জুলাই অভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মহাসন্ধিক্ষণ। ১৬ বছরের রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, ফ্যাসিবাদ এবং জনগণের অংশগ্রহণহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে গণজাগরণ ঘটেছে, তা শুধু একটি সরকারের পরিবর্তন নয়, বরং একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। যাকে অনেকেই বলছেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বা বাংলাদেশ ২ দশমিক শূন্য। এই নতুন যুগের সফলতার জন্য জনগণের একান্ত প্রত্যাশা যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পুঞ্জীভূত পারস্পরিক অবিশ্বাস, শত্রুতা এবং অসম্মানের দেয়াল অটুট না থাকে। জাতি চায়, মতপার্থক্যগুলো যেন যুক্তি, তথ্যনির্ভর ও কল্যাণের জন্য হয়; বিরোধিতা যেন হয় সৌজন্যপূর্ণ ও গঠনমূলক। সর্বোপরি দ্বিমতগুলো যেন রাষ্ট্রগঠনের বিকল্প ও উন্নততর চিন্তার সম্ভাবনা বয়ে আনে আর চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব আর রক্তপাতের রাজনীতি পুনঃস্থাপিত না হোক।

ইসরাইলের এআই যুদ্ধের পরীক্ষাগার গাজাইসরাইলের এআই যুদ্ধের পরীক্ষাগার গাজা

৪৭-পরবর্তী পাকিস্তান আমল থেকে শুরু হলেও (গণপরিষদের স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা, যুক্তফ্রন্ট সরকারে মতানৈক্য ও অচলাবস্থা ইত্যাদি) স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে দলীয় প্রতিহিংসার রাজনীতি এক দুঃসহ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। যখনই কোনো দল ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেছে, তখনই প্রতিপক্ষকে দমন করার এক প্রবণতা দেখা গেছে, যদিও এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালী সরকার ও শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার সবাইকে ছাড়িয়ে উচ্চাসনে উপনীত হয়েছে। সংলাপ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি অনীহা, ভিন্নমতকে সরাসরি ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় রাজনীতির আখড়া বানানো; এসবই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর অনাস্থা ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি তৈরি করেছে।

জনগণ গত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী সময়ে প্রত্যক্ষ করেছে, শাসনক্ষমতা মানেই যেন প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো নিশ্চিহ্ন করার এক অপ্রতিরোধ্য মিশন এবং সেই সঙ্গে শাসনক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে স্বৈরাচারী হওয়ার মিশন। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই ধ্বংস করেনি, বরং গণতন্ত্রের মূল স্পৃহা সহনশীলতা এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ন্যূনতম গুণগত মানকেও অদৃশ্য করে দিয়েছে।

দেশের অভ্যন্তরে যখন এমন বিভেদ, অস্থিরতা ও বিরাজ করে, এমন পরিস্থিতিতে দেশের দুর্বলতার সুযোগ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলগুলো। দেশের ভেতরের বিভেদ ও সংঘাত বহিরাগত শক্তির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে, যা দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা দেখেছি, প্রতিবেশী একটি দেশের তৎপরতায় পাহাড়ের অস্থিতিশীলতা থেকে শুরু করে জেএমবির মতো উগ্রবাদের উত্থান, এক-এগারোর মাইনাস টু ফর্মূলাসহ ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লীগের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, হেফাজত ও সাঈদী রায়-পরবর্তী ম্যাসাকারসহ নির্বাচনবিহীন গুম এবং নিপীড়নের স্বৈরাচারী সরকার ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার মতো ঘটনা। এ ছাড়া নানা সময় প্রতিবেশী দেশ কিংবা পশ্চিমের নানা উদ্দেশ্যপূর্ণ অভিযোগকে প্রমাণ করতে দেশেও গুজব ছড়ানো হয়, যেমনটা দেখেছি আমরা ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন-পরবর্তী সময় ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে।

অন্যদিকে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনো রাষ্ট্র হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে দাঁড়াতে পারেনি। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভ তথা বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ বা প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রায়ই পুরোদস্তুর রাজনৈতিক প্রভাব ও জোর-জবরদস্তির শিকার হয়। এ কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অর্ধশত বছর পরও জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে এবং তাদের নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারছে না। এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে, সুশাসনকে ব্যাহত করে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রের ভিত্তিকেই নড়বড়ে করে তোলে। তাই নতুন দিনের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক চর্চায় প্রাধান্য থাকুক প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারিত্ব, স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রতি অটুট সম্মান।

বাংলাদেশ ২.০-এর প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট তথা পলিসি সাজেশনগুলো নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে নিয়মিত সংলাপে বসছে, সেটির সফলতার ওপর নির্ভর করছে দেশের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভবিষ্যৎ। আমরা আশা করি, নতুন দিনের রাজনীতির সূচনা হবে এই ঐকমত্যের মঞ্চ।

জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনাময় সময়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। নতুন প্রজন্ম তথা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রাণভোমরা তরুণদের প্রত্যাশা রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে, জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে একসঙ্গে কাজ করবে। ঠিক যেমনটা করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন কিংবা জার্মানির মতো উন্নত বিশ্ব। এমনিক পাশের দেশ ভারতের শত সমস্যা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়ে পূর্ণ ঐক্য রয়েছে, যা আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর।

আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু তা যেন আদর্শগত ও নীতিনির্ভর হয়, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা বিদ্বেষজনক নয়। ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জায়গা থেকেই মূলত পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন হলে নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় প্রবেশ করে রাজনৈতিক দলগুলো। এর কিছুটা হলেও আমরা দেখছি গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্য থেকে। বিশেষ করে নারী নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে অনলাইনে যে কদর্যপূর্ণ আক্রমণ চালানো হয়েছে বিএনপি-জামায়াত ও বামপন্থি দলগুলোর কর্মীদের পক্ষ থেকে তা কোনোভাবেই সুস্থ এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য শোভনীয় নয়। দলগুলোর উচিত শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের সমন্বয়ে তার কেন্দ্রীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে তৃণমূলপর্যায় পর্যন্ত অফলাইন এবং অনলাইনে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল মতবিরোধের উপায় সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা এবং বোধ তৈরির চেষ্টা করা।

মূলত রাজনৈতিক সহাবস্থান শুধু একটি সর্বজনকাম্য আচরণ নয়, এটি একটি কৌশলগত অপরিহার্যতা। যদি আমরা জাতীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক বলে বিষয়গুলোয় দলীয় বিভাজনের চর্চা থেকে বেরিয়ে না আসি, তবে কোনো জাতীয় লক্ষ্যেই আমরা একমত হতে পারব না, তা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হোক বা দুর্নীতি দমন, শিক্ষা সংস্কার হোক বা জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করা। একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিই শুধু এর চলার পথের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যেতে পারে। আর বিভেদমূলক রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ থেকে নাগরিকবান্ধব রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরের পথ শুধু রাজনীতিবিদদের ওপরই নির্ভরশীল নয়। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষাবিদ এবং তরুণ প্রজন্ম সবারই এই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনে সক্রিয় অংশীদার হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রথমত, রাজনৈতিক সংলাপ ও শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত এবং অর্থবহ সংলাপের আয়োজন করা হবে, যেখানে পরস্পরের বক্তব্য শোনা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হবে, যা আমরা কিছুটা হলেও দেখতে পাচ্ছি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে। দ্বিতীয়ত, সব দল মতের নেতাকর্মীদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা করার সময় অবশ্যই শিষ্টাচার বজায় রাখতে হবে এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ পরিহার করতে হবে। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা ও তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের প্রবণতা বাড়াতে হবে গণমাধ্যমের। এ ছাড়া কিক্লবেইটনির্ভর হেডলাইন ও বিভেদ সৃষ্টিকারী সংবাদ প্রচার থেকে সতর্ক থাকা উচিত। তৃতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তথা রাজনৈতিক ও সামাজিক সহনশীলতায় বিশ্বাসী হয়। চতুর্থত, এনসিপির মতো অন্যান্য দলেরও উচিত হবে নতুন দিনে রাজনীতি নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সততা, শিষ্টাচার এবং নীতিনিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মেধা ও যোগ্যতাই যেন নেতা নির্বাচনের মূল ভিত্তি হয়। সবশেষে, দেশের মানস গঠনের বিভেদ তৈরি করা ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের দলীয় ব্যাখ্যার পরিবর্তে, ঐক্য ও সততাভিত্তিক একটি সর্বসম্মত ঐতিহাসিক পাঠ নিশ্চিত করতে হবে, যা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিকে মজবুত করবে।

২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রায় ২ হাজার শহীদ ও ৩০ হাজার আহততে মুহ্যমান জাতি ভবিষ্যতে আর যেমন কোনো স্বৈরাচার দেখতে চায় না, তেমনি কোনো বিভক্তিও চায় না, চায় ঐক্য; শত্রুতা নয়, চায় সহযোগিতা; অবিশ্বাস নয়, চায় আস্থা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই জাতির এই মনোবৃত্তিকে বুঝতে পারে এবং জনগণের প্রত্যাশাকে মূল্য দেয়, তবে বাংলাদেশ শুধু একটি পরিবর্তিত রাষ্ট্র হবে না, এটি হবে সম্মান, সৌজন্য এবং নৈতিকতাময় রাষ্ট্রের এক অনন্য প্রতীক। তাই এখনই সময়, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অসম্মানের রাজনীতিকে ইতিহাসের পাতায় ঠেলে দিয়ে একটি সত্যিকারের সহনশীল এবং নাগরিক অধিকারনির্ভর গণতন্ত্র গড়ে তোলার। তাহলেই হয়তো ৪৭-এর ব্রিটিশ মুক্তি থেকে শুরু করে ৭১-এর স্বাধীনতা এবং ২৪-এর নয়া বাংলাদেশের সব শহীদের আত্ম-কোরবানি ও পঙ্গুত্বের দায় কিছুটা হলেও শোধ করা সম্ভব হবে।

লেখক : এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশন স্টাডিজ, যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি

সূত্র, আমার দেশ