ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর এক বছর চলে গেল। ভারতের সেবাদাস হিসেবে হাসিনা এখন দিল্লিতে স্থায়ী হয়ে গেছেন। বিচারের মুখোমুখি হতে তিনি আর কখনোই এ দেশে ফিরবেন না। এমনকি ভারতের বাইরে আর কোনো দেশ তাকে গ্রহণ করবে না। তিনি যে এ দেশের মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়েছেন, তা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিশ্বের বহু দেশের স্বৈরশাসকরা দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু গণহত্যার দায় নিয়ে খুব কমসংখ্যক স্বৈরশাসক দেশ ছেড়েছেন। ফলে তাকে পলাতক হিসেবে বাকি জীবন পার করতে হবে।

হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার অনুগত সুবিধাভোগী শ্রেণি ও ফ্যাসিবাদের সহযোগীরা এখনো এ দেশে রয়ে গেছেন। এরা প্রশাসন, গণমাধ্যম, প্রতিরক্ষা বাহিনী ও সুশীল সমাজের মধ্যে থেকে পরাজিত শক্তির পক্ষে বয়ান তৈরি যাচ্ছেন । এরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন—‘আপা ফিরবেন।’ পরাজিত শক্তিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের নামে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের কৌশল এরা নিয়েছিলেন; কিন্তু সে চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হবে বলে মনে হয় না। এরা প্রতিনিয়ত অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি করার জন্য সব চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ষড়যন্ত্রের জালে যেমন পা দেয়নি, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার নীতি থেকে সরে আসেনি।

অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে দুটি কাজ সফলভাবে করতে পেরেছে। হাসিনা পালানোর এক বছর পরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে। এদিন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদ ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। ২৮ দফার জুলাই ঘোষণাপত্রে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে। এর ৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, দেশি-বিদেশি চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ১/১১-র ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়।

১৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, অবৈধভাবে ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন) এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে।

এই ঘোষণাপত্রে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব শহীদকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা ও আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে প্রয়োজনীয় সব আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

একই সঙ্গে জুলাইয়ের আন্দোলনকে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে ২৭ দফায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে, ২০২৪ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।

জুলাই সনদে হয়তো আরো কিছু বিষয় স্পষ্ট করার সুযোগ ছিল, কিন্তু সব রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে এই সনদের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি হয়েছে।

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ১ হাজার ৪০০ মানুষের জীবনদান এবং হাজারো মানুষের পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ববরণের মধ্য দিয়ে যে অর্জনটি দৃশ্যমান, তা হলো দেশের ডান, বাম ও ইসলামপন্থিরা আজ এক মঞ্চে উঠতে পেরেছেন। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের দেড় দশকেও রাজনৈতিক দলগুলোকে এক মঞ্চে আনা যায়নি। শেখ হাসিনা কৌশলে এই বিভাজনের রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছিলেন। এতে উসকানি দিয়েছে এ দেশের গণবিরোধী প্রচারমাধ্যম ও হাসিনার দোসর বামপন্থি কয়েকটি সংগঠন। যখন সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কার্ড খেলে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে।

দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করার এই রাজনীতি আবারও ফ্যাসিবাদীদের দোসর বামপন্থি কয়েকটি সংগঠন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ফ্যাসিস্ট তাড়ানোর বর্ষপূর্তির দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটেছে । হাসিনার শাসনে বিরোধী দল দমনের প্রধান অস্ত্র ছিল বিচারিক হত্যাকাণ্ড। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের একের পর এক হত্যা করা হয়েছে। শাহবাগে মবের মাধ্যমে বিচার নয়, ফাঁসি চাওয়া হয়েছে। ভারতীয় মদতপুষ্ট শাহবাগি মবের দাবি পূরণ করে একের পর এক বিচারিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে।

টিএসসিতে যখন একটি ছাত্র সংগঠন বিচারিক হত্যাকাণ্ডের শিকার রাজনৈতিক নেতাদের ছবি টাঙিয়েছিল, বামপন্থিরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ছবি সরাতে বাধ্য করেছে। বামরা মূলত বিভাজনের রাজনীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে বামরা সবসময় দলটিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে । তারা শেখ মুজিবের একদলীয় শাসন কায়েমের সহযোগী ছিল। আবার হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে তারা রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে। এখন আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে আওয়ামী ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।

হাসিনার পতনের পর বড় রাজনৈতিক অর্জনটি ধ্বংস করার খেলায় মেতে উঠেছে দিল্লির সফট পাওয়ারের অংশ বামপন্থি এ সব সংগঠন।

গণঅভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টভাবে রমজানের আগে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ছিল তা কেটে গেল। সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এ দেশের সব নাগরিক একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে।

তিনি প্রবাসীরা যাতে ভোট দিতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। প্রবাসীদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যে আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, তার বড় কারণ হলো আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদান। তিনি জানিয়েছেন, নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন উৎসবমুখর করতে সব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার কারণে ১৫ বছর ধরে নাগরিকরা ভোট দিতে পারেননি। এবারের নির্বাচনে আমরা আমাদের বকেয়া আনন্দসহ মহা আনন্দে ভোট দিতে চাই। এবারের নির্বাচনে জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাবে, এরকম ভোটাররা নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে তাদের এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের দিনকে আমরা ঈদের উৎসবের মতো করতে চাই।

হাসিনার পতনের এক বছর পর আমরা কী পেলাম, এই প্রশ্ন অনেকে করেন। হাসিনা পালানোর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাথর এ দেশের মানুষের বুকের ওপর থেকে নেমে গেছে। গত এক বছরে এ দেশে গুম-খুন ও আয়নাঘরের বিলোপ হয়েছে। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি। মানুষ তাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেয়েছে। সবাই তাদের মত প্রকাশ করতে পারছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে না। এখন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হচ্ছে।

এ কথা সত্য, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের মানুষের মধ্যে রাষ্ট্র মেরামতের যে উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল, তার হয়তো অনেক কিছু পূরণ হয়নি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে যে সংস্কার দরকার, তার অনেক কিছু সম্ভব হবে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তীব্র। এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে ঠিক করতে হবে, তারা কীভাবে এই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের যে মালা গাঁথা হয়েছে, তা ধরে রাখার দায়িত্ব এখন রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণের মধ্য দিয়ে দেশকে নির্বাচনি ট্রেনে তুলে দিয়েছেন। এখন রাজনৈতিক দলগুলো এই ট্রেন কীভাবে চালাবে, তা দেখার বিষয়।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ

সূত্র, আমার দেশ