ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জড়াবে কিনা তা দুই সপ্তাহ পর সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র। আল জাজিরার প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা মনে করেন, ট্রাম্প দুই সপ্তাহের সময়সীমার মধ্যেও ইরানে হামলা চালাতে পারেন। তার মতে, এটা ক্যামোফ্লেজ বা ধোকা। এমনকি কালও ইরানে আক্রমণ হতে পারে। বিশারার মতে, ইউরোপীয় নেতারা ইরানের সাথে যে আলোচনা করতে চাইছেন- তাদের মুখরক্ষার জন্য অল্প কিছু সময় নিতে পারেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এখন পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে ট্রাম্প ও ইসরাইলকে হয় পিছু হটতে হবে; না হয় হামলা করতে হবে।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আবার বলেছেন, তাদের কাছে তথ্য আছে ইরান দু সপ্তাহের মধ্যে পারমাণবিক বোমা বানাতে পারে। এ থেকে বোঝা যায়, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলা অনেকটা নিশ্চিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ইরানের ফোর্দা পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালাতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বি ২ স্পিরিট যুদ্ধবিমানের সাহায্যে বাঙ্কার বাস্টার বোমা জিবিউ ফাইভ সেভেন বোমা ফেলতে হবে।
গার্ডিয়ান পত্রিকার এক রিপোর্ট বলা হয়েছে, জিবিউ ফাইভ সেভেন বোমা দিয়েও ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার উইপন ব্যবহার করতে হবে। ইতোমধ্যে রাশিয়া ও চীনের দিক থেকে বার্তা দেয়া হয়েছে, ইরানের ওপর যে কোনো পারমাণবিক হামলার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা হবে তা ধরে নিয়ে ইরান যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজিয়েছে। ইরানের একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মোহসেন রেজাই বলেছেন, ইরান হামলার আগেই সমস্ত পারমাণবিক উপকরণ সুরক্ষিত করেছে। তিনি আরো জানান, সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম অনেক আগেই গোপন স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
ইরান এখন বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজ জানিয়ে দিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা কোনো আলোচনায় বসবে না। তিনি বলেন, ইহুদিবাদী সরকারের আগ্রাসন চলা অবস্থায় আমরা কারো সাথে আলোচনা করতে ইচ্ছুক নই। অর্থাৎ ইসরাইল যুদ্ধবিরতির ঘোষণা না দিলে ইরান আলোচনায় বসবে না সেই ইঙ্গিত তিনি দিলেন।
এদিকে, ইরান ধীরে ধীরে শক্তিশালী মিসাইলগুলো সামনে আনছে। ইসরাইলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। যদিও ইসরাইলের ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। তবে হামলার ধরন দেখে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ইরান সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হামলাগুলো করছে । ইরানের একটি হাসপাতালে হামলার পর ইসরাইলের একটি হাসপাতালে হামলা হয়েছে। এছাড়া ইসরাইলের অনেকগুলো সামরিক স্থাপনায় হামলা হয়েছে। ইসরাইল যখন বলছে, ইরানের আকাশ তাদের নিয়ন্ত্রণে, এরপর ইরান বলছে, ইসরাইলের আকাশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। সত্যিই তারা ইসরাইলের আকাশে একের পর এক মিসাইল ছুড়ে ক্ষয়ক্ষতি করছে। ফলে ইসরাইলের প্রতিটি হামলার জবাব দেয়ার চেষ্টা করছে ইরান।
এখন প্রশ্ন হলো- যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ার পর ইরানের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের আটটি দেশ ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, কাতার, জর্ডান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিরিয়ার সামরিক ঘাঁটিতে ৪০ হাজার আমেরিকান সেনা অবস্থান করছে। এসব সামরিক ঘাটি ইরানের স্বল্পপাল্লার মিসাইলের আওতায় আছে। এছাড়া এসব ঘাঁটি ইসরাইলের মতো এতো সুদৃঢ় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও নেই। ইরানের প্রক্সি সংগঠনগুলোর নিশানা হতে পারে এসব ঘাঁটি।
এছাড়া ইরান হরমুজ প্রণালী ও হুথিরা বাব আল মান্দেব প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। ফলে এই যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে না, এই যুদ্ধের প্রভাবে চীন ও ইউরোপের দেশগুলো ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে পড়বে। ইতোমধ্যে ইরানের একজন আইনপ্রণেতা বলেছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার বিষয়টি তাদের বিবেচনার মধ্যে আছে।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে অন্য দেশগুলো কে কিভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে তা আগে থেকেই অনুমান করা কঠিন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলছেন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়ে ব্যাপক আপ্যায়ন ও সম্মান দেখিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিশ্চুপ- তবে মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে গোয়েন্দা হাব সাইপ্রাস সফর করে এসেছেন।
এছাড়া খবর এসেছে, চীনের একটি বিশেষ প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজ পারস্য উপসাগরে পৌঁছেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন বলছেন, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে রুশ বিজ্ঞানীরা আছে; তাদের সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা নেই। আজকে (শুক্রবার) রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, রাশিয়ার রোসাটম স্টেট নিউক্লিয়ার এনার্জি কর্পোরেশনের প্রধান জানিয়েছেন, বুশেহরে ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়ান কর্মীরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। রাশিয়া আশা করে, ইসরাইলকে দেওয়া তাদের বার্তা ইসরাইলি নেতৃত্বের কাছে পৌঁছেছে। অথাৎ ইরানে যেকোনো পারমাণবিক হামলার বিরুদ্ধে চীন ও রাশিয়া অবস্থান নিয়েছে।
এরমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইরানের প্রক্সি সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইরাকের কাতাইব হিজবুল্লাহ যুদ্ধ শুরুর সাত দিন পর জানিয়ে দিয়েছেন, তারা যেকোনো আগ্রাসন মোকাবিলায় ইরানের পাশে আছেন। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যর ইরাক, বাহরাইন ও ইয়েমেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিয়া। অপরদিকে, সৌদি আরব, তুরস্ক, লেবাননে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষ শিয়া জনগোষ্ঠী। ইরানের পরিস্থিতির দিকে তারা সর্তক নজর রাখছে।
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সাথে সাথে এসব দেশে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো শুধু লক্ষ্যবস্তু হবে না, পুরো আরব বিশ্বে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে পারে। একই সাথে যে কোনা মার্কিন স্বার্থ আঘাত হানা হতে পারে। ফলে যুদ্ধ নতুন মাত্রা পেতে পারে এবং অন্য দেশগুলো তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
এছাড়া ইরানে রেজিম চেঞ্জ বা শাসক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, বরং ইরানের মানুষ ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। এছাড়া ইসরাইলের অনেকগুলো গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে ইরান সরকার। বেশ কিছু আফগান ও ভারতীয় নাগরিককে আটক করা হয়েছে। ফলে সামনের দিনে ইরানের আভ্যন্তরীণ সংহতি আরো বাড়বে। যা রেজিম চেঞ্জের প্রচেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। অপরদিকে, ইরানের সাথে ইসরাইলের যুদ্ধ যে একপাক্ষিক হবে না- তা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে তেহরান।