আট বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আজও বাংলাদেশে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস উপলক্ষে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র করে কক্সবাজার আবার আন্তর্জাতিক নজরে এসেছে। রোহিঙ্গাদের মানবিকতার খাতিরে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্রশংসা পেলেও দীর্ঘসূত্রতা ও অনিশ্চয়তা আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে এক বিশাল বোঝা হিসেবে। এই সম্মেলন ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘস্থায়ী মানবিক সংকট রোহিঙ্গা সমস্যা ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান পুনর্বিবেচনার এক মঞ্চ। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এখনো কক্সবাজার ও ভাসানচরের শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করছে। মানবিক দায়বদ্ধতায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও দীর্ঘ আট বছরের বোঝা অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা ও স্থানীয় সমাজে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছে। তাই প্রত্যাবাসনই একমাত্র টেকসই সমাধান। ইনানীর হাইলেভেল কনফারেন্স তাই হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের কাছে পরীক্ষার মঞ্চ। সেখানে তিন দিনের এই সম্মেলনে এ সংকট সমাধানে আসলে কী পাওয়া গেল, তা কিছুটা বিশ্লেষণ করা যাক।

গত ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার হয়ে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন সমুদ্রতীরবর্তী কক্সবাজারের জনপদ তাদের আশ্রয় দেয় মানবিক দায়িত্বে। মুহূর্তের মধ্যে কয়েক লাখ অনাহারী-অসহায় মানুষকে আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছিল মানবিকতার কাছে ভৌগোলিক সীমারেখা বড় নয়। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, বোঝা তত বেড়েছে। আজ ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর বাস করছে, যাদের জীবন অনিশ্চয়তা, হতাশা ও অন্ধকারের মধ্যে বন্দি। এই বোঝা একার শক্তিতে বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব। বাংলাদেশের প্রত্যাশাগুলো সাতটি প্রস্তাবনা আকারে পেশ করা হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়তো আবার রোহিঙ্গা সংকটকে অগ্রাধিকারে আনবে এবং মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসনের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপে বাধ্য করা হবে। রোহিঙ্গা আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতির শিকার হয়েছে, তার স্বীকৃতি এবং প্রতিকার আসবে। চতুর্থত, আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিরাপত্তাঝুঁকির প্রশ্নে আরো সক্রিয় হবে বলে আশা করা হয়েছে।

ইনানী সম্মেলনের প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গেলে দেখা যায় কিছু অর্জন অবশ্যই হয়েছে। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাসংকট আবার বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে বিশ্ব যখন ব্যস্ত, তখন রোহিঙ্গা ইস্যু অনেকটা আড়ালে চলে যাচ্ছিল। এই সম্মেলনের ফলে সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন ও দাতা দেশগুলো আবার রোহিঙ্গাদের দুরবস্থার দিকে নজর দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য।

এই সম্মেলনে ‘ফেজ-ওয়াইজ রিটার্ন ফ্রেমওয়ার্ক’-এর প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যেখানে ধাপে ধাপে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও সময়সীমা ও নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি, তবু আলোচনার গতি বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন। বাংলাদেশ যে ভয়াবহ চাপের মধ্যে আছে, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে। কক্সবাজারের বনভূমি ধ্বংস, ভূগর্ভস্থ পানির সংকট, স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সামাজিক টানাপোড়েনÑএসব বাস্তবতা তুলে ধরে বাংলাদেশ বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ খাতে নতুন সহায়তার প্রতিশ্রুতি এসেছে।

এছাড়া এই সম্মেলনে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যু গুরুত্ব পেয়েছে। ক্যাম্পকে ঘিরে মাদক ও মানবপাচার, উগ্রবাদী তৎপরতার ঝুঁকি নিয়ে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড এবং আসিয়ান দেশগুলো এবার আরো স্পষ্টভাবে অবস্থান নিয়েছে। সীমান্ত নিরাপত্তা ও পাচারবিরোধী যৌথ উদ্যোগের কথা আলোচনা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বর কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে। গাম্বিয়া-মিয়ানমার মামলার প্রতি সমর্থন এবং জান্তার জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। এটি প্রত্যাবাসনের জন্য একধরনের নৈতিক ও আইনি চাপ সৃষ্টি করেছে।

তবে প্রত্যাবাসনের জন্য সীমাবদ্ধতাও কম নয়। মিয়ানমার প্রতিনিধিদল এখনো অনমনীয়, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি। চীন ও ভারতের ভূমিকাও কৌশলগত তারা মৌখিক সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু কার্যকর চাপ প্রয়োগে দ্বিধাগ্রস্ত। অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি এসেছে বটে, তবে তার বাস্তবায়ন কতটা হবে, তা সময়ই বলে দেবে। ইনানী সম্মেলনের প্রাপ্তি মূলত আংশিক। প্রত্যাশিত পূর্ণ সমাধান রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন সেটি এখনো অনেক দূরে।

এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো এই আংশিক প্রাপ্তিগুলো কাজে লাগানো। কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে, দাতা বৈচিত্র্যকরণের দিকে নজর দিতে হবে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে এবং সবচেয়ে বড় কথা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আদালত ও জাতিসংঘের প্রক্রিয়াগুলো আরো সক্রিয় করতে হবে।

সব মিলিয়ে ইনানী সম্মেলনের মূল প্রাপ্তি হলো রোহিঙ্গা ইস্যুটি আবার বিশ্ব অগ্রাধিকারে এসেছে, অর্থায়নের নতুন প্রতিশ্রুতি মিলেছে। সীমাবদ্ধতা থাকলেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান শক্ত হয়েছে, আর বিশ্ব সম্প্রদায় নতুন করে সংকটটির গুরুত্ব অনুধাবন করেছে।

তবে ইনানী সম্মেলন এখনো কোনো দৃশ্যমান সমাধান নয়; বরং সমাধানের পথে নতুন করে যাত্রা শুরুর প্রমাণ। সমুদ্রের ঢেউ যেমন বারবার ভেঙে ফিরে আসে, তেমনি রোহিঙ্গা সংকটও বারবার আলোচনায় ফিরে আসছে। এই ঢেউ কি শুধু বালুতটে মিলিয়ে যাবে, নাকি বাস্তব প্রত্যাবাসনের তটরেখায় পৌঁছাতে পারবে? তার উত্তরই নির্ধারণ করবে ইনানী সম্মেলনের চূড়ান্ত প্রাপ্তি।

তবে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল প্রত্যাবাসন নিয়ে এখনো অনমনীয়। তারা শুধু মৌখিক আশ্বাস দিয়েছে। কোনো লিখিত রোডম্যাপ বা সময়সীমা দেয়নি। আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকাও অনেকটাই কৌশলগত। তারা মৌখিক সমর্থনে সীমাবদ্ধ থেকেছে। দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

সব মিলিয়ে ২০২৫ ইনানী সম্মেলনে বাংলাদেশের চাওয়ার সবকিছু মেলেনি, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত মূল সমাধান রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এখনো দূর ভবিষ্যতের বিষয়। তাই বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি হলো প্রাপ্তিগুলো কাজে লাগানো, আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। কারণ রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে এটি শুধু একটি মানবিক সমস্যা থাকবে না, বরং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্থিতিশীলতাকেও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলবে।

তবে এই সম্মেলন বাংলাদেশের প্রত্যাশার পুরোটা পূরণ করতে না পারলেও একটি নতুন কিছু প্রতিশ্রুতি এসেছে। এখন আমাদের করণীয় হলো এই গতি ধরে রাখা এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া।

মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে কিছু কিছু অধ্যায় লজ্জার কালিমা হয়ে থেকে যায়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের দেশান্তরিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এমন এক অধ্যায়। ভয়াবহ গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে যে প্রায় বারো লাখ রোহিঙ্গা আমাদের দেশে প্রবেশ করে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভাবনীয় মানবিক সংকটের সূচনা ঘটায়। প্রথমদিকে মানবিক সহানুভূতির জায়গা থেকে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও দিন যত গড়িয়েছে, সংকট তত জটিল হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ ও নিরাপত্তাÑসবকিছুই এখন রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে বিপর্যস্ত। তাই টেকসই সমাধান হিসেবে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি খুব জরুরি।

এই প্রত্যাবাসনকে বাস্তবে রূপ দিতে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে স্টেকহোল্ডার্স ডায়ালগ ‘টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাইলেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শীর্ষক এ সম্মেলন আয়োজন করেছে রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভের কার্যালয় এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের ফাঁকে উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন হবে। তার আগে এ সম্মেলনের আয়োজনকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছিল। তাই এ সম্মেলনের আয়োজন নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে কূটনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় পদক্ষেপ। এখন এই সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত কাজে লাগানোর জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানোর বিকল্প নেই।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর

সূত্র, আমার দেশ