বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মাস্টার্স পাস করার পরের বছরই শিক্ষক হওয়া যায়। কিন্তু বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিএইচডি শেষ না করে শিক্ষকতা শুরু করা যায় না। সেখানেও প্রভাষক পদ আছে। কিন্তু সেগুলো সাধারণত খণ্ডকালীন শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু যারা সার্বক্ষণিক শিক্ষক, বিশেষ করে যারা গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়ান, তারা সাধারণত পিএইচডি শেষ করার পর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। সে সময় প্রতিবছরই তাকে নিজ বিভাগ, অনুষদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ধাপে নানা মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমাদের এখানে চিত্রটি ভিন্ন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকতা শুধু ক্লাস নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, গবেষণায় নেই। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আমাদের দেশে পদোন্নতি সহজ। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতি নিজস্ব নীতিমালা বা বিধি অনুযায়ী চলে। সেগুলো অর্ডিন্যান্স বা রুলস আকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটে পাস করে নেওয়া হয়। এখানে শিক্ষক পদোন্নতিতে বাইরের দেশের সঙ্গে খুব একটা সামঞ্জস্য নেই। তাই আমাদের দেশে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া সহজ হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণায় উৎসাহ কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে শিক্ষকদের মধ্যে পর্যাপ্ত উৎসাহ ও বাধ্যবাধকতা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন গবেষণায় বরাদ্দ কমিয়ে অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় করছে বেশি। জ্ঞান সৃষ্টিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন অবদান রাখছে, এর বড় একটি মাপকাঠি হলো তার গবেষণা কার্যক্রম। কিন্তু এখন সেদিকে নজর কম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এ কারণে বিশ্বের শীর্ষ হাজার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ৩১ দশমিক ৮৭ শতাংশই অধ্যাপক। এত-সংখ্যক অধ্যাপক হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশে তেমন একটা দেখা যায় না। ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক মাত্র ১০ শতাংশ, যাদের বেশির ভাগই আবার চুক্তিভিত্তিক। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপকদের হার ২২ শতাংশের কিছু বেশি। আমাদের দেশে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষকের মধ্যে পিএইচডি সম্পন্নকারী শিক্ষকের হার মাত্র ৩৮ দশমিক ০৩ শতাংশ, যেখানে ভারতে এ হার ৮১ দশমিক ০৩ শতাংশ। ‘স্কোপাস’ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি বৃহত্তম গবেষণাভিত্তিক তথ্যব্যাংক, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা মূল্যায়নকৃত (পিয়ার-রিভিউড) গবেষণাপত্রের দেশভিত্তিক উপাত্ত নিয়মিত প্রকাশ করে। স্কোপাসের হিসাবে, সর্বশেষ ২০২৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের গবেষকেরা প্রকাশ করেছেন ২ লাখ ৮৭ হাজার ৮০২টি গবেষণাপত্র, পাকিস্তানের গবেষকেরা ৩৭ হাজার ৫২৬টি, আর বাংলাদেশের গবেষকেরা প্রকাশ করেছেন মাত্র ১৫ হাজার ৪১৩টি গবেষণাপত্র। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বৈশ্বিক জ্ঞানরাজ্যে সংখ্যাগত দিক থেকে আমাদের অবদান কোন পর্যায়ে রয়েছে!
বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন অধ্যাপকের ভারে অনেক ভারাক্রান্ত। চাকরির বয়স ১২ বছর পূর্ণ হলেই যে কেউ অধ্যাপক হয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ তারও আগে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। মানহীন ও ভুঁইফোঁড় অনলাইনে আর্টিকেল প্রকাশ করেও অধ্যাপক হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ কখনো তাদের বলেন না বা জবাবদিহির আওতায় আনেন না যে, এত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক থাকতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কেন বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে স্থান পাচ্ছে না বা নিজ অবস্থান উন্নত করতে পারছি না? কেন এত-সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে গুণগত বা মানসম্মত গবেষণা করতে পারছি না? কেন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমের মাত্রা ও পরিধি বাড়াতে পারছি না? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার আপনার পদোন্নতি ঠিকই দিচ্ছে, কিন্তু বিনিময়ে আপনি বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশকে কি সঠিক প্রতিদান দিচ্ছেন?
উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মূল কর্মকাণ্ডই পরিচালিত হয় গবেষণাকে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যার দরুন দেশে উচ্চশিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সর্বশেষ বৈশ্বিক বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান অতিশয় নিচের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মান ও মূল্যায়নের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবছর র্যাংকিং প্রকাশ করে। এসব র্যাংকিংয়ের মানদণ্ডে কিছুটা তারতম্য থাকলেও মূল সূচকগুলো মৌলিকভাবে প্রায় একই রকম। এর মধ্যে স্বনামধন্য ও প্রভাবশালী দুটি বৈশ্বিক শিক্ষা ও গবেষণা র্যাংকিং সংস্থা হলো যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং’ ও ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং’। এই দুটো র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান তলানিতে। গত জুন মাসে কিউএস ২০২৬ সালের জন্য বিশ্বসেরা দেড় হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর মধ্যে সবার ওপরে অবস্থান করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। র্যাংকিংয়ে ঢাবির অবস্থান ৫৮৪তম। শুধু ৬০০তম অবস্থানের মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্জিত বিভিন্ন সূচক প্রকাশ করেছে কিউএস। র্যাংকিংয়ে জায়গা পাওয়া দেশের বাকি ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিরই সামগ্রিক স্কোর উল্লেখ করেনি কিউএস। তাদের অবস্থান যথাক্রমে নর্থ সাউথ ৯৫১-১০০০তম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ৭৬১-৭৭০তম ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ১০০১-১২০০তম। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১২০১-১৪০০তম অবস্থানের মধ্যে রয়েছে। বাকি সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৪০০তম অবস্থানের ওপরে স্থান পেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মকাণ্ডই হলো সব র্যাংকিংয়ের জন্য প্রধান ও মূল মানদণ্ড। তাই দেশের উচ্চশিক্ষা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় গুণগত, কার্যকর ও নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমের দিকে জোর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা শুধু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পড়ানো বা খাতা নিরীক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সমাজের উন্নয়নে নিরন্তর গবেষণা ও গুণগত মানসম্পন্ন প্রকাশনা নিশ্চিত করাও তাদের মূল দায়িত্বের একটি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মানসম্মত গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির সঠিক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
উন্নত বিশ্বের একাডেমিয়ায় ‘পাবলিশ অর পেরিশ’ একটি বহুল প্রচলিত ধারণা, অর্থাৎ হয় প্রকাশনা করো, না হয় ধ্বংস বা ক্ষয়প্রাপ্ত হও। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা গবেষকদের অবশ্যই গবেষণা করে তা প্রকাশ করতে হবে, অন্যথায় তাদের কর্মজীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রচলিত নিয়োগ ও পদোন্নতির পদ্ধতিকে শিক্ষকদের প্রকাশনাবিমুখতার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। বিশ্বের নামকরা প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শুধু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য গবেষকরা, যাদের শীর্ষ জার্নালে ভালো ও গুণগত মানের গবেষণা প্রকাশনা, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষায় অবদান, গবেষণায় সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে, তাদেরই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে তার ধারেকাছেও নেই ইউজিসির এসব নির্দেশিকা ও শর্ত। তারপরও আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মানা হয় না নামমাত্র এসব শর্ত।
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা হয়ে গেছে পদোন্নতির একটি মাধ্যমে। শুধু পদোন্নতি, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন (এমফিল বা পিএইচডি) ও আর্থিক বিষয়-সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে আর্থিকভাবে লাভবানের নিমিত্তে নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণা ও প্রকাশনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যারা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার এসব গবেষণা প্রকল্পের অনুমোদন দিচ্ছেন এবং দেখভাল করছেন, তারাও জানেন সেটা শুধু নামসর্বস্ব প্রকল্প, এতে দেশ ও জাতির তেমন কোনো উপকার হবে না।
তাছাড়া দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির মানদণ্ড হিসেবে শুধু পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশনার সংখ্যাই বিবেচিত হচ্ছে। সেখানে জার্নাল প্রকাশনাগুলোয় সহ-লেখকের সংখ্যা সম্পর্কে গবেষণার মানদণ্ডে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোর জন্মলগ্ন থেকেই মেধাবী ছাত্ররাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে আসছেন। অথচ প্রকাশনায় তাদের অবদান বেশ হতাশাজনক। মেধার কমতি নেই, আছে মেধার ব্যবহার বা প্রয়োগের কমতি। এই দুরবস্থার দায় শুধু নিয়োগনীতির অব্যবস্থাপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই, বরং পরিকল্পনাহীন মানবসম্পদনীতিতেও বড় ধরনের গলদ রয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যত দিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ডেটাবেসগুলোকে বাদ দিয়ে নামসর্বস্ব ‘স্বীকৃত জার্নাল’–এর পেছনে ছুটবে, তত দিন পর্যন্ত মানসম্পন্ন গবেষণা বা প্রকাশনা কোনোটাই আশা করা যায় না। তাই সময় এসেছে শিক্ষকদের পদোন্নতিতে বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে গুণগত ও মানসম্মত গবেষণার বাধ্যবাধকতা আনয়ন এবং নিজের অবদানকে আবশ্যিক প্রতিপালনীয় শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণের।
গবেষণা শুধু ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারই নয়, একটি জাতির জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গঠনেরও হাতিয়ার। আমাদের দেশের শিক্ষকরা যদি নিয়মিত, গুণগত ও মানসম্মত গবেষণায় সম্পৃক্ত হন, তবে তা তাদের পদোন্নতি, প্রতিষ্ঠানের র্যাংকিং এবং সর্বোপরি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানকে এগিয়ে নেবে। তাই গবেষণাকে শিক্ষকতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাই বলা যায়, ‘গবেষণাহীন শিক্ষকতা পথহীন যাত্রার সমান।’
উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মূলত তিন ক্যাটেগরিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়; যেমন গবেষণাভিত্তিক, গবেষণা ও শিক্ষকতাভিত্তিক এবং শুধু শিক্ষকতাভিত্তিক। শিক্ষকদের লেকচারসংখ্যা নির্ভর করে তাদের গবেষণার ওপরে। গবেষণা ও প্রকাশনা যত বেশি, শ্রেণিশিক্ষার পরিমাণ তত কম। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও এই মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রতিটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হারে রিসার্চ ফ্যাকাল্টির নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন, যাদের কাজ হবে স্বীকৃত ও মানসম্পন্ন সাময়িকীতে প্রকাশনা নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণায় পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া ছাড়াও অন্য বাজেটভিত্তিক রিসার্চ মেথডোলজি প্রয়োগ করে (যেমন শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে সার্ভে ডিজাইন, কেস স্টাডি, রিভিউ পেপার, এথনোগ্রাফি, নেটনোগ্রাফি এবং কোয়ালিটেটিভ ইন্টারভিউ) সার্বিক গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শক্তিশালী গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করেন এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে গবেষণা করেন, তবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক গবেষণা আউটপুট বৃদ্ধি করবে এবং প্রাণবন্ত গবেষণার পরিবেশ তৈরি হবে। শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের গবেষক তৈরি হবে। একজন শিক্ষকের এই প্রচেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গবেষক তৈরিতে সহায়ক হয়, যা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়িত্ব ও অবদানস্বরূপ বিবেচিত হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। একজন শিক্ষকের সাফল্য বা পদোন্নতি শুধু গবেষণাপত্রের সংখ্যায় নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানবিস্তার ও গবেষণার প্রভাবেই পরিমাপ করা উচিত। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত একজন শিক্ষকের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি নিজ অবদানের একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা, যা পদোন্নতির সময় বিবেচনা করা হবে। এক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করা যেতে পারে, যেমন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রকাশিত গবেষণাকর্ম ও পত্রের সংখ্যা, শিক্ষার্থীর গবেষণায় অংশগ্রহণের ধরন এবং গভীরতা, বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের ভূমিকা, শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য প্রাপ্ত অনুদান বা পুরস্কারের সংখ্যা প্রভৃতি। মৌলিক গবেষণা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। আর মৌলিক গবেষণার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
আজকের প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে শুধু ক্লাসরুমে পাঠদান করেই শিক্ষক তার দায়িত্ব শেষ করতে পারেন না। একাডেমিক গবেষণা এখন শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতি ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধির জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। গুণগত ও মানসম্মত গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষকরা যেমন নিজেদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারবেন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের র্যাংকিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।
লেখক : উপপরিচালক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস