পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আপিল বিভাগ প্রায়ই ‘আদালত কলঙ্কিত করা’ (স্ক্যান্ডালাইজিং দ্য কোর্ট) নামে একটি পুরনো ঔপনিবেশিক আইন ব্যবহার করে বিচারকদের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোর একটি, প্রথম আলোর সম্পাদক এবং যুগ্ম সম্পাদককে প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনামূলক একটি প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে সুপ্রিম কোর্টের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। ওই একই মাসে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পঞ্চাশজন লোকের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চান কেন তারা ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে সমর্থন করেছেন। এই ডেভিড বার্গম্যানকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে নিহতদের সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
২০১৫ সালের আগস্ট মাসে সরকারপন্থী দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও এক প্রতিবেদককে জরিমানা করা হয়, এমনকি তাদের স্বল্পমেয়াদি দণ্ডও দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতাসীন দলের দুই মন্ত্রীকেও আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কেবলমাত্র প্রধান বিচারপতি সত্যিই স্বাধীন কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করায়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, কিভাবে বিচারালয় ‘আদালত অবমাননা’ নামে এ অপ্রচলিত আইনের অপব্যবহার করে সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করেছেন।
ব্রিটিশ শাসন থেকে উদ্ভূত এ আইন, যা যুক্তরাজ্যে ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন, বিচারকদের সমালোচনা থেকে রক্ষা করা এবং জনসম্মুখে আদালতের ভুল রায়গুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার হাত থেকে আড়াল করতে বাংলাদেশে এখনো এ আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।
আদালত অবমাননার (দ্য ল’ অব স্ক্যান্ডালাইজেশন) এই আইন ঔপনিবেশিক ইতিহাসে গভীরভাবে প্রোথিত। ব্রিটিশ শাসনামলে আদালত অবমাননার আইন প্রায়ই স্থানীয় জনগণের অসন্তোষ দমনে ব্যবহার করা হতো। ১৮৯৯ সালের ম্যাকলিয়ড বনাম সেন্ট অবিন মামলায় প্রিভি কাউন্সিল এভাবে পর্যবেক্ষণমূলক মন্তব্য করে যে, যদিও ইংল্যান্ডে ‘বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করার মাধ্যমে আদালত অবমাননা’ আইনটি অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল, তথাপি বহুজাতের (কালারড পপুলেশনস) জনগোষ্ঠী সম্বলিত উপনিবেশগুলোতে সেটি বিচার বিভাগের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করতে অপরিহার্য ছিল। এ রায় আদালত অবমাননা আইনের ঔপনিবেশিক এবং বর্ণবাদী যুক্তি প্রকাশ করে, যেটি শাসকের কর্তৃত্ব বজায় রাখা, বিদ্রোহ দমন এবং শাসকগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার একটি কৌশল ছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পরেও বাংলাদেশ এই ঔপনিবেশিক আইনটি ধরে রেখেছে, যার ফলে বিচার বিভাগ সমালোচকদের বিরুদ্ধে ‘আদালত অবমাননার’ আইনের প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো আপিল বিভাগের নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সমালোচনা নিষ্পত্তি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। ২০১০ সালের ১০ মে প্রকাশিত ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশে আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হয়। মাহমুদুর রহমানের পক্ষে আপিল বিভাগে প্রথমবারের মতো যুক্তি উপস্থাপন করা হয় যে, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়ায় ‘আদালত অবমাননা’ আইনের আওতায় উক্ত মামলাটি অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত নয়। আরো যুক্তি দেয়া হয় যে, যুক্তরাজ্যেও এখন এ আইন প্রয়োগ করা হয় না, কারণ ইংল্যান্ডের উচ্চ আদালতগুলো মনে করেন, এটি বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার রায়গুলোরও উল্লেখ করা হয়, যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (বাকস্বাধীনতার পাশাপাশি) সাংবিধানিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত। তবে আপিল বিভাগ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নজিরগুলো উপেক্ষা করেন এবং এগুলোর পরিবর্তে কিছু ভারতীয় রায়ের ওপর নির্ভর করেন, যা সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্য ও কানাডায় আইনগত উন্নয়নগুলো সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
২০১৬ সালের ৬ মার্চ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক, যুগান্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দু’জন মন্ত্রী-খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হকের মন্তব্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন অনুসারে তারা মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডের রিভিউ আবেদনের শুনানিতে প্রধান বিচারপতির অংশগ্রহণ উচিত নয়। মন্ত্রীদের বক্তব্য এমন ইঙ্গিত প্রকাশ করে যে, প্রধান বিচারপতি নিজে শুনানিতে অংশগ্রহণে অযোগ্য হয়ে পড়েছিলেন, কারণ শুনানির সময় তিনি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও অভিযুক্তকারী দলের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, ‘অভিযুক্তদের পাশাপাশি তদন্ত-অভিযোগকারী দলকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন এবং এ মামলায় সরকার/অভিযোগকারীপক্ষ রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে।’ যদিও মন্ত্রীরা প্রথম সুযোগে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু ‘সাংবিধানিক পদে আসীন মন্ত্রীদের অবস্থান বিবেচনা করে’ মন্তব্যকারীগণের সেই ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করা হয়নি। ৪৫ পৃষ্ঠাব্যাপী বিশদ রায়ে আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেন যে, উক্ত দুই মন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টকে ‘অবমাননা’ (স্ক্যান্ডেলাইজড) করেছেন।
আপিল বিভাগ উক্ত বিচারের ক্ষেত্রে এম্বার্ড বনাম ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর অ্যাটর্নি জেনারেল মামলায় প্রিভি কাউন্সিলের রায় বিবেচনা করেন। মামলাটি ছিল ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সুপ্রিম কোর্টের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের রায়, যেখানে ১৯৩৪ সালে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক-ব্যবস্থাপক ও অংশীদারকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। উক্ত মামলায় আদালত রায়ে উল্লেখ করেন যে, তারা এমন বিবৃতি প্রকাশ করেছেন, যার সরাসরি উদ্দেশ্য ছিল এ উপনিবেশে বিচারকদের দ্বারা ফৌজদারি আইনের প্রয়োগকে অবজ্ঞা ও অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখানো। রায়টি এমন এক সময় দেয়া হয়েছিল, যখন ঔপনিবেশিক জনগণের ওপর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ‘আদালত অবমাননা’ আইন প্রয়োগের ক্ষমতা অত্যাবশ্যক বলে গণ্য করা হতো। যদিও ঔপনিবেশিক আদালত সম্পাদককে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন, তথাপি প্রিভি কাউন্সিল আপিলের পর ওই রায় বাতিল করে দেয়। একই সাথে সিদ্ধান্ত দেয় যে সেটি ছিল একটি গুরুতর বিচারিক ত্রুটি।
এম্বার্ড বনাম ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর অ্যাটর্নি জেনারেল মামলার তিন দশক পর ইংল্যান্ডে কোর্ট অব অ্যাপিলের লর্ড ডেনিং আর ভি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশন এক্সপার্ট ব্লাকবার্ন (নাম্বার-টু) মামলায় আদালত অবমাননার বিরুদ্ধে কার্যক্রম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, যদিও আদালতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত শব্দসমূহ অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ছিল। তবে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রায় দানকালে আপিল বিভাগ লর্ড ডেনিংয়ের মামলাটির কোনো উল্লেখ করেননি। আপিল বিভাগ ভুলভাবে দাবি করেন যে ‘বিচার বিভাগের অবমাননা বিশ্বের কোথাও সহ্য করা হয় না’। আদালত এখানে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘ব্যক্তিগতভাবে বিচারকদের আক্রমণ করা অথবা তাদের দায়িত্ব পালনের সময় সদিচ্ছার অভাব এমন অভিযোগ বিশ্বের কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়’। এই পর্যবেক্ষণগুলো ভুল। যুক্তরাষ্ট্রে কখনোই ‘আদালত অবমাননা’ আইনের অংশ ছিল না। সেখানে এটিকে ‘ইংরেজের বোকামি’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মার্কিন বিচারকদের দৃঢ়চেতা হিসেবে গণ্য করা হয়, যারা জনসমালোচনা সহ্য করতে সক্ষম। কানাডাতেও বিচারিক দৃঢ়তা প্রত্যাশিত, কারণ ‘আদালত এতটা ভঙ্গুর নয় যে, যা বিতর্কের তাপে গলে যাবে’। আর ব্রিটেনে ১৯৩১ সালের পর থেকে ‘আদালত অবমাননা’ সংক্রান্ত কোনো সফল মামলা হয়নি। ১৯৮৫ সালে লর্ড ডিপলক এটিকে অপ্রচলিত বলে বর্ণনা করেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আদালত অবমাননা’ আইন বাতিল করে।
আপিল বিভাগ জিম্বাবুয়ের সুপ্রিম কোর্টের ২০০১ সালের রেফারেন্স : প্যাটরিক অ্যান্থনি চাইনামাসা মামলার রায়ের সূত্রও বিবেচনা করেন, যেখানে আদালত অবমাননার ধারণাকে ন্যায্যতা দেয়া হয়েছিল। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ প্রধান বিচারপতি গুব্বে রায় দিয়েছিলেন যে, বিচারকদের অবমাননা আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা দেয়া উচিত, যদিও সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যেমন রাজনীতিবিদ, প্রশাসক বা সরকারি কর্মচারীদের জন্য এ সুরক্ষা প্রযোজ্য নয়, কারণ বিচারকরা জনসমক্ষে সমালোচনার জবাব দিতে পারেন না। উল্লিখিত রায়টি অবশ্যই সেই সময়ের জিম্বাবুয়ের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। তখন রাষ্ট্রটিতে জাতিগত উত্তেজনা চরমে ছিল, রবার্ট মুগাবের সমর্থকরা শ্বেতাঙ্গ মালিকানাধীন বহু কৃষি খামার দখল করে নিচ্ছিলেন। জিম্বাবুয়ের বিচার বিভাগ (যেখানে তখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্বেতাঙ্গ বিচারক ছিলেন) সরকারের ভূমি পুনর্বণ্টন নীতির বিরোধিতা করছেন বলে মনে করা হতো। সেই সাথে একে নির্বাহী ক্ষমতার পরিকল্পনার পথে বাধা হিসেবে দেখা হতো। শেষ পর্যন্ত এ পরিস্থিতি ইংরেজ বংশোদ্ভূত প্রধান বিচারপতি গুব্বেকে অকালে অবসর নিতে বাধ্য করে। রেফারেন্স : প্যাটরিক অ্যান্থনি চাইনামাসা মামলার রায় একটি শ্বেতাঙ্গ বিচারকের দেয়া রায় হিসেবে দেখা উচিত, যা ঔপনিবেশিক আমলের বৈষম্যমূলক ভূমিব্যবস্থাকে রক্ষা করেছিল, যেখানে ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীরা আদিবাসীদের তুলনায় সুবিধাপ্রাপ্ত ছিলেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, আপিল বিভাগ স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রায়ের বদলে একটি জাতিগত অস্থিরতায় আক্রান্ত দেশের (যেখানে বিচারিক প্রক্রিয়ায় জাতপাত ও রাজনীতি তখনো এবং নিঃসন্দেহে এখনো, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে) রায়ের ওপর নির্ভর করা প্রয়োজন বোধ করেছিলেন।
আদালত অবমাননার আইনের প্রতি বিচার বিভাগের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা এ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, বিচার বিভাগের কী এত কঠোর শাস্তির সুযোগ থাকা উচিত? আদালত অবমাননার আইনে সত্যতা কোনো প্রতিরক্ষা হিসেবে গণ্য হয় না। অর্থাৎ, কেউ যদি আদালত সম্পর্কে সত্য কথা বলেন, তবু যদি তা বিচার বিভাগকে অপমানিত করে, তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হতে পারে। তাই বিবেচনা করা দরকার যে, আদালত অবমাননা কী ন্যায়বিচার বা এর মর্যাদায় উপকারী কোনো প্রভাব ফেলেছে, নাকি অন্য উপায়ে এ লক্ষ্য অর্জন করা বেশি সমীচীন হবে। আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা জোরপূর্বক কারাদণ্ড বা জরিমানার ভয় দেখিয়ে আদায় করার প্রবণতা কোনোভাবে কাম্য নয়।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি