ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। জুলাই বিপ্লবের গণম্যান্ডেট থেকে জন্ম নেওয়া এ সরকার দাঁড়িয়েছিল এক রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে, যেখানে বাংলাদেশ যেন দুই বংশগত জমিদারের যৌথ সম্পত্তি—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালা করে মালিকানা ভোগ করে আর সাধারণ মানুষ থাকে শুধু ‘সহনশীল ভাড়াটিয়া’ হিসেবে। আওয়ামী লীগ বিতাড়িত হলে বিএনপির মধ্যে জেগে ওঠে উত্তরাধিকার অধিকারবোধ। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারকে সুবহে-শাম ইলেকশনের জন্য কামান দাগাতে থাকে। যদিও ইলেকশনের একটা খুচরা তারিখ হয়েছে, তবে আমি যথেষ্ট সন্দিহান আদৌ ওই তারিখে ইলেকশন হবে কি না, কারণ বাংলাদেশে বর্তমানে ইলেকশন হওয়ার মতো কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও অবহি নির্বাচন বিষয়ে কালেক্টিভলি কোনো কনশাসনেসে আসতে পারেনি এবং তারা স্ট্র্যাটেজিক এসেনশিয়ালিজম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে—প্রথমটি হলো, বিচারের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি, অপরাধীরা অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাষ্ট্রের কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার হয়নি।

মানুষের যে উমিদ ছিল, সরকারের কাছে তার সিকিভাগও পূরণ হয়নি। তা ছাড়া এতগুলো মানুষ জীবন দিয়েছে শুধু একটি নির্বাচনের জন্য নয়, বরং পুরো রাষ্ট্রকাঠামো বদলানোর জন্য। বোধ করি, সবচেয়ে বড় কারণটা হলো ১৩ জুন তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের লন্ডন বৈঠক। এই বৈঠকের কারণে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। তারা মনে করে, এ দুজন বসে সামনে একটা সমঝোতা নির্বাচন করে একটি নির্দিষ্ট দলকে ক্ষমতায় নিয়ে বসাতে চায়। তা ছাড়া ডক্টর ইউনূসের বোঝা উচিত, একটি দল তো পুরো বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না। আদতে, এ সরকারের বেশুমার ব্যর্থতার মধ্যে ও বেশ কিছু ক্ষেত্রে কাময়াবি দেখিয়েছেন। যেমন—অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, অর্থ উপদেষ্টা রিজার্ভ স্থিতিশীল করেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধে রেকর্ড গড়েন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও রুগ্ণ ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। তবে আওয়ামী লীগের কালোটাকার অর্থনীতির পতনে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, লুণ্ঠক কারখানা মালিকরা পলাতক হলে শ্রমিকরা কাজ হারান।

আইন উপদেষ্টার দায়িত্ব ছিল সবচেয়ে কঠিন। দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের অপরাধে মশগুল ছিল। তবু তিনি কিছু আইন সংস্কার করেন, যার সুফল ভবিতব্যে মিলবে, তবে তা আওয়ামের তামান্নার ধারেকাছে না। সংস্কৃতি উপদেষ্টা দেরিতে দায়িত্ব নিলেও জুলাই বিপ্লবের ইতিহাস নথিভুক্ত করা ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতিচর্চায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যোগাযোগ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং সফলতার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করছেন। পরিবেশ, নৌপরিবহন, পররাষ্ট্র ও জাতীয় নিরাপত্তা খাতে উপদেষ্টাদের সক্রিয়তা ছিল লক্ষণীয়। এখানে ড. ইউনূসের অবস্থা আলবার্ট কামুর সিসিফাস রূপকের মতো। যেমন : সিসিফাস চূড়ান্ত লক্ষ্যহীনভাবে পাহাড়ের শীর্ষে পাথর ঠেলতে থাকে, তেমনি ইউনূসও রাজনৈতিক চক্রান্ত, ক্ষমতার খেলাপথ, অস্থির প্রশাসন ও তুচ্ছ রাজনীতির মুখোমুখি হয়ে প্রতিদিন ‘শীর্ষে পাথর ঠেলা’ অবস্থা অনুভব করেন। প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা, প্রতিটি সিদ্ধান্তে সমালোচনা। তবু তিনি, কামুর ভাষায়, ‘সন্তুষ্টির সাহস’ নিয়ে অদম্য মানসিকতায় দায়িত্ব পালন করছেন—যেমন সিসিফাস পাথরকে চূড়ান্তে ঠেললেও নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে।

যাই হোক, বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন, উপনিবেশকালীন শাসন-অভিজ্ঞতা এবং স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক যাত্রা সবসময়ই এক ধরনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে।

ব্রিটিশ আমলের আইন, পাকিস্তানি আমলের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং স্বাধীনতার পরের দলীয় দখলদারিত্ব—সব মিলিয়ে বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে স্পষ্ট দেশে এখন এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপ্রশাসনের মূল লক্ষ্য জনগণ নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থরক্ষা। একে বলা যায় ‘এলিট ক্যাপচার’, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের পরিবর্তে একটি ক্ষুদ্র এলিট শ্রেণির হাতে বন্দি থাকে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ একদলীয় প্রবণতা এবং নির্বাচনি অনিয়ম এই কাঠামোকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। জন লকের সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট থিওরি বলছে, যখন সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন জনগণের অধিকার থাকে নতুন ব্যবস্থা গড়ার। এখানেই প্রয়োজন একটি নতুন ফাউন্ডেশন বা ‘প্রাথমিক সংস্কার প্ল্যাটফর্ম’ তৈরি করার, যা ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকে সঠিক পথ দেখাবে। রুসোর জেনারেল উইল তত্ত্ব অনুযায়ী, আইন ও প্রতিষ্ঠান জনগণের সার্বিক ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হলে সেই আইন বৈধতা হারায়। বর্তমান সংবিধান ক্রমাগত সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে একদলীয় কেন্দ্রীকরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হলো, নির্বাচনের আগে এমন একটি বিকেন্দ্রীভূত কাঠামো গড়ে তুলবে, যেখানে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার হবে এবং মানুষ নির্বাচনে নিঃশঙ্কচিত্তে অংশগ্রহণ করবে। এমন অন্তর্বর্তী রূপান্তরের উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে ক্ষমতায় এসে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করেছিলেন, যাতে বর্ণবৈষম্যমূলক কাঠামো ভেঙে নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা যায়। পোল্যান্ড ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট শাসনের পতনের পর রাউন্ড টেবিল আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিল, যা মুক্ত নির্বাচন আয়োজন করে। নেপাল ২০০৬ সালে রাজতন্ত্র পতনের পর অন্তর্বর্তী সংসদের মাধ্যমে গণতন্ত্রের রোডম্যাপ তৈরি করেছিল। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে—দ্রুত নির্বাচনের চেয়ে আগে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করাই স্থায়ী সমাধান।

১৯৭৫-৭৭ সালে বাংলাদেশের মোশতাক-সায়েম ও জিয়ার অধীনে সাংবিধানিক পরিবর্তন, যদিও তা গণতন্ত্রবিরোধী ছিল, তবে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া প্রমাণ করে যে অন্তর্বর্তী সরকারও মৌলিক কাঠামো বদলাতে সক্ষম। গণতন্ত্রকে টেকসই করতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। অ্যালেক্সিস দ্য তকভিল স্থানীয় গণতন্ত্রকে জাতীয় গণতন্ত্রের বিদ্যালয় বলেছেন আর রবার্ট ডালের পলিআর্কি মডেলও দেখিয়েছেন—স্থানীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ছাড়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিভাগীয় ও গ্রামীণ পর্যায়ে সরাসরি নির্বাচন, মসজিদ-স্কুল-মাদরাসায় অভিভাবক কমিটি গঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত ছাত্রসংসদ নির্বাচন প্রয়োজন। ভারতের ১৯৯২ সালের পঞ্চায়েত রাজ সংশোধনী গ্রামীণ ক্ষমতায়ন বাড়িয়েছে, সুইজারল্যান্ড ক্যান্টনভিত্তিক গণভোটের মাধ্যমে জনগণকে নীতিনির্ধারণে যুক্ত করেছে আর ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রে শহরে অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রক্রিয়া জনগণের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।

বর্তমান সরকার এই সুযোগ নষ্ট করেছে; সরকার এই পদক্ষেপ নিতে পারত। কিন্তু শুধু নির্বাচনি সংস্কার যথেষ্ট নয়; বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামোরও পুনর্গঠন দরকার। মন্টেস্কিয়ুর ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্বে বলা হয়েছে—বিচার বিভাগ যদি নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকে, তবে স্বাধীনতা থাকে না। মিশেল ফুকো সতর্ক করেছিলেন—শাস্তিমূলক ক্ষমতা যদি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক না হয়, তবে তা জনগণকে দমনের যন্ত্রে রূপ নেয়। বাংলাদেশের জন্য মানবাধিকার কমিশনের অধীনে রিমান্ড পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা, আমলা ও পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করার সুযোগ দেওয়া এবং স্বাধীন পোস্টমর্টেম কমিশন গঠন জরুরি। হংকংয়ের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন, যুক্তরাজ্যের পুলিশ জবাবদিহি সংস্থা আর আর্জেন্টিনার সামরিক শাসনোত্তর বিচার সংস্কার এসবের বাস্তব উদাহরণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামরিকীকরণ কমানোও অপরিহার্য। ম্যাক্স ওয়েবারের ব্যুরোক্রেটিক নিউট্রালিটি বলছে, রাষ্ট্রযন্ত্র নিরপেক্ষ হতে হবে, সামরিকীকৃত নয়। র‍্যাবকে ‘ন্যাশনাল পুলিশ’ হিসেবে রূপান্তর করা এবং সেনাবাহিনীকে শুধু প্রশিক্ষণ প্রদানে সীমাবদ্ধ রাখা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বাড়াবে।

লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ যেমন—চিলি, আর্জেন্টিনা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সময় সামরিক পুলিশের পরিবর্তে বেসামরিক পুলিশব্যবস্থা তৈরি করেছে। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ পুলিশ বেসামরিকীকরণ করেছিল, ফিলিপাইনও সামরিক প্রভাব সীমিত করেছে।

আর গণতান্ত্রিক সমাজে ভোক্তা অধিকার ও স্বাস্থ্য খাতকে অবহেলা করা যায় না। অমর্ত্য সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ বলছে—স্বাস্থ্য ও মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থহীন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ, জেনেরিক প্রেসক্রিপশন বাধ্যতামূলক করা এবং ভোক্তা সোসাইটি গঠন প্রয়োজন। এটি শুধু অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারই নয়, বরং নাগরিক ক্ষমতায়নের পথ খুলে দেয়। থাইল্যান্ডের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, কিউবার বিনামূল্যের চিকিৎসা ও ওষুধ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা, কানাডার ভোক্তা সুরক্ষা আইন—সবই উদাহরণযোগ্য। জাস্টিস এজ ফ্যায়ারনেস

বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা হবে গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। জেরেমি বেনথামের ওপেন জাস্টিস নীতি এবং Rawls-এর জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস তত্ত্ব অনুযায়ী, বিচারপ্রক্রিয়া সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়া এবং বিলম্ব কমানো জরুরি (১৫ দিনের বেশি শুনানির বিরতি না থাকা)।

কারণ বিচার বিলম্বিত হলে তা অন্যায়ে পরিণত হয়। বাংলায় বিচারপ্রক্রিয়া, জুরি বোর্ডের সুযোগ, তারিখ পরিবর্তনের সীমা ও নির্দিষ্ট সময়ে শুনানি সম্পন্ন করা জরুরি। বিচারব্যবস্থা থেকে দলীয় নিয়োগপ্রাপ্তদের অপসারণ, পাশাপাশি আদালতের অপব্যবহার ঠেকাতে সরকারি পক্ষের প্রভাব বন্ধ করা। সিঙ্গাপুর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, ফ্রান্সের প্রকাশ্য আদালত, জাপানের জুরি সিস্টেম পুনঃপ্রবর্তন—এসবই আস্থা ফেরাতে কার্যকর। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্র–অর্থায়িত আইনজীবী ও স্বাস্থ্যসেবা দল গঠন প্রয়োজন। রলসের ডিফারেন্স প্রিন্সিপাল বলছে, উন্নয়নের সুফল প্রথমে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। রাষ্ট্র বেতনভিত্তিক আইনজীবী দল ও মোবাইল মেডিকেল টিম রাখবে মারজিনালাইজড নাগরিকের সহায়তার জন্য। এ কাজে ফাইনাল ইয়ারে পড়া মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত করা যেতে পারে। ব্রাজিল, ভারত ও কিউবা এ ক্ষেত্রে সফল উদাহরণ।

একইভাবে ভূমিব্যবস্থার স্বচ্ছতাও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল টেপেস্ট্রি। কারণ সম্পত্তি অধিকারের স্বচ্ছতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি। এস্তোনিয়া, ভারতের কর্ণাটক ও রুয়ান্ডার ভূমি ডিজিটালাইজেশন এই ক্ষেত্রে পথ দেখায়।

সবশেষে, ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ করা ছাড়া এই সংস্কার টিকে থাকবে না। হান্না আরেন্ট সতর্ক করেছেন—ফ্যাসিবাদ সময়মতো ঠেকানো না গেলে তা রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ে। জার্মানি, ইতালি ও স্পেনের ইতিহাস দেখিয়েছে, ফ্যাসিস্ট দলকে আইনি ব্যান দেওয়া না হলে গণতন্ত্র নিরাপদ হয় না। তাই আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্র নথিভুক্ত করে একেবারে ব্যান করে দেওয়া উচিত। এসব সংস্কার বাস্তবায়িত হলে শুধু একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই নয়, বরং একটি টেকসই ও মুক্ত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, যা জনগণকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতার উৎসে পরিণত করবে। আসলে তখনই গণতন্ত্র বিকশিত হবে, যখন নাগরিকরা ভয়হীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবে এবং রাষ্ট্র তাদের মতামত নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত করবে। যেখানে নাগরিকরা স্বাধীনভাবে আলোচনায় অংশ নিতে পারে, সেখানেই প্রকৃত গণতন্ত্র জন্ম নেয়। বর্তমান সরকার তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বর্তমান সরকার দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এই পদক্ষেপগুলো এ সরকারের শুরুতেই নেওয়া উচিত ছিল। আর ফ্যাসিবাদের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা তৈরি করার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, যাতে জাতি বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে পারে। আমি ভেবেছিলাম, ফ্যাসিস্ট পতনের পর পুরোনো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজাতরা কিছু শিক্ষা নেবে। কিন্তু এক বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে ২০২৪-এর তারুণ্য যেমন আওয়ামী ফ্যাসিস্টকে ভারতে পালাতে বাধ্য করেছে, তেমনি নিকট ভবিষ্যতেও এ তারুণ্য নয়া ফ্যাসিস্টকে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দিতে পারবে। জুলাই বিপ্লব কোনো যবনিকা নয়—এটি শুধু সূচনা, আর ইউনূস সেই সূচনাকে ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন, সিসিফাসের মতো অবিরাম পরিশ্রমে।

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক

ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

সূত্র, আমার দেশ