২০২৪ সালের জুলাই মাসজুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশের রাজপথে বারবার উচ্চারিত হয়েছিল দুটি শব্দ ‘আজাদি’ এবং ‘ইনকিলাব’।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন এই শব্দ দুটির মধ্যে বাঙালি মুসলমানের ইসলামভিত্তিক পরিচয়ের প্রতি একটি স্পষ্ট ইশারা ছিল। এই শব্দগুলোর মাধ্যমে জুলাই ২৪-এর আন্দোলন, আত্মত্যাগ ও বিজয়ে বাঙালি মুসলমান নিজের অংশগ্রহণ ও অবদানের প্রমাণ রেখে দিয়েছে।
‘আজাদি’ শব্দটি দাসত্ব থেকে মুক্তি ও অন্যায়ের শিকল ভাঙার ডাক আর ‘ইনকিলাব’ মানে নতুন সূচনা, পুরোনো কাঠামো ভেঙে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকার। এই শব্দ দুটিই জুলাই ২৪-এর অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিটকে ধারণ করেছিল, যেখানে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী বুঝতে পেরেছিল যে তারা জাতির ইতিহাসের একটি অংশ নির্মাণ করছে।
কিন্তু আজ যখন জুলাই ২৪-এর ইতিহাস উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেখানে ‘আজাদি’ ও ‘ইনকিলাব’ শব্দের অস্তিত্ব নেই। এর বদলে অভ্যুত্থানটিকে বলা হচ্ছে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’। আপাতদৃষ্টিতে এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শোনালেও এর ভেতরে লুকানো আছে পুরোনো এক বয়ান, যার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানকে রাষ্ট্রের মধ্যে অনাহূত ও অবাঞ্ছিত করা হতো; তাদের নানা বৈষম্যমূলক আচরণের লক্ষ্যে পরিণত করা হতো; তাদের ওপর চালানো নানা নিপীড়নের বৈধতা উৎপাদন করা হতো।
‘ছাত্র-জনতা’ বয়ান এবং অদৃশ্য প্রান্তিককরণ
‘ছাত্র’ বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের, যাদের সেক্যুলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এই বর্গের বাইরে থেকে যায়। ফলে ‘ছাত্র’ বলার মধ্য দিয়ে কার্যত মাদরাসাছাত্রদের উপস্থিতি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়।
একইভাবে ‘জনতা’ বলতে রাজনীতিসচেতন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক সুশীল ও প্রগতিশীল মানুষদের বোঝানো হয়। এই বয়ানে দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি, হিজাবধারী—অর্থাৎ, প্রকাশ্যে ইসলামি পরিচয় বহনকারী বাঙালি মুসলমানদের প্রায়ই পশ্চাৎপদ, মৌলবাদী বা দেশবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় তাদের পদ্ধতিগতভাবে ‘জনতা’ বর্গের বাইরে রাখা হয়।
কিন্তু জুলাই ২৪ আন্দোলনে স্বৈরাচারের জুলুম-নির্যাতন সয়ে যাওয়া, শাহাদাতবরণ করা, কিংবা সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামি পরিচয়ের চিহ্নধারী বাঙালি মুসলমান জনতা এবং তাদের মাদরাসায় পাঠরত সন্তানরাই ছিল সর্বাগ্রে। এরাই প্রতিরোধের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আন্দোলনের মূল মেরুদণ্ড হিসেবে জীবন বাজি রেখে খুনি হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকে অবৈধ ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রকে উদ্ধার করেছিল।
জুলাই-২৪ অভ্যুত্থানে বাঙালি মুসলমানের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুরু করা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা-হটানোর আন্দোলনে রূপ দিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল মাদরাসাশিক্ষার্থী, মুসলিম আলেমসমাজ, মসজিদের খতিব-মুয়াজ্জিন এবং হিজাব-নেকাবধারী মা-বোনরা।
ময়দানে ও সংগঠনে নেতৃত্বে ছিল হেফাজতে ইসলামসহ বহু ইসলামপন্থি দল এবং সংগঠন। প্রচার, সংগঠন ও জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিল ইসলামী ছাত্রসমাজ ও তৌহিদী জনতার নানা সংগঠন। শহরের পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে সশস্ত্র খুনি বাহিনীর বিরুদ্ধে খালি হাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল মাদরাসাভিত্তিক গণজাগরণ। অসংখ্য মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন খুতবা ও আজানে প্রতিবাদের ভাষা এনেছিলেন। এবারের আন্দোলন কোনো বিদেশি সাহায্য বা পেশাদার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াই বাঙালি মুসলমান শুধু ঈমান, তৌহিদ এবং জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহসে সংগঠিত হয়েছিল।
২৪ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন বহু তরুণ, যাদের নাম ইতোমধ্যেই সরকারি ও মূলধারার বয়ান থেকে হারিয়ে গেছে। যেমন—খিলগাঁও আল-হেলাল মাদরাসার শাহীন হুজুর (বুকের বাঁ পাশে গুলি খেয়ে শহীদ), নরসিংদীর হাফেজ মুহাম্মাদ ফাহিম (তাকবির দিতে গিয়ে শহীদ), চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাওলানা তারিকুল ইসলাম।
এছাড়া যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে দিনের আলোয় পুলিশের গুলিতে মাদরাসাছাত্র হত্যার দৃশ্য এখনো অনেকে ভুলে যাননি।
রক্তাক্ত প্রতিরোধের সেই দিনগুলোয়, হাসিনার খুনি বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একজন হুজুর ফেসবুকে লিখেছিলেন—‘আপনারা যত পারেন মুর্দা হাজির করেন, আমি জানাজা পড়াব।’ এক মুয়াজ্জিন আজানে ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’-এর বদলে উচ্চারণ করেছিলেন—‘হাইয়া আলাল জিহাদ!’ আরেকজন খতিব জুমার খুতবায় বলেছিলেন—‘আল্লাহ, তুমি যেমনভাবে আবু লাহাবকে ধ্বংস করেছিলে, তেমনি শেখ লাহাবেরও ধ্বংস করো!’
এসব বক্তব্য, স্লোগান বা দোয়া শুধু রাজনৈতিক আবেগ বা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নয়, এগুলো ছিল ইসলামি চেতনার ভিত্তিতে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের ঘোষণা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ঈমানি দায়ের বহিঃপ্রকাশ।
ঐতিহাসিক চেতনার প্রয়োজনীয়তা
এই বাস্তবতাকে বোঝার জন্য ঐতিহাসিক চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টীয় ইতিহাসবিদ রবার্ট ট্রেসি ম্যাকেঞ্জি তার A Little Book for New Historians বইয়ে বলেন—
‘Historical consciousness is a mindset that changes how we see both ourselves and the world.’
অর্থাৎ, ইতিহাসচেতনতা হলো অতীত ও বর্তমান উভয় সময়ের মানুষকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বোঝার অভ্যাস। এটি মনে করিয়ে দেয়, অতীত ছাড়া বর্তমান বোঝা সম্ভব নয়। মানুষের জীবন সবসময় সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক শক্তি দ্বারা গঠিত ও প্রভাবিত হয়, যদিও আমরা তা অনেক সময় টেরও পাই না।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ও মূলধারার ইতিহাসচর্চা থেকে মাদরাসাশিক্ষার্থী ও বাঙালি মুসলমানদের অবদান প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে। অথচ ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন থেকে শুরু করে খেলাফত আন্দোলন, জমিদারবিরোধী আন্দোলন, ১৯৪৭-এর পাকিস্তান আন্দোলন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অধ্যায়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ইতিহাসে বাদ পড়া মানে অধিকার হারানো
২৪ জুলাইয়ের অভ্যুত্থান থেকে বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক ভূমিকা মুছে ফেলা হলে, আগের সেই প্রান্তিককরণ আবার ফিরে আসবে। এই বয়ান রাষ্ট্রের কাছে তাদের ন্যায্য দাবি অস্বীকারের যৌক্তিকতা তৈরি করবে এবং তাদের নাগরিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসবিদদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন ইসলামি চেতনা ইতিহাসচর্চাকে সংকীর্ণ করে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ আন্দোলনই বহু সময় সামাজিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হয়েছে। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, ফরায়েজি আন্দোলন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের গ্রামীণ প্রতিরোধেও এই শক্তি স্পষ্ট ছিল। ২৪ জুলাই সেই ঐতিহ্যেরই আধুনিক প্রতিফলন।
তাই ইতিহাসচর্চায় বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে মাদরাসাশিক্ষার্থী এবং সব শ্রেণি-পেশার বাঙালি মুসলমানের ভূমিকা স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা না হলে জুলাই ২৪-এর ইতিহাসও খণ্ডিত থেকে যাবে, বহু শহীদের নাম হারিয়ে যাবে, বিপ্লব বিকৃত হবে আর পরবর্তী প্রজন্ম জানবে না, এই আন্দোলন ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে ইসলামের পরিচয়ের ভিত্তি মুসলমান স্বাতন্ত্র্যবোধেরও জাগরণ।
জুলাই-২৪-এর বয়ানকে বাস্তবভিত্তিক করতে হলে, এর মধ্যে বাঙালি মুসলমানকে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে আমাদের প্রয়োজন—