শৈশব থেকেই আমরা শুনে আসছি—‘জ্ঞানই শক্তি।’ এই কথাটির মর্মার্থ হলো, শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান নয়, বরং আমাদের চারপাশের সমাজ ও বিশ্ব সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের প্রজন্মে বহু পরিবারে পত্রিকা পড়াকে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হতো। অভিভাবকরা শিশুদের প্রতিদিনের খবর পড়তে উৎসাহ দিতেন, যাতে তারা বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। এতে শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠিত হতো আরো যুক্তিবোধসম্পন্ন ও তথ্যভিত্তিকভাবে। সময় বদলেছে।

এখন জ্ঞানের উৎস অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ—ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারসহ নানা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের প্রতিদিন তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই তথ্যগুলো কতটা নিরপেক্ষ ও সত্য? এখনকার তথ্য পরিবেশ অনেকাংশে পক্ষপাতদুষ্ট ও প্রভাবিত। সমাজ ও রাজনীতির গঠন, ক্ষমতার কাঠামো এবং নৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে জানা আজ আরো বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। এঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা স্থপতির মতো পেশাগত শিক্ষা আমাদের কারিগরি দক্ষতা দেয় ঠিকই, কিন্তু এই জ্ঞান আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে শেখায় না। সমাজবোধ, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের জন্য প্রয়োজন সমাজ-সম্পর্কিত জ্ঞান। তাই পেশাগত সাফল্য এবং সামাজিক-নৈতিক সচেতনতার মাঝে এক সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

আমরা জ্ঞান অর্জন করি পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক মেলামেশা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে। বিশেষ করে গণমাধ্যম—আগে যেখানে সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন ছিল মূল মাধ্যম, এখন সেখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রাধান্য পাচ্ছে। গণমাধ্যম আমাদের রাজনীতিকে বুঝতে, মতামত গঠন করতে এবং সামাজিক আচরণে প্রভাব ফেলতে সাহায্য করে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে, অনেক সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষতা ও সত্যনিষ্ঠতা ত্যাগ করে রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। একসময়কার বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান, যেমন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা বা ডিডব্লিউ আজ বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়েছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র বা বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলোয়ও গণমাধ্যম রাজনৈতিক আদর্শে প্রভাবিত হয়ে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে বা অপ্রিয় সত্য চেপে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদদের ভূমিকা এখানেও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নিজেদের মতাদর্শ প্রচারে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ইরান কিংবা যুক্তরাষ্ট্র-আফগানিস্তানের যুদ্ধ অনেকাংশেই ছিল নেতৃত্বের ইচ্ছানির্ভর এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণহীন সিদ্ধান্তের ফল। এদের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্ন না করেই প্রচার করছে গণমাধ্যম। ফলে গড়ে উঠছে একধরনের বিকৃত বাস্তবতা।

রাজনীতিবিদদের মিথ্যা ও গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্টতায় সমাজে তৈরি হচ্ছে বিভাজন ও বিভ্রান্তি। মানুষ যা জানছে বা দেখছে, তার ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বিশ্বাস গড়ে তুলছে এবং মতামত তৈরি করছে। যখন সেই তথ্য মিথ্যা বা বিকৃত হয়, তখন ব্যক্তির যুক্তিশীল চিন্তাভাবনা ব্যাহত হয়। এর ফলে সমাজে বিভ্রান্তি ও বৈষম্য তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা সমাজে মুসলমানদের নিয়ে যে নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরা হয়, তা মূলত রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমিক প্রচারের ফল। একইভাবে ইসরায়েল-ইরান সংকটে ইরানিদের কঠোরভাবে প্রশ্ন করা হলেও ইসরায়েলি নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ না করাই প্রমাণ করে গণমাধ্যমের দ্বিমুখী আচরণ। এই বিকৃত তথ্যের প্রভাব শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা প্রতিদিনের জীবনে, সম্পর্ক গঠনে এবং সামাজিক আচরণেও প্রভাব ফেলে। ফলে আমরা ভুল মানুষকে বিশ্বাস করি, ভুল সিদ্ধান্ত নিই এবং সমাজে বিভেদ তৈরি হয়।

নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে বিবেককে পুনরুদ্ধার করা

গণমাধ্যমের এই বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটের প্রেক্ষাপটে এখন আর এককভাবে তথ্যের ওপর নির্ভর করে নৈতিকতা শেখা সম্ভব নয়; বরং আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যেখানে নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বোধ থাকবে পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে। গণিত, পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের মতোই নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষা জরুরি—এগুলো ব্যক্তির মূল্যবোধ গঠনে সহায়ক। এখানে ধর্ম বলতে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মকে বোঝানো হচ্ছে না, বরং মানুষের সাধারণ নৈতিক গুণাবলিকেই বোঝানো হয়েছে—যেমন সহানুভূতি, অন্যকে সাহায্য করা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এসব বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা দিলে একটি এমন প্রজন্ম তৈরি হবে, যারা হবে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন, আবার নৈতিকভাবেও দৃঢ়। বর্তমানে সমাজে এমন পেশাদার মানুষের অভাব, যারা দক্ষতার পাশাপাশি নৈতিকভাবে স্পষ্ট। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নেতারা ক্ষমতার মোহে অন্ধ, সাংবাদিকরা ক্যারিয়ার বাঁচাতে সত্য গোপন করছেন, আর প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এই অবস্থা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা, যেখানে নৈতিক জ্ঞানকে পেশাগত জ্ঞানের সমতুল্য গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমরা চাই ডাক্তার, যারা ধর্মীয় পরিচয় না দেখে রোগী চিকিৎসা করবে; নেতা, যারা সামাজিক ঐক্যকে গুরুত্ব দেবে এবং ব্যবসায়ী, যারা মুনাফার পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ববোধ রাখবে। এই ধরনের মানুষ তৈরি করতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

মিথ্যা তথ্যের জোয়ারে এবং স্বার্থান্বেষী নেতৃত্বের প্রভাবে আজ আর সামাজিক ন্যায় বা মূল্যবোধ নিয়ে সত্য জানা বা শেখা সম্ভব নয় একমাত্র প্রচলিত মাধ্যম দিয়ে। তাই আমাদের ভাবতে হবে—কীভাবে আমরা জ্ঞান আহরণ করি, কী শেখাই এবং কীভাবে মূল্যায়ন করি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা যদি মূলধারায় না আসে, তাহলে ভবিষ্যতের সমাজ হবে জ্ঞানের দ্বারা নয়, বিভ্রান্তির দ্বারা পরিচালিত। শুধু পেশাগত সাফল্য নয়, বরং সামাজিক দায়িত্ব ও মানবিকতা বোঝে, এমন নাগরিক তৈরি করাই এখন সময়ের দাবি। আমরা এক বৈশ্বিক নৈতিক সংকটের মুখোমুখি। এই সংকটের সমাধান শুরু হতে পারে একটিমাত্র জায়গা থেকে—সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে।

লেখক : লেকচারার, স্কুল অব বিজনেস ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া।

সূত্র, আমার দেশ