গত মাসে বজরঙ্গ দলের পতাকা নিয়ে ব্রিটেনের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা লেসতায় একটি মিছিল হয়। এই বজরঙ্গ দল একটা সশস্ত্র সংগঠন। এই মিছিলটি মুসলিমদের ভয়ভীতি দেখাতেই করা হয়েছে। যদিও কেউ কেউ এটাকে স্রেফ হিন্দুদের উৎসব বলতে চান, কিন্তু মিছিলের সময় ও পতাকার ব্যবহার দেখলে হিন্দুত্ববাদের প্রবল উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। কারণ তিন বছর আগে এ একই সময়ে লেসতায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল।

ইংল্যান্ডের লেসতায় বহু সংস্কৃতির লোক একসঙ্গে বসবাস করে। ২০২২ সালে ভারত ক্রিকেটের একটি ম্যাচে পাকিস্তানকে পরাজিত করার পর ভারতীয় সমর্থকরা ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ বলে স্লোগান দেয়। এরপর শহরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের প্রতিযোগিতাগুলো মাঝেমধ্যেই খেলাধুলার বাইরে গিয়ে জাতীয়তাবাদী বিবাদের রূপ ধারণ করে।

সেই ঘটনাটিকে যেভাবে ফ্রেমিং করা হয়েছিল, এবারের মিছিলকেও সেভাবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্রিটেনের ডানপন্থি মিডিয়া ও থিংক ট্যাংকগুলো এ ঘটনাটিকে ‘সাধারণ’ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। আবার কেউ কেউ শুধু মুসলিমদের দায়ী করছেন।

এ ধরনের উত্তেজনা কোনো নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুদের অনুষ্ঠানগুলোয় উচ্চ শব্দে গান-বাজনার ব্যবহার রয়েছে। এগুলো আবার ‘রক্ষণশীল মুসলমানদের’ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। এসব নিয়েও বিবাদের ঘটনা ঘটে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ২০১৮ সালে একটা ওয়্যার হাউসকে মুসলমানদের এবাদতখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু উচ্চ শব্দ, ভিড় আর পার্কিং সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব নিয়ে উত্তেজনার একপর্যায়ে দেখা গেলে এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ১৫০০ আপত্তিপত্রের অধিকাংশেই মুসলিমবিদ্বেষী কথাবার্তা ছিল।

বিরোধীরা অভিযোগ করেছিলেন, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার মাঝখানে একটি মুসলিম সেন্টার হওয়া উচিত না। মন্দিরের কাছাকাছি হওয়া ছাড়াও নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া ও চরমপন্থার অজুহাত দেখানো হয়েছিল।

সম্প্রতি কমিউনিটি পলিসি ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের সংঘর্ষের ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদ একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। সেই সঙ্গে অসামাজিক আচরণ, বিভাজনমূলক ন্যারেটিভ ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের ব্যাপারও আছে। এ থেকে বোঝা যায়, এ সমস্যার উৎস লেসতার বহু সংস্কৃতির সহাবস্থান নয়, বরং চরমপন্থি আদর্শ ও বাইরের প্রভাবই এর পেছনে দায়ী।

যদিও অনেকে মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আসা অভিবাসীরাই হিন্দুত্ববাদ আমদানি করছেন। কিন্তু এর ফলে স্থানীয়রাও যে চরমপন্থার সঙ্গে জড়িত, তা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) সঙ্গে জড়িত একটি সংগঠন। এ সংগঠনটি উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিমবিরোধী কার্যক্রম চালানোর জন্য কুখ্যাত। এরা ভারতের বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত। ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গেও এরা জড়িত ছিল।

সংগঠনটির যুক্তরাজ্যের শাখাটি লেসতা থেকে পরিচালিত হয়। হিটলার ও নাজি জার্মানির গুণমুগ্ধ সমর্থক এমএস গোলওয়ালকারকে এরা গুরুজনের মতো ভক্তি করে।

‘হেনরি জ্যাকসন সোসাইটি’র একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, লেসতায় বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে আরএসএস সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিরা পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা বয়ান সৃষ্টি করেছিল। তবে প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, র‌্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে পরিচিত কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সরাসরি যোগাযোগ নেই। এটাও অনস্বীকার্য, কিছু মুসলিম অ্যাকটিভিস্ট ভুল তথ্য ছড়িয়েছিল এবং উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেছিল। কিন্তু এই প্রতিবেদনে প্রধানত মুসলমানদেরই সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয়েছিল।

গত মাসের সেই মিছিলটিতে অংশগ্রহণকারী হিন্দুদের সঙ্গে আরএসএস বা অন্য কোনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সম্পর্ক নেই দাবি করলে তা সত্যের অপলাপ হবে।

২০২২ সালের সেই র‌্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই হিন্দুত্ববাদের প্রতীক গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করেছিল। এই পতাকা আরএসএসের কাছেও শ্রদ্ধার বিষয়। জয় শ্রীরাম স্লোগানটি ভক্তিবাচক হলেও বিগত বছরগুলোয় এটি একটি খুনের মন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই স্লোগান দিয়েই ভারতের মুসলিমদের ওপর বিনাবিচারে নির্যাতন চালানো হয়। ২০২২ সালের রায়টের সময়ে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এই স্লোগান দেওয়া হয়েছে।

এগুলো নিছক বিশ্বাস বিবর্জিত কোনো স্লোগান নয়; বরং হিন্দুত্ববাদী আদর্শের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফাঁস হওয়া সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন থেকে আরো স্পষ্ট যে ২০২২ সালের রায়টে হিন্দুত্ববাদীদের ভূমিকা ছিল।

বিবিসি মনিটরিং এক্স-এর দুই লাখ পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখেছে, এ বিষয়ে অর্ধেকের বেশি পোস্ট দেওয়া হয়েছে ভারত থেকে। এ থেকে আন্দাজ করা যায়, একাধিক দেশের সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অপতথ্য ছড়িয়ে সংঘর্ষকে উসকে দেওয়া হয়েছিল।

এই সংঘবদ্ধতা বৃহত্তর সাংগঠনিক কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়। বিগত কয়েক বছরে ইউরোপ এবং আমেরিকায় উগ্র হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা হোয়াইট ‍সুপ্রিম্যাসিস্ট এবং জায়োনিস্টদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুসলিমবিদ্বেষের চর্চা করে। সাংবাদিক আসাদ এশা প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দুত্ববাদীরা ও জায়োনিস্টরা সমন্বয় করে কাজ করে।

একইভাবে ব্রিটেন পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ফাঁস হওয়া একটি প্রতিবেদনে ইউরোপের উগ্র ডানপন্থিদের সঙ্গে চরমপন্থি হিন্দুদের এই সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ব্যাপারটি উঠে এসেছে। এতে নিউ নাজিদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের সম্পর্কের ভয়াবহতা নিয়ে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নরওয়ের সন্ত্রাসী আন্দ্রে ব্রিভিককে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সন্ত্রাসী ২০১১ সালে ৭৭ জন মানুষকে হত্যা করেছিল। তার ইশতাহারে হিন্দুত্ববাদের স্তুতিগাথা ছিল।

যদিও কয়েকটি হিন্দু সংগঠন এই প্রতিবেদনটি অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ইংলিশ ডিফেন্স লিগের টমি রবিনসনের কার্যকলাপ থেকে এই সন্দেহ গাড় হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ২০২২ সালের ঘটনায় রবিনসন সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তিনি মুসলিমদের দোষারোপ করে ‍হিন্দুদের পক্ষে শত শত লোক জড়ো করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।

হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের ইতিহাস আরো আগের। ২০১৬ সালে রবিনসনকে সাউথ হলের একটি মন্দিরে তাকে বক্তৃতা করতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর রবিনসনসহ অন্যকিছু উগ্র ডানপন্থিরা হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে মিলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর কাজে অংশগ্রহণ করেছিল।

যুক্তরাজ্যের এ ঘটনা বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহেরই প্রতিফলন; উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা অন্য উগ্রবাদীদের সঙ্গে নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তাই লেসতার এ ঘটনাকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটিকে উগ্রবাদী আদর্শের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রমের ফসল হিসেবেই দেখতে হবে।

মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা

সূত্র, আমার দেশ