সময়ের পরিক্রমায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে ২৪-এর ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত হয়। ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। দেশের জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। গত বছরের জুলাই মাসে আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলো স্মরণ করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে বিচিত্র আঙ্গিকে। সরকারের পক্ষে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের পতন দিবস হিসেবে উদযাপনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সকলেই। এরই মধ্যে হঠাৎ করে রাজধানীর আকাশে কালো ধূম্রজাল সৃষ্টি হলো। বিমান বাহিনীর একটি জঙ্গী বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অনেক কোমলপ্রাণ অনেক শিশু-কিশোরের মৃত্যুর মতো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেল। শিক্ষক-কর্মচারী, অভিভাবক কেউ বাদ যায়নি। এমন অস্বাভাবিক দুর্ঘটনা জাতিকে গভীর শোকের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে। শোকে মাতম সন্তান হারা মা-বাবারা। বিষয়টি নাড়া দিয়েছে দেশবাসীকে, নাড়া দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। কারণ, বিমান দুর্ঘটনা আবাসিক এলাকায় এটি প্রথম। মর্মান্তিক এ বিমান দুর্ঘটনায় কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মৃত্যু জাতিকে ভীত বিহ্ববল করে তুলেছে। আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে দেশের অভিভাবক, মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনদের। মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীদের হারানোর শোকে আর্তনাদে ফেটে পড়েছে গোটা দেশ। আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে বিশ্বময়। এমন একটি সময় মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটল যখন গণভ্যুত্থানের বছর পূর্তি অতি সন্নিকটে। এমন একটি হৃদয় বিদারক ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি মহল ভিন্ন দিকে পরিস্থিতি নেয়ার চেষ্টা করছে। গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোকে বিভেদের মধ্যে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। এহেন পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে ইস্পাত কঠিন সিসা ঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

দেশ এবং জাতির প্রত্যাশার বিষয় হচ্ছে, এমনই একটি আহ্বান বলিষ্ঠ কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথায়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও ঘটনা পরম্পরায় দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েক দিনে ১৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে তিনি সকলকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন। ফ্যাসিবদী শক্তি যাতে নতুন করে কোনো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরে আমাদের আয়োজন ছিল সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে নিয়ে অতীতকে স্মরণ করা, সে জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম। এতে করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের মধ্যে ঐক্যটা দৃশ্যমান হবে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে’। গত ২২ ও ২৩ জুলাই বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘মত ও দর্শনগত পার্থক্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যকে আরও দৃশ্যমান করা জরুরি। তা না হলে তারা এটাকে সুযোগ মনে করছে’। বৈঠকে অংশ নেওয়া সকল দল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও গণ ঐক্য অটুট রাখার বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টাকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান। নেতৃবৃন্দ সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে নির্বাচনকে সামনে রেখে ও ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করতে আরও নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সর্বদলীয় সভা আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছেন।

রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, দেশকে ধ্বংসে পরিণত করে পালিয়ে যাওয়া পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশে পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত এবং গোয়েন্দা ও প্রশাসনিক কিছু দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব দুর্বলতা চিহ্নিত করে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে। তারা বলেছেন, সরকারের উচিত প্রশাসনকে আরো কঠোর এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা জোরদার করা, যাতে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো বলেছেন, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের কোনো স্থান থাকবে না। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য অটুট রাখতে হবে এবং দেশের প্রতিটি শহরে, গ্রামে-গঞ্জে, বন্দরে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তাহলে অতীতে আন্দোলনের সকল অর্জন বৃথা হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় দেশ নতুন করে ষড়যন্ত্রের মুখে পতিত হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ গবেষক ও কলামিস্ট।

সূত্র, ইনকিলাব