বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করেছিল। সে ঐক্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এ দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জুলাই বিপ্লবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হলত্যাগে যখন বাধ্য করা হয়, তখন আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। তখন এগিয়ে আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এরপরই পাল্টে যেতে থাকে আন্দোলনের মোড়। একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয় আন্দোলন। আগের অন্যান্য আন্দোলনের চেয়ে এবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল বেশি।
২০১০ ও ২০১৫ সালে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান জাতীয় ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সরকারি চাকরিতে যৌক্তিক কোটা সংস্কার দাবিতে ২০২৪ সালে আন্দোলন শুরু হয়ে যা পরে স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার চিন্তা খুব একটা করে না। কিন্তু তারপরও কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এভাবে রাস্তায় নেমে আন্দোলনের অন্যতম শক্তি হয়ে উঠবে, সেটা সরকারের ধারণার বাইরে ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল নিঃস্বার্থভাবে দেশের প্রয়োজনে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ভাই-বোনদের প্রতি সহমর্মী হয়ে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু সংগঠিত হয়ে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা প্রথম ১০ জুলাই রামপুরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছিল এবং ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতন পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিল।
১৪ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পরদিন আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
১৫ জুলাই থেকে বড় আকারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আন্দোলন শুরু হয়। এদিন সকাল ১০টায় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নতুন বাজারে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসের সামনের মূল সড়ক অবরোধ করে। পরে তাদের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সসহ (ইউআইটিএস) আশপাশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয়। একই দিনে রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এবং যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি) ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। ফলে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক কার্যত অচল হয়ে যায়। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ১৬ জুলাই সারা দেশের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সারা দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ওপরেও হামলা করেন। ১৬ জুলাই নতুন বাজার থেকে ইউআইইউ যাওয়ার রাস্তার প্রতিটি মোড়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে সকাল থেকে অবস্থান নেন। বিশ্ববিদ্যালয়মুখী শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড চেক করে হেনস্তা ও মারধর করা হয়। পরে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। সেখানে ইউআইইউয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও ছিল। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে নতুন বাজারের রাস্তা অবরোধ করে। আগের দিনের মতোই ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, নর্থ সাউথ আইইউবির শিক্ষার্থীরা রামপুরা ও যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের রাস্তা দখলে রাখে। সেদিন উত্তরায় নর্দান ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি ও উত্তরা ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। অর্থাৎ উত্তরা থেকে রামপুরা পর্যন্ত পুরো অঞ্চলটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে ছিল। পাশাপাশি ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশসহ (ইউল্যাব) রাজধানীর অন্যান্য এলাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
১৭ জুলাই রাতে পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রে হামলা চালায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি করার পর সরকার ভেবেছিল এই আন্দোলন এখানেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু পরের দিন ১৮ জুলাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নামে।
১৮ জুলাই ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে নেমে এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হচ্ছিল, তখন খবর আসে, রামপুরায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পুলিশ হামলা করেছে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পাশে দাঁড়াতে গেলে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। সংঘর্ষ এতটাই প্রকট ছিল, পুলিশের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পর আত্মরক্ষার্থে তারা ক্যানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে হাত জোড় করে ক্ষমা চায়, স্যালুট দেয়। তারপর এয়ারফোর্স ও র্যাবের দুটি হেলিকপ্টারে করে ছাদ থেকে পালিয়ে যায় তারা।
পুলিশ বিনা উসকানিতে রামপুরা, উত্তরাসহ বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে। শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়। অনেকে নিজের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দেয়, কিন্তু কেউ পালিয়ে যায়নি। রাস্তা দখলে রেখেছে এবং শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মধ্যবাড্ডায় ইউআইইউয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। পুলিশের গুলিতে ইম্পেরিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী শহীদ হন।
একইভাবে উত্তরাসহ ঢাকার অনেক জায়গায় সেদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলে, সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। ফলে ১৮ তারিখে সরকার কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা আজই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসতে চায়। শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করার পর সরকার সারা দেশে কারফিউ ঘোষণা করে।
১৯ জুলাই শুক্রবার পুরো ঢাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রামপুরা, বনশ্রী ছিল এর মধ্যে অন্যতম স্পট। সেদিন আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বনশ্রী আবাসিক এলাকা হওয়ায় বরাবরই সেখানে কোনো সংঘাতের ঘটনা শোনা যায়নি। সেদিনও সকাল থেকেই তেমনই ঠান্ডা পরিবেশ বিরাজ করছিল। কিন্তু দুপুরে জুমার নামাজের পরপরই এলাকাবাসী এক ভিন্ন বনশ্রী দেখতে শুরু করে।
বনশ্রী ব্লক-এতে সেদিন মানুষের ঢল দেখতে পেয়ে বিজিবি রামপুরা ব্রিজ থেকে ঢালাওভাবে মেশিন গান থেকে গুলি ছুড়তে থাকে। পরে হেলিকপ্টার থেকেও গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এদিন ২৫ থেকে ৩০ জন মানুষ এখানে শহীদ হয়।
পরে এই রণক্ষেত্র পুরো বনশ্রীতে ছড়িয়ে যায়। মেরাদিয়া এলাকায় পিবিআই অফিসে ভাঙচুর ও আগুন দেয় ক্ষুব্ধ জনগণ। রামপুরা থানায়ও হামলা চালানো হয়। এলাকাবাসীর তথ্যমতে, মেরাদিয়া রোডে ১৫ থেকে ২০ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। বিকালের পরে সেই রাস্তায় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ককটেল ও লাইভ গ্রেনেড ছোড়া হয়। এতেও পরিবেশ শান্ত না হলে হঠাৎ আবাসিক ভবনে তারা আক্রমণ করে। এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত তারা আক্রমণ চালিয়ে যায়।
তখন পুলিশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণগ্রেপ্তার ও নির্যাতন চালায়। প্রতিটি মহল্লায় মহল্লায় ব্লক রেইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে সবচেয়ে বেশি অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে গুলশান বিভাগের তিনটি থানায়। এই বিভাগে শুধু বাড্ডা থানায় ১১টি মামলার প্রতিটিতে সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। গুলশান থানায় ছয়টি মামলার প্রতিটিতে সর্বনিম্ন ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। ভাটারা থানায় চারটি মামলায় সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এই তিনটি থানার আওতায় সবচেয়ে বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত।
শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়েছে। দিনের পর দিন ফেরারি জীবন কাটাতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। রাস্তায় বের হওয়ার আগে মোবাইলের সব ছবি-ভিডিও ডিলেট করে, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপগুলো আনইন্সটল করে বের হতে হতো, কারণ রাস্তায় পুলিশ মোবাইল চেক করত। যেখানে কর্মসূচি সেখানে গিয়ে লুকিয়ে রাখা আইডি কার্ড বের করে গলায় পরত শিক্ষার্থীরা।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তার যথার্থ মূল্যায়নটুকু পায়নি। তাদের কার্যত ছুড়ে ফেলা হয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করলেও ইতিহাসের পাতা থেকে তাদের অবদানকে মুছে ফেলা যাবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়