জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জানিয়ে দিলেন, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঈদ উৎসবের আগেই তিনি ভোট উৎসব উদ্‌যাপন করতে চান। তার কথামতো পরের দিনই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনে চিঠি লিখে জানিয়ে দেওয়া হলো রোজার আগে নির্বাচন সম্পন্নের জন্য সব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে।

প্রধান উপদেষ্টার এই অবস্থান নেওয়ার পরেও কেউ কেউ এখনো নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখছেন। তার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন ‘ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে’ হওয়ার কথা বললেও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ তিনি এখনো ঘোষণা করেননি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখনো সময় ঠিক করেনি।

জামায়াতে ইসলামী পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য প্রায় অনড় ভাব দেখাচ্ছে। তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। আর এনসিপি তো ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না বলে ঘোষণাই দিয়েছে। যদিও এই ঘোষণা এনসিপির এক নেতার। এখনো এ বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত দেয়নি দলটি।

ঢাকায় এনসিপির যুব সংগঠন আয়োজিত জাতীয় যুবশক্তির সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়, তাহলে আমার যেই ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিলেন, রক্ত দিয়েছিলেন সংস্কারের জন্য, একটি নতুন সংবিধানের জন্য—তাদের লাশগুলো কবর থেকে তুলে এই সরকারকে ফেরত দিতে হবে। যদি সংস্কার ছাড়া, সংবিধান ছাড়া নির্বাচন হয়, তাহলে যে মায়ের বুক খালি হয়েছিল, তার বুকে সেই সন্তানকে ফেরত দিতে হবে।

নাসির পাটোয়ারি আরো বলেছেন, আরেকটা ফ্যাসিবাদের কারখানা রয়ে গেছে এখনো, তা হচ্ছে বঙ্গভবন। এটির পতন আপনাদের হাত ধরে হবে ইনশাআল্লাহ।

এনসিপি নেতা নাসির উদ্দিন পাটোয়ারির এই ঘোষণা নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির মাঠে হয়তো নির্বাচন নিয়ে সংশয়কে আরো উসকে দেবে।

নাসির পাটোয়ারির আরো একটি বক্তব্য অনেককে ভাবিয়ে তুলতে পারে। একই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে তার বক্তব্য অ্যালার্মিং মনে হতে পারে। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে সংস্থাটির সদর দপ্তর গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে নাসির পাটোয়ারি বলেছেন, একটা গোয়েন্দা সংস্থা আমার-আপনার পকেটের টাকায় চলে। তারা কত টাকা খরচ করে, বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারবে না। তাদের কোথাও দায়িত্ববোধ নেই, অ্যাকাউন্টেবিলিটি নেই, ট্রান্সপারেন্সি নেই; তাদের একটাই কাজ, মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করা—“কিছু বলবি ‘আয়নাঘরে’ নিয়ে আসব।” আপনার ‘আয়নাঘর’ তো ভেঙে দিয়েছি। সামনে যদি কোনো ‘আয়নাঘর’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, তাহলে আয়নাঘর কেন, ডিজিএফআইয়ের হেডকোয়ার্টার্স ভেঙে দেব।

বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাসগুলোর ভূমিকা নিয়েও কথা বলেছেন নাসির পাটোয়ারি; বলেছেন, এম্বাসিগুলো উৎপাত শুরু করেছে। যতগুলো এম্বাসি আছে, বাংলাদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে হবে। কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প অনেক সৃষ্টি করেছিলেন। লাভ নেই। আমরা এখনো জীবিত আছি। যদি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে লাভ করতে হয়, তাহলে আমাদের জীবনের ওপর দিয়ে করতে হবে।

ডিজিএফআই নিয়ে কথা বলেছেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহও। তিনি বলেছেন, ‘আমরা দেখেছি গুম, খুন ও হত্যার সঙ্গে কীভাবে রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলো জড়িত রয়েছে। ৫ আগস্টের আগে আমাদের ভিলেন বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা দেখেছি, এজেন্সিগুলো মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। এজেন্সিগুলো ব্যুরোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করে। সেজন্য ডিজিএফআই নামে যে সংগঠনটি রয়েছে, সেটির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আপনি দেখবেন, ডিজিএফআইয়ের কাছে বিদেশে বাংলাদেশ নিয়ে কী ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেটি নিয়ে কোনো তথ্য নেই। তারা একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আরেকটা রাজনৈতিক দলের, একটা রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আরেকটা রাজনৈতিক দলকে কীভাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়, সেটি নিয়ে তারা দিনরাত ব্যস্ত থাকে।’ ডিজিএফআইকে সংস্কারের দাবি জানিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটাকে ব্যান করে দিতে হবে।’

গণমাধ্যম কীভাবে ডিজিএফআইয়ের হয়ে কাজ করছে, সে বিষয়ে হাসনাত বলেছেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, গণমাধ্যমে আগের মতো ডিজিএফআই থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন এজেন্সি নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে। এজেন্সি ছবি তুলে মিডিয়াকে দেয়, মিডিয়া সেটি প্রকাশ করে। মিডিয়া এখন আর গণমানুষের নেই, সেটি এখন এজেন্সির মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে।’

একটি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এনসিপির দুই নেতা ডিজিএফআই, মিডিয়া ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করলেন তা কি তাদের তাৎক্ষণিক ভাবনার প্রকাশ? এর পেছনে কারো ইন্ধন নেই, এমন ভাবার কারণ নেই। নতুন করে বঙ্গভবন ইসু ও ডিজিএফআইয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে সামনে আনা হচ্ছে কেন সেটি রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দেবে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ চলাকালে মিডিয়া ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা কতটা দেশবিরোধী ও জনবিরোধী ছিল, কতটা ফ্যাসিবাদের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল, তা সবারই জানা। গত ১৬ বছর এই নেতারা কিন্তু গুম-খুন নিয়ে কোনো আওয়াজ তোলেনি। ১৬ বছর তোলেনি বলে এখন তোলা যাবে না, এমনটা বলছি না। কিন্তু এই সরকারের মধ্যে তো তাদের প্রতিনিধি আছে। তাদের মাধ্যমে গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর সংস্কার করাতে চেষ্টা না করে এই বক্তব্য সামনে এনে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার উদ্দেশ্য কী? এর সঙ্গে কি নির্বাচন বানচালের প্লট তৈরির কোনো সম্পর্কই নেই? এনসিপি নেতাদের এই বক্তব্য যদি এখানেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় তবে ভিন্ন কথা। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে যদি রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তার দায় কে নেবে?

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার কথাও সামনে আনছে জামায়াত-এনসিপি। তাদের এই যৌথ অবস্থান এমন একটা ধারণা দেয় যে, এই দল দুটি নির্বাচন পেছানোর জন্য একাট্টা হতে পারে। ফলে একদিকে মিডিয়া, দূতাবাস ও গোয়েন্দা বিভাগকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার বিষয়টাকে প্রকট করে তোলার মধ্যে কেউ যদি এই দল দুটির নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টা খুঁজে পান, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কিন্তু এত কিছু করেও কি নির্বাচন পেছানো যাবে? বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের আর কোনো বিকল্প হাতে নেই। একবার নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে আবার সেখান থেকে ইউটার্ন নিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, পতিত-পলাতক ফ্যাসিবাদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা রোধ করা, দেশের অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এই সরকারের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। বরং নির্বাচন বন্ধ করতে চাইলে যারা নির্বাচন চান ও যারা নির্বাচন বানচাল করতে চান, এই দুই রাজনৈতিক শক্তি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলে দেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তা থেকে উত্তরণের জন্য যে শক্তি-সামর্থ্য লাগে, তা বর্তমান সরকারের নেই।

ইতোমধ্যে সেনাপ্রধানের বিভিন্ন বক্তব্যে এটা বোঝা গেছে, সেনাবাহিনীও চায় একটা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হোক। তাই সরকারের কোনো রকম কারসাজিতে নির্বাচন বানচাল হলে দেশের শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী কতটা সক্রিয় ভূমিকা রাখবে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। ফ্যাসিবাদের পতনের পরে শুধু পুলিশের পক্ষে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যখন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, তখন সেনাবাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছিল। তাই ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হলে তার সুযোগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন হতে পারে। তাই কেউ স্বীকার করেন আর নাই করেন, আসন্ন নির্বাচনের সিদ্ধান্ত প্রশ্নে সেনাবাহিনী অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার।

সরকার ঘোষিত সময়ে নির্বাচনের কোনো বিকল্প প্রকৃত অর্থেই সরকারের হাতে নেই। তারা একটা নির্বাচন দিতে বাধ্য। দেশকে অরাজকতা ও গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাতে হলে একটাই পথ—নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবশিষ্ট সম্মান নিয়ে নিরাপদ প্রস্থানের একমাত্র পথ নির্বাচন। সে কথা এনসিপি-জামায়াত আমলে না নিলেও সরকারের উপদেষ্টারা নিশ্চয়ই বোঝেন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূলে নয় বলে নির্বাচন করা যাবে না, এমন ভাবনা থেকে সরে এসে বরং নির্বাচনের আগে কী করে নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের একযোগে সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত। সংস্কারের প্রশ্নে যেসব বিষয়ে সব পক্ষ একমত হয়েছে, তার বাস্তবায়ন এবং যেসব বিষয়ে দ্বিমত আছে, তা নিয়ে আরো আলোচনা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই নির্বাচন বানচালের পথে কারোই হাঁটা উচিত নয়।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সূত্র, আমার দেশ