বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার সমীকরণ, আঞ্চলিক ভূরাজনীতি এবং জনগণের প্রত্যাশাÑএই তিনটি উপাদান যূথবদ্ধ হয়ে নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে। ২০২৬ সালের সম্ভাব্য সংসদ নির্বাচন ঘিরে যে উত্তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে, তাতে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং আওয়ামী লীগের দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন এ দুটি বিষয়ই আগামী নির্বাচনের অন্যতম কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর তিনটি নির্বাচন দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি নানা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে এবারের বাস্তবতা ফ্যাসিবাদী শাসনামলের বিপরীত। নিঃসন্দেহে বিগত দিনে ভারতের বিতর্কিত ভূমিকা, আওয়ামী লীগের দানবীয় নীতি এবং ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন মিলিতভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি ও আসন্ন নির্বাচন জনসচেতনায় নতুন ধারা সৃষ্টি করছে, যা পরে বাংলাদেশের ইতিহাসে অপরাজনীতির একটি দীর্ঘ অধ্যায় হয়ে থাকবে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও তাদের এদেশীয় দোসররা ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনে প্রশাসনিক প্রভাব ও কূটকৌশলে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করে। এরপর ২০০৯ সালের শুরুতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের সূচনা হয়। পরবর্তী তিন মেয়াদে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দলটি ‘র’ তথা ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রবর্তন, নারী শিক্ষার প্রসার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিÑএসব গালভরা বুলিতে প্রথম প্রথম জনপ্রিয়তার কিছুটা ভিত্তি তৈরি করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার কৌশল নেয় ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ।

তবে একই সঙ্গে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, বিতর্কিত নির্বাচন, বিরোধী দলের ওপর দমননীতি, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে অহরহ। ২০১৪ সালের নির্বাচন কার্যত একতরফা ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রিক সহিংসতার আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে ডিসি-এসপি, ‘র’ এবং এদেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা আগের রাতেই নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ফেলে। এই নির্বাচনে ভোট ডাকাতি ও চরম অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আওয়ামী লীগ তা আমলে নেয়নি। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও ‘আমি-ডামি’ প্রার্থী সিস্টেম দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর কার্যকর অংশগ্রহণ না থাকায় ভারত ছাড়া বিশ্বের সব দেশ এই নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত সেটাকে স্বীকৃতি দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে।

হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুন, গুম, আয়নাঘরে বন্দি, শাপলা-চত্বরে আলেম-এতিম হত্যার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, হাসিনা এসব অপকর্মের সঙ্গে ভারত জড়িত। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ তাদের বিদেশি প্রভুর প্রেসক্রিপশনে দেশে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করে। পক্ষান্তরে এই ধারাবাহিক দুঃশাসন ও আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের নগ্ন সমর্থন জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী তথা আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দেশের সর্বত্র সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

বিরোধী রাজনীতির পরিবর্তিত কৌশল

২০১৪ ও ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতি একাধিকবার পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম, হরতাল-অবরোধ, নির্বাচন বর্জন ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিÑএই তিন কৌশলের মধ্যেই দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেছে। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি তাদের কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনে। তারা তখন জনমতের ওপর জোর দেয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা বাড়ায় এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিকল্প রাজনৈতিক বার্তা ছড়ানোর বিশেষ মিশনে নামে। কিন্তু বিভিন্ন সময় আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে না পারায় সংগঠনটির দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ইসলামি দলগুলো নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে ‘ভারত-বিরোধিতা’ অনেকের কাছে একটি সহজ ও আবেগপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা হয়ে দাঁড়ায়। এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের একচ্ছত্র ইস্যু নয়; বরং জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি আবেগের প্রতীক হিসেবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইসলাম, জাতীয়তাবাদী আবেগ ও ভারতবিরোধী প্রবণতা বাংলাদেশের মানুষকে জাগিয়ে তোলে।

বাংলাদেশের জনমনে ভারতের ব্যাপারে মিশ্র অনুভূতি রয়েছে আগে থেকেই। একদিকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করার কৃতজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক, অন্যদিকে সীমান্ত হত্যা, পানিবণ্টন ইস্যু ও বাণিজ্যবৈষম্য নিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ বিদ্যমান। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া কিংবা সীমান্তে পুনঃপুন বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার কারণে সাধারণ মানুষের মনে ভারতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব দীর্ঘদিনের। এই আবেগ রাজনৈতিকভাবে রূপান্তরিত হয় এবং এটি আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব এবং অনলাইন পোর্টালগুলোয় আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ এখন স্পষ্ট। তরুণ প্রজন্ম ভারতের প্রভাবমুক্ত পররাষ্ট্রনীতি ও সার্বভৌম রাজনৈতিক অবস্থান দাবি করছে।

বাংলাদেশের মোট ভোটারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এদের বড় অংশ প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছেন ২০১৮ বা ২০২৪ সালের নির্বাচনে। তাদের কাছে রাজনীতি মানে শুধু দলীয় আনুগত্য নয়, বরং রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাই আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চের বিকল্প। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারে সর্বত্র রাজনৈতিক আলোচনা, তর্ক ও প্রচারণা চলছে। তরুণরা এখানেই মত গঠন করে, সংবাদ সংগ্রহ করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ২০২৬ সালের নির্বাচনে ডিজিটাল প্রোপাগান্ডা ও অনলাইন জনমত একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন। তারা ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়, কিন্তু প্রভাব নয়। ভারতের আধিপত্য তারা মানবে না। তারা উন্নয়নের পাশাপাশি অংশগ্রহণও চায়। তাই বিএনপি ও অন্যান্য দলকে এই প্রজন্মের মনোভাব বুঝে কৌশল সাজাতে হবে।

বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমভাগে হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে অনেক প্রস্তুতিও শেষ করে এনেছে। এ সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক আবহ কীভাবে পরিবর্তিত হয়, তা-ই নির্ধারণ করবে নির্বাচনের রূপ ও ফল। তবে তা অবশ্যই আওয়ামী লীগ তথা ভারতবিরোধিতার ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশের রাজনীতি আজ রূপান্তরের পথে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি দুঃশাসন এবং জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এই তিনটি উপাদান মিলে আগামী নির্বাচনের মূল কাঠামো তৈরি করছে। ভারতবিরোধিতা ও আওয়ামী-বিরোধিতা মূলত একই আবেগের দুটি দিক। একদিকে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের দাবি। কিন্তু এই আবেগকে যদি গঠনমূলক রাজনীতিতে রূপ দেওয়া যায়, তবে তা দেশকে স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যের পথে নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে তারা ভারত-প্রভাবিত রাজনীতি, নাকি স্বাধীন সিদ্ধান্তের বাংলাদেশি রাজনীতি চায়। তাই ২০২৬ সালের নির্বাচন শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়; এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রদর্শন নির্ধারণের এক ঐতিহাসিক সুযোগ।

সূত্র, আমার দেশ