সুপরিচিত চিন্তক ও লেখক ফরহাদ মজহার ৩ ও ৪ জুলাই দুই কিস্তিতে প্রস্তাবিত জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর যৌথ অঙ্গীকারে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংস্কার প্রসঙ্গের অন্তর্ভুক্তির আবশ্যকতা সম্পর্কে আমার একটি নিবন্ধের বরাতে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। শুরুতেই তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই যে তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।

তিনি আমার বক্তব্যের যে অংশটি বিশেষভাবে উদ্ধৃত করে তা সমর্থন করেছেন, সেখানে আমি লিখেছি: ‘গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করে তোলায় মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট নয়। ব্যক্তি খাতে গণমাধ্যমে কালোটাকার দৌরাত্ম্য, প্রভাবক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং নৈতিক মানের অনুপস্থিতির মতো বিষয়গুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন।’ এরপরই তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘তবে তিনি লিবারেল ইকোনমিক পলিসি নামে পরিচিত “মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ”কে যে ইতিবাচক চোখে দেখেন এবং নির্বিচার গ্রহণ করেন, আমি সেভাবে দেখি না, গ্রহণও করি না।’

গণ-অভ্যুত্থান ছিল ছাত্র-জনতার এক বৃহৎ ঐক্যের ফল, কিন্তু স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই কোনো ঐকমত্য তখনো ছিল না, এখনো হয়নি। কোনো একক বিপ্লবী নেতৃত্বও প্রতিষ্ঠা পায়নি। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের সংস্কারসূচির আলোচনাকে তিনি প্রতিবিপ্লব অভিহিত করতেই পারেন।

বাজারব্যবস্থা বিকাশের সঙ্গে গণতন্ত্রের আবির্ভাব ও বিকাশের সম্বন্ধ আছে উল্লেখ করেই তিনি লিখেছেন, ‘একালের কাছাখোলা মুক্তবাজার অর্থনীতি গণতন্ত্রের সহায়ক নয়; বরং গণতন্ত্রের, বিশেষত গণমাধ্যমের ঘাতক।’

গণ–অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা প্রকাশকারী রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক সমাজ এবং অন্তর্বর্তী সরকার কি অবাধ লুটপাটের স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণহীন বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছে না? তাদের সাফল্য হয়তো বেশি নয়, কিন্তু দেড় দশকের পাহাড়সম অনিয়ম-লুণ্ঠন মাত্র বছরখানেকের মধ্যেই পুরোপুরি বন্ধ হবে, এমন বিপ্লব কি আদৌ হয়েছে?

ফরহাদ মজহারের তাত্ত্বিক আলোচনাটি মূলত ছিল জুলাইয়ের ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানজাত অন্তর্বর্তী সরকার, তার সংস্কারভাবনা ও কার্যক্রম এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে। এসব তাঁর বিপ্লবচিন্তা, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও গঠনতন্ত্রের ভাবনার সঙ্গে মেলে না। তাঁর ভাষায়, ‘৫ আগস্টে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, কিন্তু ৮ আগস্টে বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রাখার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবিপ্লবী রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করে।’

তাঁর এই বিশ্লেষণ শুধু যে তত্ত্বচর্চায় সীমিত, তা নয়। এটি প্রয়োগের চেষ্টাও হয়েছে। সফল হয়েছে কি না, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। আমি সে বিষয়ে আলোচনায় যাব না। ‘কামাল আহমেদ ৮ আগস্টের সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব এবং পরবর্তী সময়ে জনগণকে সজ্ঞানে বাদ দেওয়ার প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেও ৫ আগস্ট থেকে আলাদা করতে পারেননি।’—আমি শুধু তাঁর এই অভিযোগের জবাব দেওয়াতেই আমার আলোচনা সীমিত রাখার চেষ্টা করব।

৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণকে ফরহাদ মজহার ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ অভিহিত করে ৪ জুলাই লিখেছেন, ‘জুলাই সনদ সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার দলিল; গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা।’ মাত্র ছয় মাস আগে গত ১৫ জানুয়ারি তাঁর অভিমত ছিল, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সরকার পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করবে।’ ফেসবুকে তখন তিনি লিখেছিলেন, ‘ঘোষণাপত্র জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং আইনি অনুষ্ঠান। ঘোষণার অনুপস্থিতিতে সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার বেআইনি ও অবৈধ (জুলাই ঘোষণাপত্র ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার অবৈধ: ফরহাদ মজহার, দৈনিক কালবেলা, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫)।’

জানুয়ারিতে ঘোষণাপত্র জনগণ কীভাবে রচনা করত, তা আমরা জানি না। কিন্তু এখন তাঁর ভাষ্যসূত্রে আমরা জানতে পারছি, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, তথাকথিত “সংস্কার কমিশন”, “জুলাই সনদ” প্রভৃতি মূলত লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং বিদেশি স্বার্থান্বেষী শক্তির মধ্যকার নতুন বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া ও দলিল।’ দেশের সক্রিয় ও বৈধ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ম্যারাথন আলোচনায় যে সমঝোতা হবে, তার ফলাফল সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে “সনদ” তৈরি হয়, তা কোনোভাবেই জনগণের সার্বভৌমত্ব কায়েম করতে পারে না।’

রাজনীতিবিদেরা যে অহরহ ‘জনগণ’ কথাটি ব্যবহার করেন, তার সঙ্গে ফরহাদ মজহারের বর্ণিত ‘জনগণ’-এর ফারাকটা কোথায়, তা অবশ্য বোঝা মুশকিল। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের তিনি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করতে রাজি নন, কিন্তু প্রতিনিধিত্বের মূর্ত রূপ কী হবে, তা বলেননি। আমরা কি তবে বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার ভিত্তিতে সমাজের প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণের ব্যবস্থা মেরিট্রোক্র্যাসির মতো কিছু চাইছি? রাজনৈতিক দলগুলোকে নাকচ করে দেওয়ার পর শূন্যতাজনিত নৈরাজ্য সৃষ্টি নিশ্চয়ই কারও কাম্য হতে পারে না।

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাও কি জনগণের কথা বলেননি? তিনি তো তাঁর অনুসারী আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী, তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী ও লুটেরা ব্যবসায়ীদের বাইরে ভিন্নমতের সবাইকে দেশ ও জাতির শত্রু গণ্য করতেন। রাজনৈতিক দল ও নাগরিক গোষ্ঠী বা সংগঠনগুলো, যাঁদের অনেকেই এনজিও বা সুশীল সমাজ বলে অভিহিত করে থাকেন, তাঁদের কোন যুক্তিতে ‘জনগণ’ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হবে না? অবশ্য ফরহাদ মজহারের প্রতিষ্ঠিত পাঠচক্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্প নির্ধারণী গবেষণাকেও (উবিনীগ) অনেকে এনজিও বলেই বর্ণনা করে থাকেন।

তাঁর আক্ষেপ, ‘জনগণের পক্ষ থেকে কোনো গণপরিষদ, গণশুনানি বা প্রতিনিয়ত সংলাপ তো দেখা যাচ্ছে না।’ অথচ যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, সেগুলোর কাজের প্রকৃতি অনুসরণ করলে, এমনকি প্রতিবেদনের সংযুক্তিগুলো দেখলেও যে কেউ নিশ্চিত হতে পারবেন যে কমিশনগুলো দিনের পর দিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কী ধরনের গণসংলাপের মধ্য দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালা তৈরি করেছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রায় ১ হাজার ৪০০ অংশীজনের কথা শুনেছে এবং ৪৫ হাজার মানুষের ওপর জনমত সমীক্ষা করেছে।

আমার লেখায় ‘সংবাদমাধ্যমকে একপ্রকারের “সরকারি বা করপোরেট স্বাধীনতা” দেওয়ার চিন্তা ফুটে উঠেছে। যেখানে জনগণের তথ্য নিরীক্ষণের অধিকার ও জনগণের ভাষ্য নির্মাণের অধিকার মোটেও স্বীকৃত নয়’ বলে তিনি যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তার ভিত্তি কী, তা আমি বুঝতে অক্ষম। ভোক্তা তথা জনগণের কাছে গণমাধ্যমের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যেমন বিশদে পর্যালোচনা করা হয়েছে, তেমনই সুস্পষ্ট করণীয়ও তাতে সুপারিশ করা হয়েছে। আর গণমাধ্যমের মালিকানাই যে বর্তমানের সমস্যার মূল, বিশেষত কালোটাকার মালিক ও মাফিয়াগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিতে কী করা উচিত, তা-ও নির্দিষ্ট করে ওই রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে।

তিনি লিখেছেন, রাষ্ট্রীয় বিধিমোতাবেক আইন প্রণয়নের অধিকার, এমনকি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হরণ করার অধিকারও রাষ্ট্রের আছে। কাজটা রাষ্ট্র করে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’ নামক আইনি ধারণা দিয়ে। তিনি সম্ভবত খেয়াল করেননি যে আমরা এই বিধিসম্মত নিষেধাজ্ঞার সীমাও সংবিধান থেকে তুলে দিতে বলেছি। আমরা বলেছি, দেশ যদি এবং যখন কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে, কেবল তখনই মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিধিসম্মত নিষেধাজ্ঞা আরোপ গ্রহণযোগ্য হতে পারে, অন্যথায় নয়।

তাঁর গণপরিষদ নির্বাচনের কথা থেকে অনুধাবন করি যে তিনি নির্বাচনের বিরুদ্ধে নন এবং নির্বাচনকে জনগণের মতপ্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে স্বীকার করেন। গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ী জনগণ কোন নির্বাচন চায়, তা নিয়েও তো বিতর্ক রয়েছে।

তিনি যেমন গণপরিষদের প্রসঙ্গ টেনেছেন, তেমনি অনেকে বলেছেন গণভোটের কথা। আর পুরো স্বৈরশাসনের আমলে রাজনৈতিক বিরোধিতায় যারা কমবেশি সক্রিয় ছিল, সেসব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক গোষ্ঠী সবার আগে সংসদীয় নির্বাচনেই গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন সহজ বলে যুক্তি দিয়েছে।

গণ-অভ্যুত্থান ছিল ছাত্র-জনতার এক বৃহৎ ঐক্যের ফল, কিন্তু স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই কোনো ঐকমত্য তখনো ছিল না, এখনো হয়নি। কোনো একক বিপ্লবী নেতৃত্বও প্রতিষ্ঠা পায়নি। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের সংস্কারসূচির আলোচনাকে তিনি প্রতিবিপ্লব অভিহিত করতেই পারেন।

কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা ও পাঠচক্রভিত্তিক সংগঠন প্রতিবিপ্লব নস্যাৎ করে যদি প্রকৃত বিপ্লব ঘটাতে পারে, তাহলেই তাঁর এসব সমালোচনা সার্থকতা পায়। কথিত ইনসাফ কায়েমের ব্যর্থ রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বরং ক্লান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়।

মতামত লেখকের নিজস্ব

সূত্র, প্রথম আলো