ইতালির ফ্যাসিস্ট দলের নেতা মুসোলিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা নিজের তালুবন্দি করেন। এটা করেন তিনটি ঘটনা ঘটিয়ে। সেগুলো হচ্ছে: ১. রাষ্ট্রের নজরদারির অধীনে শ্রমিকদের সঙ্গে পুঁজিপতিদের সম্পর্ক স্থাপন ও বাধ্যতামূলক আপসের বন্দোবস্ত করা। ২. রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর মুঠোয় নেওয়া। ৩. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করা। বাংলাদেশের সংবিধান পড়লেই বুঝি, ’৭২ সাল থেকে সকল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। অর্থাৎ মুসোলিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে যা করেছিলেন। সংবিধানের শুধু ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদটি পড়লেই বুঝবেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা সোনার পাথরবাটি। মুসোলিনির আমলে ইতালি ঘুরে বেড়িয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র ও কমিউনিস্ট সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জার্মানি রাশিয়া আক্রমণের পর ভারতের কমিউনিস্টরা ফ্যাসিবাদবিরোধী হয়েছিল, সেখানে তিনি আস্ত বই লিখে ফেলেছেন সেই ১৯৩৪ সালেই। তিনি ইতালিতে অর্ধাহারে-অনাহারে লোকজনকে যক্ষ্মায় মরতে দেখেছেন। দেখেছেন পথে পথে অসংখ্য ভিক্ষুক। অথচ ফ্যাসিস্ট নেতারা প্রায়ই বলতেন, ইতালিতে ভিক্ষুক নেই। আমাদের সব সরকারই যেমন প্রায়ই ভিক্ষুকমুক্ত জেলা ঘোষণা করেন। ভিক্ষুক নিয়ে খবর লেখার দায়ে সাংবাদিককে জেল খাটতে হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে হাতের তালুতে নিয়েই মুসোলিনি সামরিক ব্যয় ৭৫ শতাংশ বাড়ালেন। পার্টির মধ্যে ৪ লাখ সদস্যের সামরিক শাখা খুললেন। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের লুপ্ত গৌরব কী উপায়ে উদ্ধার করা যেতে পারে, সে সম্বন্ধে তাঁর চেলাদের উপদেশ দিতে শুরু করেন। রোম সাম্রাজ্যের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে গেলে বর্তমান ইতালিকে যুদ্ধের পথ গ্রহণ করতেই হবে। অন্যদিকে বিদ্যালয়গুলোতে সরকার অবিশ্রান্তভাবে ইতালির সাম্রাজ্য বাড়াবার আবশ্যকতার বিষয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে লাগল। ফলে তরুণদের মন সামরিক ছাঁচে ঢালাই হলো। ইদানীং যেমন আমরা বৃহৎ বঙ্গের কথা চালু করেছি। স্লোগান তুলি– অমুক আমার তমুক আমার। রুশতাত্ত্বিক লিঁও ট্রটস্কি বলেছেন, যে মুহূর্তে বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্র তার সংসদীয় কাঠামো ও ‘স্বাভাবিক’ পুলিশও মিলিটারি পরিকাঠামোর মাধ্যমে সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, সেই মুহূর্তটাই ফ্যাসিবাদী মুহূর্ত। শেখ হাসিনার আমলে সংসদীয় কাঠামো ও পুলিশ লীগ দেখেছি। এমনকি একজন সেনাপ্রধান তাঁর পরিচয়কে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী ভাইদের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন। ১৯৩৪ সালে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ফ্যাসিবাদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, শিল্পী-সাহিত্যিকরা কীভাবে মুসোলিনিকে সমর্থন জুগিয়েছেন, তা আমরা বুঝব ফিউচারিস্টদের সঙ্গে ফ্যাসিজমের সম্পর্ক নিয়ে ফিউচারিস্টদের নেতা মারিনেত্তি লেখককে কী বলেছেন তা থেকেই। ইতালির শিল্পী মারিনেত্তি তাঁকে বলেছেন, ‘ফ্যাসিজম ফিউচারিজম ও মহাযুদ্ধে ইতালির যোগদানের ফলস্বরূপ। ফ্যাসিজম ফিউচারিজম দ্বারা নিজেকে পুষ্ট করেছে। ফ্যাসিজমের মধ্যে সেই জাতীয়তার গর্ব, ঘোরতর যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও স্বদেশপ্রেম আছে ও সর্বদা থাকবে, সেগুলির সম্পর্কে আমরা ফিউচারিস্টরাই ইতালির জনসাধারণকে সর্বপ্রথম সচেতন করে তুলি।’ আমাদের দেশে কেউ কেউ যেমন প্রাণ-প্রকৃতিময় জাতীয় সংগীতকে বদলে দিতে চান, অনেকটা তাই। বলা ভালো, ১৯২২ সালে মুসোলিনির সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে এই কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদকদের ফ্যাসিস্ট মূর্তিতে দেখা যায়। তারা প্রচার করত, ইতালির ভবিষ্যৎ হচ্ছে ন্যাশনালিজম ও ধর্মের বিস্তার দ্বারা আধ্যাত্মিক জীবনের আদর্শ প্রচার করা। আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় সংখ্যাগুরু তোষণ একসঙ্গে চলেছে যেমন। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সেই আদর্শ প্রচার নবউদ্যমে বেড়েছে বলে মনে হয়। সমতলে আমরা মুসলিম আর পাহাড়ে বাঙালি হয়ে যাই। পুরো ইতালির ইতিহাসবিদ ও কয়েকশ জীবনীকার এটা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন– জন্ম থেকেই তিনি কত বড় প্রতিভাবান ছিলেন! নেতাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মিথ তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে যেমন ডান-বাম-মধ্য সবাই কাল্ট তৈরিতে ব্যস্ত। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে দেখে এসেছেন, বই পোড়ানোর ধুম লেগে গেছে, হাইনের বইগুলোও পোড়াতে ব্যস্ত নাৎসি বর্বরেরা। শ্রমিক আন্দোলন টুকরো-টুকরো হয়ে গেল, বৈজ্ঞানিক-সাহিত্যিক-দার্শনিক হাজারে হাজারে জার্মানি থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। অভ্যুত্থানের পর ১৩/১৪টি পাঠাগারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার আগে বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা দেখেছি। ভিন্ন মতাবলম্বী লেখকদের দেশ ছাড়ার ঘটনাও কম নেই। বুর্জোয়া গণতন্ত্র কী? সেটা হচ্ছে ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকার। বাংলাদেশে সেইটুকুও এখনও হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপট কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠিত। এটাও ঠিক, অর্থনীতিতে পুঁজি একচেটিয়া দাপট। ফলে তার সংস্কৃতির উপাদানগুলোরও বিকাশ ঘটেছে। এ কারণে উন্মত্ত জনতা, নির্দিষ্ট পেশাহীন ভবঘুরে গোষ্ঠী ও জাতি-ধর্মগর্বী, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবিরোধী ছাত্র সমাজের জন্ম হয়েছে গত দুই দশকে। এরাই নারীর মুক্তি শুনলে আতঙ্কিত হয়; এরাই গুন্ডা হয়ে মিছিলে হামলা করে, ভিন্নমত হলেই মব সন্ত্রাস কায়েম করে, এরাই ফ্যাসিবাদের অন্যতম হাতিয়ার। এদেরকে দিয়েই সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করে নেয়। নারী, সংখ্যালঘু জাতি-ধর্ম, শ্রমিক, কমিউনিস্টদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হুবহু ফ্যাসিস্টদের মতো, বাংলাদেশে এমন পার্টিই সংখ্যাগুরু। হিটলারের নাৎসি পার্টির মতো ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনই জনপ্রিয় হচ্ছে। আইন হাতে নিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের বাড়িঘর, অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নারীরা অনিরাপদ বোধ করছেন। ফ্যাসিবাদ হলো হিংসা-বিদ্বেষমূলক, বৈচিত্র্যময় ও ব্যক্তি-স্বাধীনতাবিরোধী অসহিষ্ণু ভাবনাকে বৈধতা দানকারী এমন চেতনা। এই চেতনার পক্ষে সম্মতি আদায় করা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে সন্ত্রাসের মিশেল ঘটিয়ে। মাজার ভাঙা, বাড়িঘরে হামলা, মন্দির পোড়ানো, ট্যাগ মেরে হত্যাযোগ্য করা, পাগলপন্থি ও ফকিরদের চুল কেটে দেওয়া এসব তারই অংশ। সামরিক আমলেও আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ও জনগণ যে পরিমাণ বাকস্বাধীনতা ভোগ করতেন, গণতান্ত্রিকদের আমলে তাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কেন? চেতনাবাদী ফ্যাসিস্টের পর্ব শেষে ধর্মবাদী ফ্যাসিস্টরা তো কড়া নাড়ছে।
নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক