১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ নানা কারণে আমার মনে গেঁথে আছে। মনে আছে, সাদা হাফ শার্ট পরা ফিল্ড মার্শাল আইউব খাঁর রণাঙ্গনে যুদ্ধ পরিচালনার দৃশ্য। সবচেয়ে বেশি মনে থাকার কারণ, এই যুদ্ধে বাঙালি সেনা অফিসার এবং জেসিও/এনসিওদের অমিততেজী যুদ্ধের কারণে। তার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা আব্বা ও চাচাদের মুখে শুনেছি। আমাদের জেনারেশনের প্রথম যুদ্ধ ছিল ১৯৬৫-এর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সময় আমার চাচা আবদুল বারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন হাবিলদার ছিলেন। চাচি ও দুই ছেলে পিনু এবং কাক্কুকে নিয়ে থাকতেন শিয়ালকোট সেনানিবাসে। চাচা ও চাচির মুখে অনেক শুনেছি ওই যুদ্ধের কথা। ওই যুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের সাহস এবং দেশপ্রেম দেখে মুগ্ধ হন পশ্চিম পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তারা। ফলে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মধ্যমণী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনেও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আবার ভারতীয় এবং পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের চমকে দেয় তাদের বীরত্বের মাধ্যমে।
ইতিহাসের গভীর জ্ঞানসম্পন্ন কায়েদে আজম জানতেন বাঙালিদের এই সামরিক মনোবলের ইতিহাস, যারা ভারতবর্ষে মোঘল বাহিনীর দৌর্দণ্ড প্রতাপকে একমাত্র বাংলাতেই সফলভাবে রুখে দিয়েছিল। তাই তো ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নতুন করে উদ্বোধন করার অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত অভিভাষণে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘বাঙালিরা সবসময়ই একটি যোদ্ধার জাতি। তবে তাদের নিরস্ত্র করেছিল ব্রিটিশরা। আজ সময় এসেছে বাংলার সেই সামরিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করার।’ (সূত্র : কায়েদে আযম, সিলেক্টেড স্পিচেস)
এই ঐতিহাসিক সত্যটি আর একজন জানতেন। তিনি হলেন ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেকশ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামসহ এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় ডাকলেন জেনারেল মানেকশকে। ইন্দিরা এপ্রিল মাসেই যুদ্ধ শুরু করে হায়দরাবাদের মতো পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশ দখল করার ব্যাপারে মানেকশর মতামত জানতে চাইলেন। জবাবে মানেকশ বললেন, এখন যদি তাকে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করতে বলা হয়, তাহলে ভারতের পরাজয় একশ ভাগ নিশ্চিত। অস্বস্তিতে পড়লেন ইন্দিরা ও জগজীবন রাম। মানেকশ বললেন, ‘তবে আমাকে আপনারা যদি আর ছয় মাস সময় দেন, তাহলে আমাদের সাফল্য ১০০ শতাংশ সুনিশ্চিত।’ তার এই ছয় মাস সময় চাওয়ার মাহাত্ম্য ভারতীয় প্রতিরক্ষা কৌশলে আজও এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে আছে।
কোনো কোনো সমরবিদ ও যুদ্ধকৌশলী তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, পরবর্তী শীত মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিমালয়ের হিমবাহগুলো বরফাচ্ছাদিত হয়ে গেলে সীমান্ত দিয়ে সম্ভাব্য চীনা অনুপ্রবেশ প্রাকৃতিকভাবেই অসম্ভব হয়ে পড়ত এবং সেই হিসাব থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালানোর সময় আর ছয় মাস বাড়ানোর প্রস্তাব দেন মানেকশ। কিন্তু এই সত্যটি না মানেকশ কোনো বইতে বা বক্তৃতায় উল্লেখ করে গেছেন, না কোনো গবেষক সত্যটি তুলে ধরেছেন। আসল সত্যটি হলোÑমানেকশ জানতেন দুর্ধর্ষ বাঙালি সেনা অফিসার, জোয়ান বা মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাদের আর অস্ত্র ও প্রাণক্ষয় করে বাংলাদেশ দখল করার প্রয়োজন হবে না। কারণ, বাঙালিরাই তাদের দেশ স্বাধীন করার জন্য যথেষ্ট।
এই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, মুজাহিদ ও বাঙালি পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবলকে আক্রমণাত্মক থেকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হবে। ১৯৭১-এর নভেম্বর নাগাদ ঠিক এটাই ঘটেছিল রণাঙ্গনের বাস্তবতায়। সেটা দেখেছে বিশ্বও। বাঙালি অফিসার ও জওয়ানরা তাদের সীমিত অস্ত্র ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা উপেক্ষা করেই আট মাসের মাথায় পৃথিবীর চতুর্থ সামরিক শক্তিকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করার পর বাকি ১৩ দিনের যুদ্ধ ছিল কার্যত যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ গ্রহণের প্রস্তুতিপর্ব। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, অস্ত্র সহায়তা এবং পেছন থেকে কামানের সমর্থন দেওয়া ছাড়া এক ধরনের বিনাযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
ভারতীয় অধিকাংশ সাবেক সেনাকর্মকর্তা ৭১-এর যুদ্ধস্মৃতি নিয়ে লেখা বইয়ে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের এই যুদ্ধে অসম সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন। এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার জেনারেল জ্যাকব তার স্মৃতিচারণামূলক ‘দ্য সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ে বাঙালি সেনা সদস্যদের উদ্দেশে লিখেছেনÑ‘আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, এই যুদ্ধটা ছিল আপনাদের যুদ্ধ। আপনারা বীরের মতো লড়াই করে আপনাদের দেশকে স্বাধীন করেছেন। আমরা ছিলাম এ যুদ্ধে আপনাদের সহযোগী মাত্র।’
কিন্তু স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব ভারতের পরামর্শে রক্ষীবাহিনী নামে প্যারা মিলিটারি বা মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক বীর সেনাবাহিনীকে পরিণত করেছিল এক ঠুঁটো জগন্নাথ একটি বাহিনীতে। বুলগেরিয়ার দেওয়া কামান (হুইৎজার)-গুলোকে তুলে দেওয়া হয়েছিল রক্ষীবাহিনীর হাতে। এই বাহিনী দিয়ে শেখ মুজিব দেশের প্রায় ৫০ হাজার তরুণ যুবককে ঠান্ডা মাথায় খুন করেন।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধস্মৃতি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যুদ্ধটা ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ দিন চলেছিল। এই যুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার, জেসিও এবং এনসিওসহ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এবং বাঙালি বৈমানিকরা যে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোনো রণাঙ্গনে তা দেখেনি। সাহসিকতা, কৃতিত্ব এবং দেশপ্রেমের যে ইতিহাস গড়েন বাংলাদেশের বীর সৈনিকরা, সেটি দেখে তাজ্জব বনে যায় পাকিস্তানের বাকি চারটি প্রদেশের মানুষ। বিশেষ করে পাকিস্তানের সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী, ওয়েস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, মিলিশিয়া এবং পুলিশ, মুজাহিদরা। এই যুদ্ধের সময় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মোতায়েন ছিল লাহোর সেনানিবাসে। তখন এই বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল হক। যাকে পরে পাকিস্তান সরকার সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব সেতারা-ই-পাকিস্তান উপাধিতে ভূষিত করে। পরে তিনি তৎকালীন বার্মায় (মিয়ানমার) পাকিস্তান দূতাবাসের সামরিক অ্যাট্যাশের দায়িত্ব পালন করেন। (তার পুরো নাম কর্নেল এ টি কে হক) ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক ছিলেন বাংলাদেশের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর বীর কর্মকর্তা মেজর মং (পরে লে. কর্নেল পদে উন্নীত (তথ্য সূত্র : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার/সৌজন্যেÑযুগান্তর ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)।
সেই যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং এই যুদ্ধে অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হন। তার নেতৃত্বাধীন কোম্পানির নাম ছিল আলফা কোম্পানি।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতের সহিংস আগ্রাসন। যেমনটা তারা ঘটিয়েছিল স্বাধীন রাজন্য-শার্সিত হায়দরাবাদসহ পুরো ৫২৬টি স্বাধীন রাজন্য-শাসিত রাজ্যে। ভারতীয় হানাদারদের লাহোর আক্রমণ প্রস্তুতি বিবেচনায় রেখে ৪ সেপ্টেম্বর রাতে লাহোরের ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে প্রথম বেঙ্গল কাসুর জেলার বেদিয়ান এলাকায় (যার রণাঙ্গন পরিচিতি খেমকরন) এক দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে।
এটি ছিল লাহোরে মোতায়েন ১১ পদাতিক ব্রিগেডের অংশ। এই দুর্ধর্ষ প্রথম বেঙ্গল ছিল ডিভিশনের আওতাধীন ১০৬ পদাতিক ব্রিগেডের অংশ। হানাদার ভারতীয় সমর ইউনিটটি ছিল চতুর্থ মাউন্টেইন ডিভিশন। বাঙালি সেনা অধিনায়ক কর্নেল হক ব্যাটালিয়নের চারটি কোম্পানি কোনো ডেপথ (Depth) (গভীরতা) ছাড়াই বিশাল এলাকাটি বেদিয়ান-ওয়াইজল পশ্চিমতীর বরাবর এই ডিফেন্স লাইনের হানাদার এলাকায় খননকৃত বিআরবি ক্যানালের পশ্চিমতীর বরাবর অবস্থান গ্রহণ করে। এই ডিফেন্স লাইনের মাত্র কয়েকশ গজ আগেই দুই দেশের সীমান্ত বরাবর ৬ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টার দিকে ভারতীয় বাহিনী ট্যাংক ও বিমানবাহিনীর সাহায্য নিয়ে প্রথম বেঙ্গলের বেদিয়ান হেডকোয়ার্টার্স এলাকা অতিক্রম করে। কিন্তু প্রতিরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো পজিশনরত দুর্ধর্ষ বঙ্গ-শার্দুলরা ভারতীর হামলা ঠেকিয়ে দেয়।
পাঁচ ঘণ্টা ধরে সম্মুখযুদ্ধে অনেক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে হানাদার ভারতীয় বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। কোনোবারই ভারতীয় বাহিনী বিআরবি ক্যানাল পার হতে পারেনি। বেশ কয়েকজন বাঙালি সৈনিক এখানে শাহাদতবরণ করেন। ওই যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৫টি বীরত্বসূচক পদক লাভ করে, যা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব ইউনিটের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের সিপাহি (পরে অনারারি ক্যাপ্টেন) আবুল হাশেম পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব তকমা-এ-জুরাত লাভ করেন। এর ছয় বছর পর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অনারারি ক্যাপ্টেন হাশেম বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে বাঙালি সৈনিক ও কর্মকর্তাদের সাহসিকতা ও বীরত্বের কথা ফলাও করে প্রচার করে সমসাময়িক বিশ্বের বহু দেশের সংবাদপত্র এবং রেডিও পর্যালোচনা (সূত্র : একটি জাতির জন্ম, সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার যুদ্ধস্মৃতি)।