ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিকে আরো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছেন। তার এই পুনঃআরোহণের অন্যতম পরিণতি হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোসহ অনেক দেশে ওপর কড়া বাণিজ্য শুল্ক আরোপ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে, যা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি অর্থনৈতিক নীতিই নয়, বরং একটি কূটনৈতিক বার্তাও। এটি বিশ্বব্যাপী প্রতিদ্বন্দ্বী ও মিত্র দেশগুলোর প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের এক ধরনের বাণিজ্যিক অবস্থান—যেখানে অর্থনৈতিক সুবিধার চেয়ে ভূরাজনৈতিক হিসাবনিকাশ ও অভ্যন্তরীণ ভোটব্যাংক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বাণিজ্য শুল্ক কোনো নতুন বিষয় নয়। ১৯৩০ সালের বিশ্বমন্দার প্রাক্কালে আমদানি রোধে উচ্চহারে শুল্কারোপের মাধ্যমে আলোচনায় আসে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০), চীনের ওপর আরোপিত লক্ষাধিক কোটি ডলারের আমদানি শুল্ক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বাণিজ্য ঘাটতির অভিযোগ এনে শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা ছিল বহুল আলোচিত। ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ‘বাজার রক্ষা’ নামক যৌক্তিকতা দেখিয়ে উচ্চহারে শুল্কারোপ শুরু করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই শুল্ক বাড়ানো হয়েছে মূলত তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং জাহাজ নির্মাণসামগ্রীর ওপর। মূলত এই পণ্যগুলো রপ্তানি করে ২০২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতিতে শুল্কারোপ একটি বহুল ব্যবহৃত উপকরণ। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, সদস্যরাষ্ট্রগুলো নির্ধারিত ট্যারিফ বাউন্ডের বাইরে শুল্কারোপ করতে পারে না, তবে জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন রক্ষা বা ব্যালান্স অব পেমেন্ট সমস্যার কারণে অস্থায়ীভাবে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এই আইনি কাঠামোকে পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে শুল্ককে একটি ‘চাপ সৃষ্টির অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। চীনের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি চুরি ও অবাধ বাণিজ্যের অভিযোগ এনে যেভাবে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপ করা হয়েছিল, ঠিক তেমনি দক্ষিণ এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ, যারা শ্রমনির্ভর উৎপাদনে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের চাকরি ‘নষ্ট করছে’—এই অজুহাত তুলে তাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চীনঘেঁষা কৌশল, রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার নিয়ে নানামুখী উদ্বেগ, এই সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে বলে কূটনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে, ২০২৫ সালে তার ঘোষিত ট্যারিফ ও শুল্কারোপ নীতিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের নানা দেশ প্রতিশোধমূলক এবং প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক উত্তেজনার জন্ম দেয়।
ইউরোপীয় কমিশন এই সিদ্ধান্তকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নীতিমালার পরিপন্থী বলে ঘোষণা দেয় এবং পাল্টা শুল্কারোপের হুমকি দেয়। প্রায় ৩০ শতাংশ জার্মান কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ স্থগিত করেছে এবং ১৫ শতাংশ কোম্পানি সম্পূর্ণভাবে বিনিয়োগ বাতিল করেছে। চীনের পণ্যের ওপর শতকরা ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্কারোপ করে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রপ্তানি ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে প্রায় ৩৫ শতাংশ হ্রাস পায়। তবে চীন তাৎক্ষণিকভাবে ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার বাজারে প্রবেশ করে তাদের রপ্তানিকে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়। চীনা সরকারও পাল্টা শুল্কারোপ করে, যার আওতায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন পণ্যের ওপর ৩৪ দশমিক থেকে ১২৫ দশমিক পর্যন্ত শুল্ক ধার্য করা হয়। বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো, যেমন ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি এবং উন্নয়ন-সহযোগিতা হ্রাস করার ফলে আফ্রিকার লেসোথো এবং ঘানার মতো দেশগুলোর এক্সপোর্ট গ্রোথ রেট ২০২৫ সালের মধ্যেই ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশ কিছুটা টিকে থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যায় এবং শুল্কবিহীন প্রবেশাধিকার হুমকির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিবাণিজ্য দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে পোশাক খাতেই ছিল প্রায় ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে বিশ্বের রপ্তানিকারকদের ওপর ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপ করেছেন। এই শুল্কনীতির ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এই খাত দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ সরবরাহ করে এবং দেশের মোট শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ, প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪ লাখ এবং পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষ কাজ করে, যাদের অনেকেই গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের সদস্য, যারা কর্মসংস্থান হারাবে। ভিয়েতনাম, জর্ডান কিংবা মধ্য আমেরিকার দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশ এই কর সুবিধা হারালে বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বড় বড় ব্র্যান্ড ইতোমধ্যে বিকল্প দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকোতে সোর্সিং শুরু করেছে। চামড়াজাত পণ্য ও জুতাশিল্প খাত থেকে ২০২৪ অর্থবছরে প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রমুখী। কিন্তু উচ্চশুল্কের ফলে এসব পণ্যের জন্য ইতোমধ্যে বিকল্প দেশ হিসেবে ভারত ও ভিয়েতনামের প্রতি আমদানিকারকদের ঝোঁক বৃদ্ধি পেয়েছে। হোম টেক্সটাইল, হালকা প্রকৌশলজাত পণ্য ও আইটি পরিষেবা, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং জাহাজ নির্মাণ খাতে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
রপ্তানির সংকোচনের প্রভাবে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমে যাবে ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেবে, দারিদ্র্যহার বাড়বে এবং সরকারের ওপর সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় বেড়ে যাবে; কর আদায় কমবে, ভ্যাট এবং করপোরেট ট্যাক্সে ঘাটতি পড়বে। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যে, যা বাজেট ঘাটতিকে আরো বাড়াবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাবে। এই চাপ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, আমদানি ব্যয় ও মুদ্রাবিনিময় হারে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এক কথায় এই শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, যদি এখনই কার্যকর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় (২০১৭-২১) যুক্তরাষ্ট্রের করনীতি আমূল পরিবর্তনের ফলে ট্যাক্স কাট এবং জবস আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট করহার ৩৫ থেকে ২১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশ যেহেতু একটি নিম্ন করহারের দেশ, তাই গ্লোবাল মিনিমাম ট্যাক্স অন ইনকাম (জিএলটিআই) ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহী হয়ে পড়ে, যার পরিণতিতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে এফডিআই প্রবাহ ছিল ১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রায় ১৩ দশমিক কম।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র হলেও, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ, যেখানে পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এই শুল্কনীতির ফলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং রপ্তানির প্রতিযোগিতা হ্রাস পায়। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সটাইল আমদানিতে যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপিত হয়, তাও বাংলাদেশের মতো এলডিসি রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের আউটসোর্সিং নীতিতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের Business Processing Outsourcing (BPO) রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৯ শতাংশ, যেখানে পূর্ববর্তী বছর তা ছিল ১৭ শতাংশ। কর রাজনৈতিক পরিবেশের অস্থিরতা বহুজাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। সুতরাং ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে ৩৫ শতাংশ কর আরোপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে প্রথম মেয়াদের চেয়ে আরো ভয়াবহ হবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা চলমান আছে। সরকারের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এটি পুনর্বিবেচনা করা হবে।
এরপরও অর্থনীতির এই সম্ভাব্য প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে আমাদের কৌশলগত রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি (ডিটিএএ) অনুযায়ী, দুই দেশে দ্বৈত কর এড়াতে কিছু ছাড় রয়েছে, কিন্তু জিএলটিআই কর যুক্তরাষ্ট্রে কর ফেরত পাওয়ার পথকে প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবার এই চুক্তির আলোকে জিএলটিআই কর পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘High Tax Jurisdiction’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কূটনৈতিকভাবে কাজ করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কর হারকে প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর খাতে দীর্ঘমেয়াদি কর অবকাশ সুবিধা চালু করা যেতে পারে। আইএলও এবং বাংলাদেশের চুক্তির আওতায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড রিভিউ কমিটিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ট্রাম্প প্রশাসনের একপক্ষীয় কর ও বাণিজ্যনীতির প্রভাব থেকে দীর্ঘ মেয়াদে উত্তরণের জন্য বহুমুখীকরণ, নীতিগত সংস্কার, কৌশলগত কূটনীতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলাই হলো প্রধান চাবিকাঠি।
পাশাপাশি, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানবিক শ্রমব্যবস্থা, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে হবে, বাংলাদেশকে শুল্কের আওতায় ফেলা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির জন্যও অকার্যকর। বাংলাদেশকে তার রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যকরণে জোর দিতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, সৌদি আরব, চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট গড়ে তোলা এবং নিজেদের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। এছাড়া, বাংলাদেশকে প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে উৎপাদন খরচ কমে এবং পণ্যের গুণমান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছায়।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্কনীতির ফলে শুধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশই নয় বরং খোদ আমেরিকা এমনকি বিশ্ব অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জেপি মরগানের গবেষণা অনুযায়ী, ট্রাম্পের শুল্কনীতি যদি দীর্ঘমেয়াদি থাকে, তাহলে তা মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি ১ দশমিক ৮ পর্যন্ত বাড়াতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কমে যেতে পারে। গোল্ডম্যান স্যাচসের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, যদি এই শুল্কযুদ্ধ অব্যাহত থাকে, তাহলে তা আগামী পাঁচ বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাঠামোতে এক প্রকার ‘নব-বৈশ্বিক সংকোচন’ দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
পরিশেষে, ট্রাম্প প্রশাসনের কর ও শুল্কনীতির ফলে উন্নত দেশগুলো কিছুটা স্থিতিস্থাপকতা দেখালেও উন্নয়নশীল এবং ক্ষুদ্র অর্থনীতিগুলোর জন্য এই করনীতি এক দুঃস্বপ্নের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এ ধরনের চ্যালেঞ্জ শুধু অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক এবং কাঠামোগত প্রস্তুতিরও প্রশ্ন। তবে কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতি, কর সংস্কার, বহুমুখীকরণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর রপ্তানির মাধ্যমে এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। এখনই যদি সরকার, ব্যবসায়ী মহল ও কূটনীতিক মহল সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ না নেয়, তবে এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে দেশের আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনের স্বপ্নকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট