গতকাল ভ্যাটিক্যান সিটিতে পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে বিশ্বনেতৃবৃন্দ ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণ যে নিয়মানুবর্তিতা ও সুশৃঙ্খলার পরিচয় প্রদান করিয়াছেন, তাহা লইয়া বিদগ্ধ মহলে আলোচিত হইতেছে। সিএনএন বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই সংক্রান্ত লাইভ অনুষ্ঠান যাহারা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাহাদের নিকট বিষয়টি অনস্বীকার্য। একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও কী প্রকারে সামরিক বাহিনীর ন্যায় নিয়মানুবর্তিতা রক্ষা করিয়া কেবল মূল অনুষ্ঠানের প্রতি মনোযোগ ধরিয়া রাখা যায়, তাহা এই অনষ্ঠান হইতে সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব। এইখানে যেমন কোনো বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয় নাই, তেমনি কোনো ব্যক্তিগত প্রচারের অবকাশ ছিল না মোটেও।

অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও আমরা প্রায়শ বিশৃঙ্খলা অবলোকন করিয়া থাকি। কোনো কোনো দেশে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নেতার মাজার জিয়ারতের ন্যায় একটি ধর্মীয় পরিবেশেও হুড়াহুড়ি ও ধাক্কাধাক্কি লাগিয়া থাকিতে দেখা যায়। কে কাহার পূর্বে পুষ্পমাল্য অর্পণ করিবেন কিংবা টিভি-ক্যামেরার সম্মুখে আসিবেন-ইহা লইয়া অনেক সময় তৈরি হয় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি। সেই ভিড়ের চাপে অনেক বয়োবৃদ্ধ ও সিনিয়র নেতার মাটিতে পড়িয়া যাওয়া কিংবা এই জন্য কর্মীদের বকাঝকা করিবার দৃশ্যও অতীতে দেখা গিয়াছে। যেই স্থলে শোকের আবহ বিদ্যমান থাকিবার কথা, সেই স্থলে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অযৌক্তিক ও অপ্রত্যাশিত। ইহার মূল কারণ, আমাদের মধ্যে নিয়ম মানিয়া চলিবার অভাব এবং সামগ্রিকভাবে শৃঙ্খলার প্রতি ঔদাসীন্য। অথচ কোনো জাতি নিয়ম-শৃঙ্খলা অর্জন ব্যতীত সভ্য ও উন্নত হইতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষ্য প্রদান করে, যেই সকল দেশ আজ উন্নতির শিখরে আরোহণ করিয়াছে, তাহাদের অগ্রযাত্রার প্রধান একটি কারণ হইল তাহাদের জনগণের নিয়মানুবর্তিতা এবং সমাজ, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি স্তরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা। মানুষ যখন নিয়ম মানিয়া চলে, তখন সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পায়, অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ইহাতে সামাজিক সংহতি দৃঢ় হয় এবং একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের অপরিহার্য পূর্বশর্ত।

এই জন্য প্রবাদে আছে, ডিসিপ্লিন ইজ ফার্স্ট বা শৃঙ্খলাই প্রথম। তবে আমরা মনে করি, ডিসিপ্লিন ইজ ফার্স্ট, ডিসিপ্লিন ইজ সেকেন্ড অ্যান্ড ডিসিপ্লিন ইজ লাস্ট। অর্থাৎ শৃঙ্খলাই প্রথম, দ্বিতীয় ও শেষ কথা। প্রয়োজনে নিয়ম-শৃঙ্খলা বা আইন সংশোধনের দাবি আমরা তুলিতেই পারি। ইহা অন্যায় ও অন্যায্য নহে; কিন্তু যতক্ষণ না তাহা সংশোধিত হয়, ততক্ষণ আমাদের সেই নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থাকিয়াই কাজ করিয়া যাইতে হইবে। অবশ্য উন্নয়নশীল দেশের সর্বত্র ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা কিছুটা কঠিন বইকি। কারণ এই সকল দেশে বিদেশি শক্তি দীর্ঘদিন ধরিয়া শাসন করিবার কারণে শাসকদের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করিবার বিষয়টি ছিল গৌন, তাই এখনো এই সকল দেশ রহিয়াছে বিশৃঙ্খল অবস্থায়। আবার বিদেশি শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে বারংবার বিদ্রোহ করিবার কারণেও বিনষ্ট হইয়াছে শান্তি, স্থিতি ও শৃঙ্খলা।

বস্তুত প্রতিটি ধর্মের মূল ভিত্তি হইল ইমান বা বিশ্বাস। এই বিশ্বাসবোধ মানব জীবনে শৃঙ্খলা আনয়ন করে এবং সকল প্রকার উচ্ছৃঙ্খলতা পরিহার করিয়া চলিতে উদ্বুদ্ধ করে। ইহাই একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভিত্তিমূল। ইহা ছাড়া এই জগতের সকল কিছুর ভিতরে যে আশ্চর্য শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রহিয়াছে, প্রকৃতির সেই অন্তর্নিহিত শক্তির কথাও স্মরণে রাখা আবশ্যক। মোদ্দা কথা, পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের সুশৃঙ্খল চিত্র উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য শিক্ষণীয়। এই জন্য এই সকল দেশে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করিতে হইবে। তাহাদের আচার-আচরণ ও বক্তব্য যেন মানবগণকে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করে, সেই দিকেও লক্ষ রাখিতে হইবে।

সূত্র, ইত্তেফাক