ডোনাল্ড ট্রাম্প একদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার কালো ও বাদামি চামড়ার অভিবাসীকে বিতাড়িত করছেন, অন্যদিকে হাজার হাজার অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার অনুমতিও দিচ্ছেন। তবে নতুন যাদের যুক্তরাষ্ট্রে আনা হচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা চামড়ার মানুষ বা শ্বেতাঙ্গ। তাদের মধ্যে অনেক ইহুদিও রয়েছে। ট্রাম্পের ভাষায়, এই শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গশাসিত দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘গণহত্যার’ শিকার হচ্ছে। এজন্যই তিনি তাদের রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্রে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা দপ্তরের শরণার্থী পুনর্বাসন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে ৪০ হাজার শরণার্থীকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সুযোগ দেবে ট্রাম্প প্রশাসন। তাদের মধ্যে ৩০ হাজারই দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ, যাদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এসে পৌঁছেছেন বলে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স গত সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের অধিকাংশই দেশটিতে উপনিবেশ স্থাপনকারী নেদারল্যান্ডস বা ডাচদের বংশধর। ১৬৫২ সালে দেশটির কেপ টাউনে প্রথম উপনিবেশ স্থাপনকারী এই শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী শাসন ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে শেষ হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মোট জনসংখ্যার ৮১ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী মাত্র সাত শতাংশ। অথচ তাদের দখলেই রয়েছে দেশটির ৭৫ শতাংশ কৃষি ও অন্যান্য জমি।

শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসান ঘটার আগে ওই সরকার দেশের প্রায় সব জমির মালিকানা শ্বেতাঙ্গদের হাতে দিয়ে যায়। সিরিল রামাফোসার বর্তমান সরকার জমির মালিকানার এই বৈষম্য দূর করতেই একটি আইন পাস করেছে। ট্রাম্প এটাকেই শ্বেতাঙ্গদের জমি ও সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন।

বাইডেন প্রশাসন ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি অর্থবছরে ১ লাখ ২৫ হাজার করে অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার অনুমতি দিয়েছিল। এর মধ্যে ২০২২ সালে ২৫ হাজার ৪৬৫ জন, ২০২৩ সালে ৬০ হাজার ১৪ জন, ২০২৪ সালে এক লাখ ৩৪ জন এবং চলতি বছর এ পর্যন্ত ২৭ হাজার ৩০৮ জন অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউট। বাইডেন আমলের প্রতিবছর লক্ষাধিক অভিবাসীকে পুনর্বাসনের নীতি ট্রাম্প প্রশাসন পরিবর্তন করে ৪০ হাজারে নামিয়ে এনেছে।

পূর্ববর্তী প্রশাসনগুলো অভিবাসী পুনর্বাসন নীতিতে মানবিক বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিত। বিশেষ করে যারা যুদ্ধের কারণে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, কিংবা যারা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসনে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। এক্ষেত্রে জাতিগত পরিচয় বা ধর্ম-বর্ণকে বাধা হিসেবে দেখা হতো না।

ট্রাম্প প্রশাসন আগের সরকারগুলোর এই নীতি থেকে সরে এসে গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্বের একটি অংশের দিকে, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ বিশ্বের দিকে। ট্রাম্পের দাবি, বিশ্বের শ্বেতাঙ্গ অংশটি প্রতিহিংসামূলক গণহত্যার শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ শাসকদের প্রতিহিংসার কবলে পড়ে গণহত্যার শিকার হচ্ছে। ট্রাম্প এটাকে দাবি করছেন ‘হোয়াইট জেনোসাইড’ বা ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা’ হিসেবে।

গত মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকটি দুই নেতা হাসিমুখে শুরু করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ ট্রাম্প অভিযোগ করেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গরা গণহত্যার শিকার হচ্ছেন এবং তাদের জমিজমা ও অন্যান্য সম্পদ দখল করা হচ্ছে। রামাফোসা ট্রাম্পের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। দুই নেতার বৈঠকটি তিক্ততার মধ্যে শেষ হয়।

উল্লেখ্য, প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে বিশ্বের যেসব দেশে, তার একটি হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু নিহতদের অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। দেশটিতে শ্বেতাঙ্গদের নিহত হওয়ার ঘটনা খুবই কম। কিন্তু ট্রাম্প সেদেশে শ্বেতাঙ্গদের গণহত্যার শিকার হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অভিবাসনের সুযোগ দিচ্ছেন। এটি ট্রাম্পের রিপাবলিকান ভোটার বাড়ানোর একটি কৌশল হিসেবেই দেখছেন অনেকেই। কারণ দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণির ভোটাররা। এ কারণে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীর সংখ্যা বাড়াতে আগ্রহী। গণহত্যার মিথ্যা অভিযোগ তুলে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩০ হাজার শ্বেতাঙ্গকে যুক্তরাষ্ট্রে আনার উদ্যোগ এই প্রক্রিয়ারই অংশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ ছাড়াও ইউক্রেনের শ্বেতাঙ্গদের অভিবাসনের সুযোগ দিতে পারেন ট্রাম্প। কারণ অতীতেও ইউক্রেনের অনেক নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী হয়েছে। এছাড়া আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের সহায়তাকারী অল্প কিছু আফগানকেও ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের এই সুযোগ দিতে পারে। তবে এ ব্যাপারে আগামী অক্টোবরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন হোয়াইট হাউসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি অ্যানা কেলি।

গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের গণহত্যার শিকার হওয়ার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কারণে অনাহারে ও অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছেন। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ট্রাম্প গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিদের জন্য ভিজিটর ভিসা বাতিল করে দিয়েছেন। অথচ গত মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার ৬০ জন শ্বেতাঙ্গকে শরণার্থীর মর্যাদা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এনে ওই মাসের শেষের দিকেই তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী হিসেবে আসা ব্যক্তিদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাধারণত ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ আফ্রিকার ৬০ জন শ্বেতাঙ্গের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই সম্পন্ন করা হয়, যা ছিল একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।

ট্রাম্প ২০২৪ সালের ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্থগিত করেন। অথচ এই সময়ে ১২ হাজার বিদেশিকে শর্ত সাপেক্ষে শরণার্থীর মর্যাদায় যুক্তরাষ্ট্রে আসার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের আগেই তাদের টিকিট বুকিং দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ৯০ হাজার বিদেশিকে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের অনুমোদনও দিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে এসবই বাতিল করে দেন।

ট্রাম্পের এই আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের আদালতে মামলা করা হয়েছে। এ ধরনের একটি মামলা করেছে ইন্টারন্যাশনাল রিফিউজি অ্যাসিসট্যান্স প্রজেক্ট (আইআরএপি)। সংগঠনটির সিনিয়র পলিসি ডাইরেক্টর রিচা ডিক্যান্ট সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে বলেন, মামলার রায় অভিবাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য অপেক্ষারত ব্যক্তিদের পক্ষে গেলেও ট্রাম্প প্রশাসন তা গ্রাহ্য করছে না। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত সম্পন্ন করা হয়।

উল্লেখ, ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপকহারে বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি অভিবাসীদের বিপজ্জনক অপরাধী হিসেবে অভিহিত করে বৈধ-অবৈধ সব অভিবাসীর বিরুদ্ধে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর এ বছরের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই তিনি অভিবাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে ২১টি নির্বাহী আদেশ জারি করেন।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি তার চার বছরের মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সব অনিবন্ধিত ও অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করবেন। তবে ‘ড্রিমার’ হিসেবে পরিচিত শিশু বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে আসা অভিবাসীদের সুরক্ষার জন্য তিনি একটি চুক্তি করতে আগ্রহী। ট্রাম্পের এই উদ্যোগ অবৈধ অভিবাসনকে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার দিকে ইঙ্গিত করে।

২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ট্রাম্প অভিবাসীদের বিতাড়িত করার প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি এবং কাজের অনুমতি প্রদানকারী একটি কর্মসূচি বন্ধ করার চেষ্টা করেন। তবে সুপ্রিম কোর্ট তার এই উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়। এবার জন্মগত নাগরিকত্ব বাতিলের ট্রাম্পের পরিকল্পনাও আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। জন্মগত নাগরিকত্ব আইনটি মার্কিন সংবিধানের একটি সংশোধনী থেকে উদ্ভূত এবং ১৮৯৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় দ্বারা সমর্থিত।

ট্রাম্প ২০১৭ থেকে ২০২১ সালে তার প্রথম মেয়াদে অভিবাসী বিতাড়নের চেষ্টা চালিয়ে সফল হতে পারেননি। বর্তমান মেয়াদেও শুরু থেকেই ট্রাম্প শত শত অভিবাসীকে আটক করে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ অনিবন্ধিত ও অবৈধ অভিবাসী ছিল। এই সংখ্যা বর্তমানে বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের মতে, সব অনিবন্ধিত অভিবাসীকে বিতাড়িত করতে বছরে প্রায় ৮৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে।

সূত্র, আমার দেশ