গত সপ্তাহে ইরান আক্রমণের জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নাটকীয় সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ছিলেন দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অবকাঠামো, সামরিক নেতৃত্ব, পরমাণুবিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
সেই দুই ব্যক্তি হলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দাবাহিনী মোসাদের পরিচালক ডেভিড বার্নিয়া এবং বিমানবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল তোমার বার।
ইসরায়েলের এক সিনিয়র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘মোসাদের স্থলভাগের কার্যক্রম এবং বিমানবাহিনীর আকাশপথে হামলার নিখুঁত সমন্বয়ে এক মিলিমিটারও এদিক-সেদিক হয়নি। তারা একটি অবিশ্বাস্য পরিকল্পনা তৈরি করেছে এবং আমরা এখনো এর সবকিছু দেখিনি। সে পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে তা ড্রোন ও বিপারের অপারেশনকেও ম্লান করে দেবে।’
মনে হচ্ছে, এক ধরনের আতঙ্ক বা ফোবিয়ায় ইসরায়েল আক্রান্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে, অস্তিত্ব সংকটে পড়ার মতো কোনো অনুভূতি রাষ্ট্রটির নেতাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে
এবার মোসাদই ইরানে হামলার পরিকল্পনাটি তৈরি করে এবং সামরিক বাহিনী তা কার্যকর করার জন্য আগ্রহের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে ইরানে হামলার পক্ষে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি। তিনি নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের প্রধান থেকে সহায়তা আদায় করে নেন ইরানে হামলার জন্য। দেশটির নিরাপত্তা পরিষদে হানেগবি নিজের পরিকল্পনাগুলো উপস্থাপন করেন এবং তা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন পায়।
২০০৭ সাল থেকে গাবি আশকেনাজি, বেনি গানৎজ, গাদি আইজেনকোটসহ যাঁরাই আইডিএফের প্রধান ছিলেন, সবাই ইরান আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তির পর ইরানে হামলার ধারণাটিও বাতিল হয়ে যায়।
ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যে তার সমর্থিত অন্যান্য শক্তিগুলোর সঙ্গে সরাসরি এবং পরোক্ষ সংঘাতে বার্নিয়া সুনাম অর্জন করেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মোসাদ ‘বিপার অপারেশন’ চালায়। যে অপারেশনে হিজবুল্লাহর সদস্যদের হাতে হাজার হাজার পেজার এবং শত শত ওয়াকিটকি বিস্ফোরিত হয়েছিল। এ অপারেশন বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল।
এবার দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বার্নিয়া ও তাঁর সহকর্মীরা গুপ্তচর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিজেদের পরিকল্পনা সাজান। সেটির ভিত্তিতে একের পর এক অপারেশন চালায় মোসাদ।
২০২১ সালে মোসাদের প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর বার্নিয়া গোয়েন্দা সংস্থাটিতে ‘বায়োমেট্রিক বিপ্লব’ ঘটানোর দিকে মনোযোগ দেন। এর মধ্য দিয়ে সংস্থাটিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে রূপান্তর করেছিলেন তিনি।
ইসরায়েলের এক সিনিয়র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বার্নিয়া মোসাদকে আমূল পরিবর্তন করেছেন। তিনি মোসাদের কাজের ধারা পাল্টে দিয়েছেন এবং স্মার্ট নজরদারি ক্যামেরা ও চেহারা শনাক্তকরণের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এটা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। মোসাদ এখনো একটি রক্ষণশীল সংস্থা এবং সেখানে পরিবর্তন আনতে বার্নিয়াকে অনেক অভ্যন্তরীণ লড়াই করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি জিতেছেন এবং আমরা ইরানে তার ফলাফল দেখতে পাচ্ছি।’
এই প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা আরও বলেন, বার্নিয়া একজন অসাধারণ অপারেটর। তিনি এমন ব্যক্তি যিনি মিডিয়ায় কোনো আলোচনায় থাকতে চান না। কোনো সাক্ষাৎকার দেওয়া বা মোসাদের অপারেশন সম্পর্কে কথা বলারও সুযোগ নেই তাঁর পক্ষ থেকে। আবার বার্নিয়া অহংকারীও নন। তিনি কোনো কিছুতে ভয় পান না, যাতে কেউ তাঁকে দুর্বল ভাবতে পারে।
৬০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যতিক্রমী সব অপারেশন চালিয়ে সাফল্যের রেকর্ড দেখিয়েছেন। এরপর তিনি ইরানে হামলার বিষয়ে পদক্ষেপ নেন। বিশেষ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন আক্রমণ ও দক্ষিণ ইসরায়েলে হত্যাকাণ্ড এবং এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি ইরানে হামলার বিষয়ে ভাবতে থাকেন।
নেতানিয়াহুর মতো বার্নিয়াও বিশ্বাস করতেন যে ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা উচিত। বারাক ওবামার সময় যুক্তরাষ্ট্র সে চুক্তি করেছিল। বার্নিয়া নিশ্চিত ছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র সে চুক্তি থেকে সরে এলে পরিস্থিতি ইসরায়েলের অনুকূলে আসবে। যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালের মে মাসে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন ইরানিরা আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এতে মূলত ইরানে হামলার একটা সুযোগ তৈরি হয়।
ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর সমর্থিত অন্য শক্তিগুলোর সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষ সংঘাতে বার্নিয়া সুনাম অর্জন করেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মোসাদ ‘বিপার অপারেশন’ চালায়। যে অপারেশনে হিজবুল্লাহর সদস্যদের হাতে হাজার হাজার পেজার ও শত শত ওয়াকিটকি বিস্ফোরিত হয়েছিল। এ অপারেশন বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে তেহরানে হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডও বার্নিয়া ও মোসাদের কৃতিত্ব। এরপর হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা এবং এখন ইরানিদের নিজস্ব মাটিতে একের পর এক সিনিয়র ইরানি সামরিক ব্যক্তিদের গুপ্তহত্যাগুলো করা সম্ভব হয়েছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও মোসাদের তথ্যের ওপর নির্ভর করে নির্ভুল বিমান হামলার মাধ্যমে।
এ সপ্তাহের শুরুতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রকাশ করেছে যে বছরের পর বছর ধরে মোসাদ স্যুটকেস, ট্রাক ও শিপিং কনটেইনারের ভেতরে ড্রোন এবং গোলাবারুদ তৈরির উপাদান ইরানে পাচার করতে সক্ষম হয়েছিল। ইরানের ভেতরই সরঞ্জামগুলো জোড়া লাগানো হয়েছিল। গত শুক্রবার সবুজসংকেত না আসা পর্যন্ত সেসব অস্ত্র ও সরঞ্জাম লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
যখন ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো তেহরান, নাতানজ ও অন্যান্য এলাকার দিকে উড়ে যাচ্ছিল, তখন ইরানের ভেতর থেকে ড্রোনগুলো সক্রিয় করা হয়। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকে নিরাপদে পথ তৈরি করে দিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে এসব ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল।
ওই প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘বার্নিয়া বুঝেছিলেন যে এবার কোনো বিকল্প নেই, আমাদের ইরান আক্রমণ করতে হবে। আমরা সব সময় জানতাম, ইরানিরা ভাবছে যে আমরা কোনো পদক্ষেপ নেব না। তারা মনে করেছিল, আমাদের সেই সক্ষমতা নেই। তারা দেখেছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি ইরানে হামলার বিষয়টি সমর্থন করেননি। ট্রাম্পও ইরানে হামলা করতে আগ্রহী ছিলেন না।’
কর্মকর্তা আরও যোগ করেন, ‘ইরানিরা ভেবেছিল যে তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সব হুমকি অর্থহীন ছিল। তারা মনে করেছিল, আসলে কিছুই হবে না এবং তারা তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে থাকে। তারা আসলে সেই ভুলের ফল ভোগ করছে এখন। ইসরায়েল ইরানকে হতবাক করতে সক্ষম হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে নিজেদের যুক্ত করলে আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যেতে পারব। সে ক্ষেত্রে, ইরানের আর কোনো সুযোগ থাকবে না। তখন সম্ভবত আমরা বলতে পারব যে পারমাণবিক হুমকি দূর করার একটি বড় বিজয়ের মাধ্যমে আইডিএফ-মোসাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে।’
সরকার যদি আরও এক বছর মেয়াদ না বাড়ায়, তাহলে বার্নিয়ার দায়িত্ব ২০২৬ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। যদি তিনি রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করতে চান, তাহলে অবসরের পর নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। এরপর একজন জনপ্রিয় প্রার্থী হওয়ার সুযোগ আছে তাঁর। এমন রাজনৈতিক দল খুব কমই আছে যারা তাঁকে উচ্চপদে, এমনকি দলীয় প্রধান হিসেবেও চাইবে না, যদিও এটি ঘটবে না। কারণ, তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু জাতীয় রাজনীতির শীর্ষে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা নেই।
মোসাদের প্রধানকে ভালোভাবে চেনেন এমন এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, বার্নিয়া এমন ধরনের ব্যক্তি নন যিনি রাজনীতিতে শীর্ষ অবস্থানে যেতে মিডিয়ায় লড়াই করবেন বা রাজনৈতিক বিবাদে জড়াবেন। কখনো কখনো আপনাকে আপনার আজীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে নেতিবাচক কৌশল অবলম্বন করতে হয়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসার মতো সেই স্বপ্ন নেই বার্নিয়ার।
শালোম ইয়েরুসালমি টাইমস অব ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক
টাইমস অব ইসরায়েল থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রাফসান গালিব