দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির বড় অংশ নির্ভর করে কৃষির ওপর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জমির পরিমাণ হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাজারজাতকরণ সমস্যা কৃষি খাতকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে; কিন্তু এসব প্রযুক্তি যদি সঠিকভাবে কৃষকের কাছে পৌঁছাতে না পারে, তবে তার সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন টেকসই কৌশলের মাধ্যমে কৃষিপ্রযুক্তি হস্তান্তর।
টেকসই প্রযুক্তি হস্তান্তরের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো কৃষক থেকে কৃষক শেখা। কোনো এলাকায় একজন অগ্রণী বা প্রগতিশীল কৃষক নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করলে এবং তাতে লাভবান হলে আশপাশের কৃষকরাও দ্রুত তা অনুসরণ করে। এতে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত খরচও কমে যায় এবং বিশ্বাসযোগ্যতাও বাড়ে। অংশগ্রহণমূলক গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রযুক্তি উন্নয়নে কৃষকদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষক ও কৃষক একসঙ্গে মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে প্রযুক্তি স্থানীয় পরিবেশ ও চাহিদার সঙ্গে মানানসই হয়। এতে কৃষকরা মনে করেন, এটি তাদের নিজেদের প্রযুক্তি, ফলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। এ কৌশলটি নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশে ব্যাপকভাবে চর্চা হয়।
ফার্মার ফিল্ড স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে প্রযুক্তি বিস্তার সহজ হয়। এটি মাঠভিত্তিক এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এখানে কৃষকরা নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ, সমস্যার সমাধান এবং বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা লাভ করে। হাতে-কলমে শেখার এই পদ্ধতিটি টেকসই প্রযুক্তি হস্তান্তরে অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এটি উন্নয়ন সংস্থাগুলো হরহামেশাই ব্যবহার করে থাকে। স্থানীয় জ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় করে এগোতে পারলে প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে। গ্রামীণ কৃষকদের অনেক স্থানীয় জ্ঞান আছে, যেমনÑপোকা দমন, জৈব সার প্রস্তুত বা পানি ব্যবস্থাপনা। এসব ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করলে কৃষকরা দ্রুত গ্রহণ করতে পারে এবং দীর্ঘ মেয়াদে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার আধুনিক যুগের জন্য একটি আশীর্বাদ।
বর্তমানে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব ভিডিও, অ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষিপ্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কৃষকরা সহজেই ঘরে বসে চাষাবাদের আধুনিক কৌশল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং বাজারমূল্যের খবর জানতে পারছে। এটি সময় ও খরচসাশ্রয়ী একটি টেকসই কৌশল। এটির যথাযথ ব্যবহার করলে সুফল মিলবে। কৃষকপর্যায়ে সমবায় সংগঠন ও কৃষক ক্লাব প্রযুক্তি হস্তান্তরের একটির টিকসই কৌশল হতে পারে। যেমন : কৃষক সংগঠন, সমবায় সমিতি বা কৃষক ক্লাবের মাধ্যমে প্রযুক্তি হস্তান্তর করলে তা অধিক কার্যকর হয়। যৌথভাবে প্রযুক্তি প্রয়োগ করলে উৎপাদন খরচ কমে এবং বাজারজাতকরণ সহজ হয়। একই সঙ্গে কৃষকরা পারস্পরিক আলোচনা করে নতুন সমাধান বের করতে পারে।
প্রদর্শনী প্লট ও মডেল ফার্ম স্থাপন প্রযুক্তি হস্তান্তরের অন্যতম টেকসই মাধ্যম। যে প্রযুক্তি কৃষক চোখে দেখে এবং হাতে-কলমে শিখতে পারে, সেটি তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়। প্রদর্শনী প্লট বা মডেল ফার্ম কৃষকদের কাছে নতুন প্রযুক্তির বাস্তব চিত্র তুলে ধরে এবং তাদের আস্থা বাড়ায়। তাই প্রদর্শনী ও মডেল ফার্মের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। প্রযুক্তি হস্তান্তরে নারী কৃষকের অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্রামীণ সমাজে নারীরা কৃষি কর্মকাণ্ডে বড় ভূমিকা রাখলেও প্রযুক্তি হস্তান্তরে তাদের অংশগ্রহণ কম পরিলক্ষিত হয়। নারী কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সম্পৃক্তকরণ প্রযুক্তি হস্তান্তরের একটি টেকসই কৌশল হতে পারে। বিশেষ করে হাউসহোল্ডভিত্তিক কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বীজ সংরক্ষণ, মাশরুম উৎপাদন, জৈবসার তৈরি, গবাদি পশু, হাঁস-মুররি পালন, ছাদবাগান ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে।
সূত্র, আমার দেশ