একজন বয়স্ক মানুষ। গেঞ্জি পরা গোবেচারা টাইপ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার গলায় জুতার মালা। একজন আবার জুতা দিয়ে তাকে পেটানোর চেষ্টা করছে। এই ভিডিওটা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে গেল নেট দুনিয়ায়।
শুরু হয়ে গেল এর পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে পাবলিক এভাবে ধরে হেনস্তা করে পুলিশের হাতে দেওয়ায় তা নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক-কূটতর্ক। কেউ বলছেন, তিনি অপরাধ করে থাকলে তার বিচার হবে আদালতে, তাকে কেন জুতাপেটা করতে হবে? কেন মারধর করতে হবে?
আবার কেউ বলছেন, তিনি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার কারিগরদের অন্যতম। আদালতি বিচারের প্রতি কারো আস্থা নেই। শেষ পর্যন্ত এসব অপরাধীর কিছুই হবে না। তাই এই বেসরকারি বিচার ঠিকই আছে। কয়েকদিন ধরে এই বাহাস চলমান।
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৪ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি হয়েছেন। তাদের মধ্যে বর্তমান সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন এখনো কোনো পরীক্ষায় অবতীর্ণ হননি। বাকি ১৩ জনের মধ্যে ১৯৯০ সালে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি সুলতান হোসেন খান কোনো জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ পাননি। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পরে সিইসি পদ থেকে তাকেও সরে যেতে হয়। আরেকজন সিইসিও নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ পাননি। তিনি হলেন বিচারপতি এমএ আজিজ। ২০০৫ সালে নিয়োগ পাওয়া এই সিইসিকেও ওয়ান-ইলেভেনখ্যাত বিশেষ সরকারের সময় সরে যেতে হয়।
বাকি ১১ জন সিইসির অধীনে যে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মধ্যে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা কাজী রকিবুদ্দিন, কেএম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালের প্রতি মানুষের রাগ ও ঘৃণা সবচেয়ে বেশি। কারণ তাদের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৪ সালের বিনা ভোটের, ২০১৮ সালের রাতের ভোটের ও ২০২৪ সালের আমি-ডামি ভোটের নির্বাচন। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মূল কারিগর এই তিনজন। শেখ হাসিনার নির্দেশে এরাই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েমের জন্য মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে রেখেছিল দেড় দশক।
বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মাসুদ সিইসি থাকাকালে ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় এবং ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত জঘন্য ও ব্যাপক বিতর্কিত হলেও তখন ভিজুয়াল মিডিয়া না থাকায় তার কথা মানুষ সরাসরি শুনতে পেত না। তাই রাগ যা করার তা করত সরকারের ওপর। সিইসি কোনো ম্যাটারই ছিল না। কিন্তু এই ভিজুয়াল ও ভার্চুয়াল মিডিয়ার ব্যাপক প্রচারের যুগে সিইসিরা কে কী বলছেন, করছেন, তা সবই পৌঁছে যায় গণমানুষের কাছে। ফলে তাদের ওপর রাগটাও তৈরি হয় বেশি। তারই বহিঃপ্রকাশ হয়তো জুতার মালা দিয়ে হেনস্তা।
কাজী রকিবুদ্দিনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে (উপনির্বাচনে আরো একটিতে) কোনো ভোটেরই দরকার হয়নি। অটো এমপি হয়ে গেছে এরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ দলের বয়কট ও প্রতিরোধের মুখে যে নির্বাচনে পাঁচ শতাংশের কম ভোট পড়েছে, তাতে রকিবুদ্দিন দেখিছেন ৪০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোটের ইলেকশনে নুরুল হুদা ভোট পড়ার হার দেখিয়েছেন ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। আর বিএনপি-জামায়াতসহ বেশির ভাগ দলের বয়কটের মুখে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির আমি-ডামি পাতানো নির্বাচনে কাজী হাবিবুল আউয়াল ভোট পড়ার হার দেখিয়েছেন ৪১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এই হলো দুই কাজী ও এক হুদার বেহুদা নির্বাচনের হালহকিকত।
সুতরাং তাদের ওপর মানুষের রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণার মাত্রা যে কতটা তীব্র হতে পারে, তা অনুমান করা যায়।
তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই। কিন্তু সেই দাবি কানে তোলেনি সরকার। শেষ পর্যন্ত বিএনপি এই তিন নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের নামে মামলা করে।
দুপুরে মামলা করার পর সন্ধ্যার দিকেই জনতা নুরুল হুদাকে তার উত্তরার বাসা থেকে ধরে এনে হেনস্তা করে পরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। জনতা ধরে না দিলে তাকে পুলিশ আদৌ ধরত কি না, সে বিষয়েও কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেন।
নুরুল হুদাকে গ্রেপ্তারের পরের দিন সাবেক এই সিইসিকে যখন ঢাকার সিএমএম আদালতে তোলা হয়, তখন তার দুহাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরানো ছিল। কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নুরুল হুদাকে একজন আইনজীবী ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করলে ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে জানান, ভালো আছেন। নুরুল হুদা হয়তো শক্ত মনের মানুষ। তাই একদিন আগের সন্ধ্যার দুঃসহ স্মৃতি ভুলে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বলতে পারেন, ভালো আছেন।
যেসব অভিযোগে নুরুল হুদার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তার দায় সরাসরি নিজে নিতে অস্বীকার করলেও তিনি বলেছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনটি বিতর্কিত হয়েছে। এ সময় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটার (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অবৈধ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে যে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সাবেক সিইসি নুরুল হুদা। তিনি জনগণের হাতে কট হয়েছেন। তাকে জনগণ ধরে ফেলেছেন। সাধারণ মানুষ, যারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তারা এসব ব্যক্তির ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত। ফলে এসব ব্যক্তিকে দেখামাত্রই জনগণ ধরে ফেলছেন। মাননীয় আদালত, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জনগণ নিশিরাতের নির্বাচন বলেই জানেন। নুরুল হুদা হচ্ছেন নিশিরাতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এমন নিশিরাতের নির্বাচন করে তারা কীভাবে মানুষকে চেহারা দেখান? তারা এত বড় নির্লজ্জ, এখনো মানুষের মাঝে যান এবং হাসেন।’
নুরুল হুদাকে নিয়ে পিপির এই বক্তব্য কাজী রকিবুদ্দিন ও কাজী হাবিবুল আউয়ালের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।
সাবেক তিন নির্বাচন কমিশনারের ওপর মানুষের ক্ষোভ বেশি হওয়ার কারণ শুধু জালিয়াতির নির্বাচন করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতা করা নয়, তারা যে ভাষায় মিডিয়ার সামনে বক্তব্য দিয়ে জালিয়াতির ভোটকে হালাল করার দায়িত্ব পালন করতেন, তা মানুষের মনে সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাদের কোনো আচরণ বা কথায় কখনো মনে হয়নি যে ফ্যাসিবাদ সরকারের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তারা জালিয়াতির নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছেন এবং সেজন্য তারা অনুতপ্ত। বরং এটাই মনে হয়েছে, তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের ফ্যাসিবাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে দৈবচয়নের মাধ্যমে ৫০টি আসন নিয়ে গবেষণার যে চিত্র তুলে ধরেছিল, তা ছিল সাংঘাতিক শকিং। গবেষণা সংস্থাটি ৫০টির মধ্যে ৪৭টি আসনে কোনো না কোনো নির্বাচনী অনিয়মের নজির পেয়েছিল। ৫০টির মধ্যে ৩৩টি আসনে তারা নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার প্রমাণ পেয়েছে বলে জানিয়েছিল। তার মানে ৩০০টি আসনের মধ্যে টিআইবির মতে ১৯৮টি আসনে আগের রাতেই ভোট হয়ে গেছে। এ ছাড়া ওই ৫০টির মধ্যে ৪১টি আসনে জাল ভোট, ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারা, ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরুর আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা এবং ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়ার মতো তথ্য পেয়েছে টিআইবি (তথ্যসূত্র: আওয়ামী আমলের তিন নির্বাচন, সায়ন্থ সাখাওয়াৎ, বিদ্যাপ্রকাশ ২০২৪)।
২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়েও এমন বহু অপকর্মের নজির বিদ্যমান। তারপরও ওইসব নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সিইসিরা জাতির সামনে তামাশার নির্বাচনকে জায়েজ করতে কোনো রকম লজ্জাশরমের ধার ধারেননি। তাই তাদের প্রতি মানুষের চরম ক্ষোভ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
তারপরও কি তাদের ধরে জুতাপেটা করা বা গলায় জুতার মালা পরানো সমর্থনযোগ্য? আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষের ওপর সীমাহীন নির্মম অবিচার করেছে। কিন্তু এখন তাদের প্রতি যদি একই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার ধারাবাহিকতাই জারি রাখা হয়। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে কি আমরা বের হবো না? চলতেই থাকবে এই অসভ্যতা?
এ ক্ষেত্রে সরকারের দায় ও দায়িত্ব কিন্তু বেশি। ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও সরকার এসব সিইসি-সহ নানা অপকর্মের হোতাদের আইনের আওতায় আনতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ফ্যাসিবাদের বীজ বপনকারী বিচারপতি খায়রুল হক কী করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন, সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না। এসব কারণে মানুষ রাষ্ট্রের বিধি-বিধানের ওপর আস্থা হারিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। মানুষ মনে করে, এসব অপরাধীর বিচার কোনোদিন হবে না। তাদের এই অনাস্থা থেকে বের করে আনতে না পারলে এমন মব কালচার, প্রতিহিংসা ও অরাজকতা চলতেই থাকবে। আর নিধিরাম সরকার তার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিতে থাকবে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমরা আইনের শাসনের আওতায় চলা একটা সভ্য দেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পাব না কোনোদিন।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক