ক্ষমতার রাজনীতির প্রথম নিয়ম হচ্ছে কেউ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়ে না। দ্বিতীয় নিয়ম হচ্ছে গতকালের মিত্র আজকের শত্রু হতে পারে, আজকের শত্রু কালকের বন্ধু হতে পারে। এই দুই নিয়মই এখন গাজায় বাস্তব রূপ নিচ্ছে। খবর আসছে যে হামাস আবারও গাজায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে।
যুদ্ধের অভিঘাতে গাজার প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। হামাস হয়তো সংখ্যায় কমে গেছে, কিন্তু তাদের মনোবল এখনো অটুট। তারা এখন প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিরতির পর গাজায় কোন গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করবে, তার প্রতিযোগিতা চলছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এটাকে হামাস ও তাদের শাসনে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষের মধ্যকার সংঘাত বলে উপস্থাপন করতে চাইছেন। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও গাজার বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল ও ধোঁয়াশাপূর্ণ।
হামাসকে চ্যালেঞ্জ জানানো গোষ্ঠীগুলো মূলত গোত্রভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী। এদের অপরাধ ও সহিংসতার ইতিহাস দীর্ঘ। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আদর্শে অনুপ্রাণিত মুক্তিসেনা তারা নয়। তারা ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের প্রতীক ‘কেফিয়ার’ ধ্বজাধারীও নয়। খুব খোলাখুলিভাবে বললে, তারা নির্লজ্জ রকমের ঠগ চরিত্রের। দশকের পর দশক ধরে তারা ক্ষমতার হাওয়া বুঝে নিজেদের অবস্থান বদলাতে অভ্যস্ত।
হামাস যখন কঠোর হাতে গাজা শাসন করত, এই গোত্রগুলো তখন তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলত। বিনিময়ে গাজার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালে এরা নিজেদের সদস্যদের সামান্য কিছু অর্থনৈতিক সহায়তাও দিয়েছে। এখন তারা মনে করছে, তাদের নিজেদের সামনেই ক্ষমতা দখলের সুযোগ এসেছে।
সংঘাতের হেরে যাওয়া পক্ষের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা যুদ্ধের মতোই প্রাচীন একটি বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে লুকিয়ে থাকা জাপানি সেনা থেকে শুরু করে ইরাক দখলের পর সাদ্দাম হোসেনের অনুগত যোদ্ধা—সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে পরাজিত শক্তি সচরাচর পরাজয় মেনে নেয় না। ২০০৭ সাল থেকে গাজায় ক্ষমতায় থাকা হামাসের জন্য এ লড়াই আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, হামাস কেবল একটি সরকার বা সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়—এটি একটি আদর্শ, একটি সামাজিক আন্দোলন এবং পৃষ্ঠপোষকতার একটি নেটওয়ার্ক। গাজায় ক্ষমতা হারানো মানে হচ্ছে হামাসের অস্তিত্ব নাই হয়ে যাওয়া।
গাজার আকাশে এখনো ঘুরে ঘুরে শকুন উড়ছে। সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরেই উড়তে থাকবে। হামাস সহজে তাদের কর্তৃত্ব ছাড়বে না, গোত্রগুলো সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে আর পিআইজে তাদের মুহূর্ত আসার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। এদিকে সাধারণ গাজাবাসীকেই মূল্য চুকিয়ে যেতে হবে।
হামাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া গোষ্ঠীগুলোও সময় নিয়ে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছে। তারা বিজয়ী পক্ষের (ইসরায়েল) সমর্থনও পাচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েল হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পাশ কাটিয়ে এই গোত্রগুলোর শক্তি বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে হামাস শক্তিশালী ডগমুশ গোত্রের একজন নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, ত্রাণ কাফেলা লুট করেছেন এবং সেই মাল কালোবাজারে বিক্রি করেছেন। অন্যদিকে ‘শাবাব’ নামে পরিচিত আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের সমর্থন পাচ্ছে।
ডগমুশ, শাবাবের মতো কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী ও গোত্রভিত্তিক সংগঠন খোলাখুলিভাবে ইসরায়েলি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে। কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষক এটিকে হামাসের চরমপন্থী আদর্শের প্রত্যাখ্যান হিসেবে দেখছেন। কিন্তু এটি গাজার রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে পুরোপুরি ভুল একটি ধারণা। ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ও লেবাননে এমন সশস্ত্র গোষ্ঠীর ইতিহাস দীর্ঘদিনের, যারা সুবিধাজনক সময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বা ইসরায়েলের হয়ে কাজ করেছে, কিন্তু ক্ষমতা সংহত হওয়ার পর তারা তাদের সাবেক পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
হামাসের নিজস্ব ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। ১৯৮০-এর দশকে মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে বেরিয়ে হামাসের জন্ম হয়েছিল। হামাসকে ইসরায়েল কৌশলগত উৎসাহ দিয়েছিল। এটাকে ইসরায়েল ইয়াসির আরাফাতের সেক্যুলার দল পিএলওর বিরুদ্ধে ভারসাম্য হিসেবে হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু এরপর কী ঘটেছে, সেটি সবারই জানা।
আজ যেসব গোত্র ও গোষ্ঠী নিজেদের হামাসের বিরোধী পক্ষ হিসেবে হাজির করছে, তারাও বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা অনেক বেশি সহিংস ও সুযোগসন্ধানী।
কিন্তু গাজার ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রকৃত ‘বুনো কার্ড’ এই গোত্রভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা প্রায়ই ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদকে (পিআইজে) উপেক্ষা করেন। এই সংগঠন হামাসের কনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করে। যুদ্ধের আগে পিআইজির সশস্ত্র যোদ্ধার সংখ্যা কয়েক হাজার বলে ধরা হতো। যুদ্ধে হামাসের কয়েক হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন। ফলে যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতায় পিআইজের নেতৃত্ব নিজেদের শীর্ষ অবস্থানে থাকার দাবি করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ভাবতে পারেন।
পিইজের এমন কিছু আছে, যেটা গোত্রভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নেই। সেটি হলো রাজনৈতিক বৈধতা অথবা অন্তত সশস্ত্র আন্দোলনের সমতুল্য স্বীকৃতি। এই সংগঠনের ফিলিস্তিন অঞ্চলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। হামাসের মতোই তাদেরও আদর্শগত ভিত্তি আছে। আছে সুসংহত নেতৃত্ব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ইরানের দীর্ঘমেয়াদি সমর্থনও আছে।
গোত্রভিত্তিক গোষ্ঠীগুলো পুরোপুরিভাবে ক্ষমতা ও মুনাফার হিসাবে চালিত। অন্যদিকে পিআইজের আছে বৈপ্লবিক বিশ্বাসযোগ্যতা। সংগঠনটির এমন একটি শক্তিশালী কাঠামো আছে, যেটি ইসরায়েলি অভিযানের মুখেও দশকের পর দশক ধরে টিকে আছে। এ ছাড়া পশ্চিম তীরেও পিইজের শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। এটি গাজার বাইরে থেকেও সম্পদ আহরণের সুযোগ করে দেয়।
হামাস যদি গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে না পারে, তাহলে পিআইজেকে সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখা যায়। ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকে এক ইরান-সমর্থিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর জায়গায় আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন।
গাজার সবচেয়ে গভীর সমস্যা হলো এটি এখন দার্শনিক টমাস হবসের সেই ‘সবার জন্য মুক্ত’ জায়গায় পরিণত হয়েছে। সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবন অত্যন্ত কষ্টকর ও নিষ্ঠুর। সংঘাতের মধ্যে পড়ে অকালেই তাদের প্রাণ হারাতে হচ্ছে। ট্রাম্পের শান্তি চুক্তি গাজায় কে শাসন করবে এবং সেখারকার শাসনব্যবস্থা কীভাবে বজায় থাকবে—এই মৌলিক প্রশ্নের কোনো সমাধান দেয়নি। এখানকার শান্তিশৃঙ্খলা স্থিতিশীল করতে কোনো বাহিনী নেই, কোনো শান্তিরক্ষী বাহিনী নেই। এমন কোনো ব্যবস্থা নেই, যেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বন্দুকবাজি ঠেকাতে পারে।
গাজার আকাশে এখনো ঘুরে ঘুরে শকুন উড়ছে। সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরেই উড়তে থাকবে। হামাস সহজে তাদের কর্তৃত্ব ছাড়বে না, গোত্রগুলো সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে আর পিআইজে তাদের মুহূর্ত আসার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। এদিকে সাধারণ গাজাবাসীকেই মূল্য চুকিয়ে যেতে হবে।
ববি ঘোষ ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও টাইম ম্যাগাজিনের সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পাদক
টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত