নির্বাচন কি হবে? মানে আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে, নাকি কোনো অজুহাতে তা পিছিয়ে দেওয়া হবে? লন্ডন বৈঠকের বাস্তবায়ন কি আসলে হবে? এগুলো কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন। লন্ডন বৈঠকের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা কিছুটা কমলেও, আবার তা মনে হয় ফিরে আসছে নির্বাচন নিয়ে নতুন সংশয় দেখা দেওয়ায়।

এই সংশয় তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের আলোচনায় বিএনপির সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক দলের মতভিন্নতা ও সর্বশেষ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য নিয়ে। মৌলিক সংস্কার, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবিতে ইসলামী আন্দোলনের ডাকা এই সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিস অনেকেই দাওয়াত পেলেও বিএনপিকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। তার কারণ হিসেবে আয়োজক ইসলামী আন্দোলন জানিয়েছে, ‘বিএনপি তো সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির বিপক্ষে। সে কারণে আমরা তাদের আমন্ত্রণ জানাইনি।’

সত্য বাবুর ভূত আসুকসত্য বাবুর ভূত আসুক

জুলাই ঘোষণাপত্র ও ‘জুলাই সনদ’ নিয়েও এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিÑএনসিপি জানিয়ে দিয়েছে ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ প্রকাশ করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে আর জুলাই উদযাপনের কোনো নৈতিক বা সাংবিধানিক এখতিয়ার থাকবে না।

একদিকে লন্ডন বৈঠকের পর সরকার বা নির্বাচন কমিশনের দিক থেকে নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ এখনো স্পষ্ট হয়নি। অন্যদিকে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা ও তার বাইরে কিছু রাজনৈতিক দলের জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনসহ কিছু বিষয়ে জোরালো বক্তব্য সামনে আসছে। বিএনপি ও নির্বাচন প্রশ্নে তাদের সমমনা দলগুলোর সঙ্গে কয়েকটি দলের ভিন্ন অবস্থান নিয়ে চিন্তিত অনেকেই। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিকে জোরালো করায় বিএনপিও এটাকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ‘যারা স্থানীয় নির্বাচন ও আনুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবি তুলছে, তাদের একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে; হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অথবা নির্বাচন না হওয়া।’

বিএনপির ভোটের রাজ্যে ভাগ বসাতে চায় জামায়াতবিএনপির ভোটের রাজ্যে ভাগ বসাতে চায় জামায়াত

মোটা দাগে বিএনপির সঙ্গে ছোট দলগুলোর ভিন্নমতের জায়গাগুলো হচ্ছে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন, নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও সাংবিধানিক পদগুলোয় নিয়োগ প্রক্রিয়া, স্থানীয় সরকার নির্বাচন। নারী সংসদ সদস্য ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার ব্যাপারে সবাই একমত। এনসিপি সরাসরি নির্বাচন চাইলেও কেউই কোনো গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা দিতে না পারায় এ বিষয়ে আলোচনা বিশেষ জোর পায়নি। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি নিয়ে বিএনপির ঘোরতর আপত্তি থাকায় সেটার নাম বদলে নতুন প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে চেয়েছে জামায়াতে ইসলাম, এনসিপিসহ কয়েকটি দল। এটাও নানা কারণে হয়তো হালে পানি পাবে না। মূলত বড় আলোচনা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে। এ ক্ষেত্রে ছোট দলগুলোর আগ্রহ বেশি থাকাই স্বাভাবিক। কারণ যেসব দল বর্তমান প্রচলিত ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতির নির্বাচনে কোনো আসনই পায় না, কিন্তু মোট ভোটের হিসাবে কয়েক শতাংশ ভোট পায়, তারা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন হলে কয়েকটি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে যেতে পারে। আবার কোনো দল হয়তো ভোট পেল ৬ শতাংশ। কিন্তু আসন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিন-চারটার বেশি আসন পায় না। তারা হয়তো পিআর পদ্ধতি হলে ৬ শতাংশ ভোটের জন্য তিন-চারটার জায়গায় ৩০০ আসনের মধ্যে ১৮টি আসন পেয়ে গেল। সুতরাং ছোট দলগুলোর এতে যেহেতু লাভ বেশি, তাই তারা এটা চাইতেই পারেন। এটা তাদের লাভ-লসের বিষয়। কিন্তু ছোট দলগুলো তাদের এই লাভের হিসাব না দিয়ে পিআর পদ্ধতির ন্যায্যতা দেখাতে গিয়ে এটাকে সেরা পদ্ধতির মর্যাদা দিয়ে দেয়।

পিআর পদ্ধতি মানেই যে রাষ্ট্র পরিচালনা খুব ভালো হয় আর পিআর না থাকলেই খুব খারাপ হয়ে যায়, ব্যাপারটা তেমন নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের পাশের কয়েকটি দেশের অবস্থা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

নেপালে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা প্রথমবার চালু হয় ২০০৮ সালে, যখন দেশটি রাজতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। এই পদ্ধতি প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।

নেপালে ভোটাররা একটি পৃথক ব্যালটে রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন। দলগুলোর মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বরাদ্দ করা হয়। দলগুলো নির্বাচনের আগে একটি বদ্ধ তালিকা (Closed List) জমা দেয়, যেখানে তারা প্রার্থী নির্বাচন করে। এই তালিকায় নারী, আদিবাসী, দলিত, মুসলিম, পশ্চাৎপদ অঞ্চলসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হয়।

কিন্তু দেশটিতে এ পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু জটিলতা ও সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে দেশটি প্রায়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে। সেখানে পিআর তালিকা দলগুলো নির্বাচনের আগে জমা দেয়। তাই দলকে ভোট দিলেও সংসদে যিনি যাচ্ছেন, তাকে কিন্তু ভোটাররা নির্বাচিত করতে পারছেন না। সেটা নির্ধারণ করে দিচ্ছে দল। ফলে এখানে দলের স্বেচ্ছাচারী হয়ে অযোগ্য লোককে সংসদে পাঠানোর প্রবণতা বাড়তে পারে। এর ফলে যোগ্যতার চেয়ে দলের অনুগত লোক বা স্বজনদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ফলে নেপালে রাজনৈতিক বিভাজন ও জোটভিত্তিক সরকারের অস্থিরতা বেড়েছে। ছোট দলগুলো পিআর পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে সংসদে যাচ্ছে। কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাচ্ছে না। ফলে দলীয় জোট ছাড়া সরকার গঠন সম্ভব হয় না। এতে প্রায়ই সরকার পরিবর্তন, ক্ষমতার লড়াই ও অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে ১৩ বার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এর মানে, গড়ে প্রায় প্রতি দেড় বছরে একবার করে সরকার পরিবর্তন হয়েছে।

এই ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের ফলে নীতিগত স্থিতিশীলতা না থাকায় দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। নেপালে পিআর পদ্ধতির অপব্যবহার ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবস্থাটিকে ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা হয়নি।

শ্রীলঙ্কায় পিআর পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা চালু হয় ১৯৭৮ সালে। ১৯৮৯ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করা হয় এ পদ্ধতি। দেশটিতে জেলাভিত্তিক পিআরব্যবস্থা। দেশকে ২২টি নির্বাচনি জেলায় ভাগ করা হয়। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি জেলায় নির্দিষ্টসংখ্যক আসন বরাদ্দ থাকে। ভোটাররা একটি দলকে ভোট দেন, দলটি জেলার ভেতর কত শতাংশ ভোট পেয়েছে, তার ভিত্তিতে আসন পায়। এরপর দল তাদের প্রার্থী তালিকা থেকে সদস্য নির্বাচিত করে পাঠায়।

শ্রীলঙ্কার পিআর পদ্ধতি দলগুলোর আধিপত্য হ্রাস এবং ভোটের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চালু হলেও এত বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ব্যবস্থাগত দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি।

পাশের দেশ ভারতে কিছু স্থানীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির ব্যবহার থাকলেও লোকসভা বা রাজ্য বিধানসভায় পিআর পদ্ধতি নেই। তারা ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট পদ্ধতিইে নির্বাচন করে। ব্রিটিশ আমল থেকেই দেশটিতে এফপিটিপি ব্যবস্থার প্রচলন ছিল এবং এখনো তাই আছে।

পিআর নেই বলে যে ভারতের নির্বাচনব্যবস্থা শ্রীলঙ্কা বা নেপালের চেয়ে খারাপ বা সেখানে সরকার কম স্থিতিশীল তা তো নয়।

বাংলাদেশ পিআর পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত দেশ নয়। এ পদ্ধতির গণনা ও বোঝা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন বেশ কঠিন হতে পারে। জনগণকে এ পদ্ধতি বোঝাতে অনেক সময় লাগবে। তাই সংগত কারণেই ১ জুলাই ২০২৫ গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিএনপির অনুষ্ঠানে, যেখানে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, তাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান অবস্থায় ও ভৌগোলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য পিআর পদ্ধতির নির্বাচনি ব্যবস্থা কতটা উপযোগী কিংবা উপযোগী কি ন তা ভেবে দেখবেন।

তারেক রহমানের এ অনুরোধ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো বিবেচনায় নেবে। কারণ পিআর জটিলতা করে যদি নির্বাচন পেছানো হয়, তাতে দেশেরই ক্ষতি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যের কারণে যদি নির্বাচন না হয় এবং তা অস্থিরতায় রূপ নেয়, তার সুযোগ নিতে পারে পতিত ফ্যাসিবাদ। দেশ ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে। দেশে পতিত ফ্যাসিবাদ গোষ্ঠী ও ভারতীয় আধিপত্যের পুনরাবির্ভাব ঘটতে পারে। তেমন কিছু ঘটলে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি বা অন্য কেউই নিরাপদ থাকবে না। তাই দেশের স্বার্থে তো বটেই, নিজেদের স্বার্থে হলেও দলগুলো এমন কিছু করবে না, যাতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ব্যাহত হয়। নির্বাচন নিয়ে অনেকেই হতাশার কথা বললেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে তিনি কোনো সংশয় দেখেন না। তার মতে, ‘বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে চলবে এবং চলতে হবে। এ নিয়ে কারো খেলাধুলা করার সুযোগ নেই। যারা গণতন্ত্রের পথে বাধা দেবে, জাতীয় নির্বাচন দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবে, তারা গণতন্ত্রের শত্রুতে পরিণত হবে।’

‘বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে চলবে এবং চলতে হবে ’এটাই হোক সব রাজনৈতিক দলের শেষ কথা।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

বিষয়: নির্বাচন

সূত্র, আমার দেশ