সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রবল হামলার মুখে দেশটির দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদের সরকারের আকস্মিক পতন ঘটে ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর। আর সেদিন থেকেই সিরিয়ার মানুষ স্বৈরশাসকমুক্ত দেশে মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার ও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আকস্মিক এই মুক্তি সিরিয়ার নিপীড়িত মানুষের কাছে ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। কারণ ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্ত নামের গণআন্দোলন ও পরে সশস্ত্র লড়াই প্রায় এক যুগেও সফলতা পায়নি। বরং রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহর সহযোগিতায় বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের দমন করে ক্ষমতা সংহত করেন। এই গৃহযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ নিহত ও প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে তুরস্কসহ প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় নেয়। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) বিদ্রোহীরা মাত্র ১০-১২ দিনের ঝটিকা আক্রমণে আলেপ্পোসহ গুরুত্বপূর্ণ নগরী দখল করেন। এরপর তারা ৮ ডিসেম্বর ভোরেই রাজধানী দামেস্কে পৌঁছে যান। অন্যদিকে, বিদ্রোহীরা রাজধানীতে পৌঁছার আগেই বাশার আল-আসাদ সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেয়।
সিরিয়ার মানুষের কাছে মুক্তির এই মুহূর্তটি ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। এত সহজে এবং বলতে গেলে সস্তায়ই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি মিলবে স্বৈরশাসন থেকে এমন ধারণা ছিল না সিরিয়ার মানুষের মধ্যে। তবে সহজে মুক্তি মিললেও এর মূল্য সিরিয়ার মানুষকে দিতে হবে অনেক বেশি। দেশটির আগামী প্রজন্মকে এই মূল্য পরিশোধ করতে হবে। কারণ দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে দেশটির অবকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, যা পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে জনগণের শারীরিক, মানসিক, মানবিক ও আবেগজনিত যে ক্ষতি হয়েছে, তার মূল্য ডলারে হিসাব করে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না। কারণ অর্থের বিনিময়ে কখনো এই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া যায় না।
তবে এ কথা সত্য, যেখানে একসময় ছিল শুধুই হতাশা, সেখানে এখন দেখা দিয়েছে নতুন ভোর, নতুন আশার আলো। এইচটিএস নেতা আহমদ আল-শারার নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সিরিয়ার ওপর থেকে দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারই যথেষ্ট নয়। দুর্বিষহ অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে হলে সিরিয়ার জন্য আরো অনেক কিছুই করতে হবে। গোষ্ঠীগত সংঘাত ও ইসরাইলি আগ্রাসন স্বৈরশাসনমুক্ত সিরিয়ার নতুন পথচলাকে জটিল করে তুলেছে।
বিশেষ করে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সুয়েইদা প্রদেশে সংখ্যালঘু দ্রুজ জনগোষ্ঠী ও সুন্নি বেদুইনদের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং দ্রুজদের পক্ষ নিয়ে সেখানে ইসরাইলের ব্যাপক হামলা সিরিয়ার নতুন সরকারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ ও দেশটির ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সামগ্রিক এই পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ ও দেশটির প্রবাসীদের রেমিট্যান্স নিয়ে আসার সম্ভাবনা অকালেই নষ্ট হয়ে যাবে।
সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সুয়েইদা প্রদেশের গোষ্ঠীগত সংঘাত থামাতে সক্ষম হয়েছে প্রেসিডেন্ট আল-শারার সরকার। তবে এতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সিরিয়ায় হামলা বন্ধ করতে রাজি হয়েছে ইসরাইল। কিন্তু আগামী দিনে যে আবার এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিরিয়াকে স্থিতিশীল একটি দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে গোষ্ঠী সংঘাত ও ইসরাইলি হামলার অবসান ঘটানো অপরিহার্য। এসব বিষয়কে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করা বা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
লেবানন, সিরিয়া, ইসরাইলসহ এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশে সংখ্যালঘু দ্রুজ জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ইসরাইলে দ্রুজদের সংখ্যা আনুমানিক দেড় লাখ। সিরিয়ার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুজরা একটি। ইসরাইল সিরিয়ার দ্রুজদের রক্ষা করা বা নিরাপত্তার কথা বলে মাঝেমধ্যেই দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। গত সপ্তাহে সুয়েইদা প্রদেশে একজন দ্রুজ ট্রাকচালককে রাস্তা থেকে অপহরণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে সুন্নি বেদুইনদের সঙ্গে দ্রুজদের এবারের সংঘাতের সূচনা হয়। পরে তা বৃহৎ আকার ধারণ করে। আর এই ইস্যুকে ব্যবহার করে ইসরাইল শুধু সুয়েইদা প্রদেশেই নয়, রাজধানী দামেস্কে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েও বিমান হামলা চালায়। সিরিয়ার নতুন সরকার দেশটির সুন্নি-শিয়া, দ্রুজ, আলাবিসহ সব সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজির সঙ্গেও আলোচনা করছে দেশটির সরকার। তাদের এই উদ্যোগের মধ্যেই ইসরাইল দ্রুজদের পক্ষ নিয়ে সিরিয়ায় গোষ্ঠীগত বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে দেশটিকে অশান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের পর সিরিয়ার জনগণের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হলেও সামগ্রিক এই পরিস্থিতিতে ক্রমেই আশাহত হয়ে পড়ছেন তারা। দীর্ঘদিনের গোষ্ঠীগত সংঘাতে বিপর্যস্ত সিরিয়ার নতুন পথচলা মসৃণ করতে হলে দেশটিতে জাতিগত বা গোষ্ঠীগত বিরোধ ও সংঘাতের অবসান ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। এ সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান না করা গেলে সিরিয়া আবার রক্তাক্ত হবে।
এ সমস্যার সমাধান একটি ফেডারেশন গঠন নাকি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, তা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। তবে, দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাশার আল-আসাদের দীর্ঘ স্বৈরশাসন ও গোষ্ঠীগত সংঘাতের ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তারা তাদের দেশকে কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে, সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে স্পষ্ট কোনো ধারণা এখনো তৈরি হয়নি। এটাও সিরিয়ার জনগণের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ আল-শারার নতুন সরকার ঘরে-বাইরের নানা চাপ মোকাবিলা করে দীর্ঘদিনের সংঘাত-সহিংসতায় বিপর্যস্ত দেশকে বিচক্ষণতার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে এখনই চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি। কারণ এ সরকারের সঙ্গে যুক্ত ও সরকারের বাইরে থাকা বিভিন্ন শক্তি তাদের নানা এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও আঞ্চলিক বিভিন্ন দেশ সিরিয়ার বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে দেশটিতে তাদের স্বার্থ রক্ষায়।
তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে স্বৈরশাসনমুক্ত সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা দিয়ে দেশটির পুনর্গঠন ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নে এগিয়ে আসা। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে এ সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে সিরিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সংহতি বিনষ্টকারী অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের চাপের মুখে রাখতে হবে। ইসলামপন্থি হিসেবে ট্যাগ দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখলে সিরিয়া আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, যা মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ভূরাজনীতির জন্যও নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে।
মডার্ন ডিপ্লোমেসি থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী