ করলে তার সঠিক বিচার আইন-আদালতের মাধ্যমে জেল, জরিমানাÑএমনকি ফাঁসিও হতে পারে। কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব তথা আশরাফুল মাখলুকাত লকবপ্রাপ্ত মানবের প্রকাশ্য অপমান-অপদস্থতা কোনোভাবেই স্বীকৃত নয়। মব জাস্টিসকে জঘন্য অপরাধ জেনেও মানুষ মব জাস্টিস কেন করতে যায়? এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে, মানুষ যখন অপরাধীর বিচার হতে দেখে না, উল্টো অপরাধীকে বিভিন্নভাবে বাঁচানোর চেষ্টা দেখে, অপরাধীরা যখন আইন, প্রশাসন ও কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তখন সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়, সেই ক্ষোভ থেকেই কেউ কেউ মব জাস্টিসের শিকার হন। বিগত হাসিনা সরকারের দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশে মব জাস্টিস রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। শাহবাগে ফ্যাসিবাদীরা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কাদের মোল্লা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের অন্যায়ভাবে ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবিতে দিনের পর দিন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল। চরম ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে। ইমরান এইচ সরকার তখন দেশের রাজা বনে গিয়েছিল। তার হুকুমে সবাই উঠবস করেছে। আওয়ামী সরকারের আমলে সারা দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের মব জাস্টিসের শত শত নমুনা দেখা গেছে। এমনকি পুলিশ-র‌্যাবও মব জাস্টিসের শোডাউন করেছে। আওয়ামীবিরোধী ব্যক্তিবর্গকে গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলার আগেই রাস্তাঘাটে, বাড়িঘরে, যেখানে-সেখানে তারা অপমানিত করেছে। কাউকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। কাউকে গুলি করে মেরেছে। কাউকে চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে। বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিনকে প্রায় উলঙ্গ করে পুলিশের সেই ভয়ানক লাঠিপেটার দৃশ্য এখনো চোখে ভেসে উঠলে আঁতকে উঠতে হয়। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কুষ্টিয়ার আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে মেরে রক্তাক্ত করার বীভৎস দৃশ্যও আমরা দেখেছি। দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের ওপর হায়েনাদের হামলে পড়ার দৃশ্য কখনো ভোলার নয়। ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা দেলোয়ার হোসাইন কিংবা শফিকুল ইসলাম মাসুদের ওপর যে নৃশংস অত্যাচার করা হয়েছিল, তা সবাই দেখেছে। সাতক্ষীরায় বুলডোজার দিয়ে নিরপরাধ মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার নজিরও আমরা দেখেছি। ফাঁসি কার্যকর করার পর কবরের ওপর জুতাপেটা করার অমানবিক দৃশ্যও দেখা গেছে। ২০০৫ সালের ২৮ অক্টোবরে লগি-বৈঠার আঘাতে শহীদ হওয়া লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ মের কালোরাতে গণহত্যার পর শহীদদের ঠাট্টা করে বলা হয়েছিল, লাল রঙ মেখে শুয়েছিল হেফাজতিরা। সুশীল সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী আর মিডিয়াগুলো তখন মানবতার(?) পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছিল, হেফাজতের তাণ্ডবে ঢাকার রাস্তার সৌন্দর্য হারিয়েছে! সবুজ গাছপালা আর রাস্তার ডিভাইডার ভেঙে যাওয়ায় তাদের আত্মা কষ্ট পেয়েছিল কিন্তু আওয়ামী গণহত্যায় তাদের আত্মা মোটেও কষ্ট পায়নি। আজকে যারা মব জাস্টিস নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারা বিগত আওয়ামী আমলে একবারের জন্যও মব শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তারা সব মবকে জাস্টিফাই করেছেন। তারা মবকে জনগণের ক্ষোভ বলে চালিয়ে দিয়েছেন কখনো কখনো। আবার কখনো মবকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেন কোনো কিছুই ঘটেনি। কখনো কখনো তারা জালিমের পক্ষ নিয়ে মাজলুমকে আরো মাজলুম হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। আওয়ামী সরকারের সময় বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছিল। দেশে কোনো বিচার ছিল না। বিচারপতিরা যেসব অন্যায় করেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। পুলিশ যে অন্যায় করেছে, তা ভাবা যায় না। সরকারের অন্যান্য বাহিনী যে অন্যায় করেছে, তা নজিরবিহীন। এ দেশে হাজার হাজার মানুষ খুন-গুম হয়েছে। স্বজনরা খুন-গুম হওয়া ব্যক্তিদের নামও উচ্চারণ করতে পারত না ভয়ে। আয়না ঘরের নৃশংসতা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এ দেশে? ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর মানুষ ভেবেছিল, আওয়ামী আমলের সব অপরাধীকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গ্রেপ্তার করে সঠিক বিচারের মুখোমুখি করবে। কিন্তু জনগণ যখন দেখে, আওয়ামী লীগের দোসররা সব জায়গায় পুরস্কৃত হচ্ছে। অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশ-বিদেশে আসা-যাওয়া করছে। ভিআইপি মর্যাদায় দেশত্যাগ করছে কেউ কেউ। এসব দেখলে নির্যাতিত মানুষের মনে ক্ষোভ তো দেখা দেবেই। এ দেশে মোটা দাগে তিনটি অবৈধ নির্বাচনের জন্য দায়ী ছিল নির্বাচন কমিশন। সেই নির্বাচন কমিশনের কমিশনাররা দিব্যি এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের আইনের আওতায় না আনার কারণে জনমনে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকেও আমলে নেওয়া প্রয়োজন। সরকার যদি অপরাধীদের বেলায় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করত, তাহলে সাধারণ মানুষের আর মব জাস্টিস করার প্রয়োজন হতো না। সরকারের এই গাফিলতির সুযোগে অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে দেশে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনুন। আর্মি পুলিশকে শক্ত হতে বলুন। সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা ফিরিয়ে আনুন। তাদের মনের ক্ষোভ প্রশমন করুন। অপরাধীদের ধরে জনগণকে যেন বিচার না করতে হয়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তাহলেই দেখবেন মব জাস্টিস চলে গেছে। জাস্টিসকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই মব থাকবে না। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক; আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ।

ইমেইল: [email protected]

বিষয়: ভাইরাল মব জাস্টিস নুরুল হুদা

সূত্র, আমার দেশ