আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন আমলাতন্ত্রের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে শিক্ষকরা হামজা আলাভির ‘উপনিবেশ-উত্তর সমাজে রাষ্ট্র (The State in Post-Colonial Societies, New Left Review, 1972)’ বিষয়ক তত্ত্বটি মনোযোগসহ আলোচনা করতেন। হামজা আলাভির তত্ত্বটি বিশেষ করে তৎকালীন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে আমলাতন্ত্রের ‘অতি-বিকাশ’ (ওভারডেভেলপমেন্ট) বিষয়ে রচিত। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, একটি উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের অতিরিক্ত বিকাশ ঘটে এবং এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আমার এই লেখাটির উদ্দেশ্য সেই কারণগুলো ব্যাখ্যা করা নয়, বরং ৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে কেন ‘অতি বিকশিত’ আমলাতন্ত্র এখনো প্রাসঙ্গিক, তা বোঝা এবং তার পরিণাম উপলব্ধি করা। বাংলাদেশে ‘অতি-বিকশিত’ আমলাতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে গেলে আলাভির তত্ত্বটির সামান্য আলোকপাত করা অত্যাবশ্যক। আলাভি যুক্তি দিয়েছেন, একটি উপনিবেশ-উত্তর সমাজে (যেমন : বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো ‘মেট্রোপোল’ বা ‘শ্রেণি’ শক্তির প্রবল উপস্থিতি। তিনি বলেছিলেন, উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী সামরিক-প্রশাসনিক কাঠামো (অ্যাপারেটাস) উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। এ ছাড়া জনগণের ট্যাক্সে তৈরি বাজেটের একটি বড় অংশ রাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিকভাবে নির্দেশিত ‘উন্নয়ন’ কার্যকলাপে বরাদ্দ ও ব্যবহার করে। ফলে উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রের ‘কেন্দ্রীয়তা’ (centrality) বলতে মূলত রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের ‘কেন্দ্রিকতা’ই বোঝানো হয়।

উপনিবেশ-উত্তর সমাজে আমলাতন্ত্রকে আলাভি ‘অলিগার্ক’ বলে অভিহিত করেছেন, যেখানে এটি অন্যান্য সামাজিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ থেকে তুলনামূলকভাবে স্বাধীন ও ক্ষমতাবান থাকতে চায়। সমাজে শক্তিশালী অন্যান্য শক্তি, যেমন রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া প্রভৃতির অনুপস্থিতি অথবা দুর্বল উপস্থিতি অবশ্যই রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের স্বাধীনতার মাত্রাকে প্রভাবিত করে, অর্থাৎ ‘অতি বিকশিত’ হতে সাহায্য করে। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে একদিকে নব-আঙ্গিকে ‘বাকশাল’ কায়েমের চেষ্টা, একদলীয় নিয়োগবাণিজ্য, বিরোধী দল, এনজিও, সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব বিলীন করার প্রচেষ্টা, কণ্ঠরোধ করা মিডিয়া বা দালাল মিডিয়ার সৃষ্টি—সব মিলিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং সমাজে অন্যান্য শ্রেণি বা গোষ্ঠীর দুর্বল উপস্থিতি রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রকে অতিমাত্রায় শক্তিশালী হতে সহযোগিতা করেছে। এই পরিস্থিতির কারণে আজও আমাদের সমাজে আমলাতন্ত্রের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রের কার্যক্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক নিয়ম ও সংস্কারের আড়ালে চলে যাচ্ছে, যা সমাজের অন্য শক্তিগুলোর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তবে এনবিআরের কার্যক্রমের রাজনৈতিক ব্যবহারসহ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে ট্যাক্স সিস্টেমের আধুনিকীকরণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, সেবা নিশ্চিতকরণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, দায়িত্বের সুস্পষ্ট বণ্টন, কর আদায় বৃদ্ধি, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট প্রতিরোধ, বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন প্রভৃতির ওপর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ।

সরকারের মতে, ‘গত ৫০ বছরের বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত এনবিআর ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে’ (স্টার অনলাইন রিপোর্ট, ১৩ মে, ২০২৫)। ফলে চলতি বছরের ১২ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এই দুটি বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন করে আসছেন। গত ২৫ জুন আমরা দেখলাম, ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের নির্ধারিত আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জুন, ২০২৫)। সেইসঙ্গে তারা ‘মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি’ এবং চলমান ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক দল আর পেশাজীবী সংগঠনের কার্যকলাপের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের দাবিগুলো উত্থাপন এবং সেগুলোর বাস্তবায়নে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের সদস্যরা তাদের চাকরিবিধির কারণে সচরাচর রাজনৈতিক দলের আদলে প্রতিবাদ জানাতে পারে না। ফ্যাসিস্ট যুগের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, তখন পুলিশই ‘দেশের রাজা’ এই ধারণাকে জনগণের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি মহিলা প্রশাসকদের ‘স্যার’ সম্বোধন করতে বাধ্য করার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা বুঝেছি, এ ধরনের আচরণ ও নিয়মের পরিণাম কখনোই ইতিবাচক হয়নি। যেকোনো কিছুর অতিরিক্ত বৃদ্ধি যে সেটা ভেঙে পড়ার পূর্বলক্ষণ, তা আগস্ট অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হওয়ার ঘটনা থেকে বোঝা যায়। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, যা প্রমাণ করে, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য দায়িত্বশীল ও দক্ষ জনবল এবং জনকল্যাণকর ও সঠিক নীতির গুরুত্ব কতটা অপরিহার্য।

যেকোনো কারণে ক্ষুব্ধ হলে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিবাদ করতেই পারেন, তবে এটি একটি অভ্যুত্থানের ফলে গঠিত সরকারকে উপেক্ষা বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা প্রদর্শন করে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। বন্দর বন্ধ করে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে, কিংবা নিকট ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদের ভবিষ্যৎ চলার পথ কণ্টকাকীর্ণ করে দাবি করা কতটুকু যৌক্তিক ও পেশাগতভাবে সঠিক, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এ ছাড়া এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কঠোর কর্মসূচি’ বিগত ফ্যাসিবাদের দোসর ব্যবসায়ীদের ইন্ধনে চলছে এবং এটি একটি রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা বলে দাবি করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ (আমার দেশ, ২৫ জুন ২০২৫)। ভবিষ্যতে ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের জন্যও এনবিআরের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কঠোর আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।

বিশ্বজুড়ে ডিজিটালাইজেশন, প্রশাসনিক সংস্কার ও উদ্ভাবনের জোয়ার বইছে সর্বত্র এবং বাংলাদেশেও জেনারেশন-জি (জেন-জেড) পুরোনো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অবসান দেখতে আগ্রহী। তবে দেশের আমলারা এই পরিবর্তনের দাবি ও সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে পুরোনো রীতিতে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার পথে থাকবেন, অথবা আগের মতো তাদের কমফোর্ট জোনে থেকে কাজ করা বেছে নেবেন—এটি কতদিন সম্ভব হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : প্রফেসর, ওয়েস্টার্ন নরওয়ে ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স এবং সাবেক অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়: মতামত

সূত্র, আমার দেশ