ব্যাট-বলের খেলা টেনিস। ধারণা করা হয়, ১১ শতকে ফ্রান্সে বল-ব্যাটের এই খেলা শুরু হয়। ভাইকিং নরম্যান জাতি যখন ফ্রান্স দখল করে রাজ্য বিস্তার করে, ঠিক তখনই এই ব্যাট-বলের খেলার সূত্রপাত হয়। এই খেলা বিভিন্ন দিকে রূপান্তরিত হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লন টেনিসের বর্তমান সংস্করণের গোড়াপত্তন হয়। আজকের রাবার বলের মাধ্যমে যে টেনিস খেলা হয় এর মূল রূপকার মেজর ক্লপটন উইংফিল্ড। তিনি ১৮৭৪ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার দরবার থেকে এই খেলার রয়ালটি নিয়ে নেন। ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ ও সিভিল সার্ভিসের অফিসারদের হাত দিয়ে এই খেলা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। এটা অনুমান করা যায়, শুধু বিনোদনই নয়, ক্রিকেট, ফুটবল ও টেনিস ইংরেজরা এ দেশে চালু করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের মনন থেকেই সমাজের এলিটদের পাশ্চাত্যের ভাবধারায় গড়ে তুলতে। বর্তমান বাংলাদেশে শত বছর আগে টেনিস খেলার প্রচলন হয়। নবাব পরিবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের বিশাল অবদান রয়েছে এই খেলার বিকাশের পেছনে।
ব্রিটিশ ঢাকায় কবে এবং প্রথম কার হাত দিয়ে এই টেনিস খেলার সূত্রপাত হয় এই শহরে, তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। তবে অবিভক্ত বাংলায় কলকাতায় ১৮৮৭ সালে বেঙ্গল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করা হয়েছিল। ১৮৮৬ সালের একটি ছবিতে নওয়াব আবদুল গণির সঙ্গে একটি টেনিস টিমের দলগত ছবি দেখে প্রতীয়মান হয়, ১৮৮০-এর দশকেই ঢাকায় টেনিসের প্রচলন হয়। তবে ছবিতে শুধু দুজন দেশীয় ব্যক্তির ছবি দেখা যায়, যার মধ্যে একজনের অভিজাত পোশাক দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোনো এক জমিদার। ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলছে, আহসান মঞ্জিলে নদীর তীর বরাবর টেনিস কোর্ট ছিল, যেখানে ব্রিটিশ অফিসাররা দাওয়াত খেতে গেলে শখের বসে খেলাধুলাও করতেন। বাংলার জমিদাররাও সেসময় এই টেনিস খেলায় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ভাওয়াল রাজবাড়ির মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণকে টেনিস খেলতে দেখেছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক ড. অনুতোষ দাস গুপ্ত। মেজোকুমার তার ব্রিটিশ ইংরেজি শিক্ষকদের সঙ্গে নিজ বাড়িতে টেনিস খেলতেন। সেই সময়ে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে কাবাডি, হাডুডু ও ঘুড়ি ওড়ানোর মতো দেশীয় খেলা বেশি জনপ্রিয় ছিল। ব্রিটিশ ধাঁচের খেলাধুলা হতো মূলত কলকাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোয়, যেখানে সিনিয়র ব্রিটিশ অফিসাররা থাকতেন।
১৯০৪ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকায় আসেন। তার লেখা একটি বইয়ে ঢাকা কলেজের সামনে একটি ঘাসের টেনিস কোর্টের ছবি দেখা যায়। ১৮৯৯ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘পাবলিক ইন্সট্রাকশন ইন বেঙ্গল’ রিপোর্টে দেখা যায়, সে সময় ঢাকা কলেজে টেনিস খুব জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। মোট ২২ জন মুসলমান ছাত্র সে সময় ঢাকা কলেজে পড়তেন, তারা মুগ্ধ হয়ে এই খেলা দেখতেন। ১৯১১ সালে রমনা রেসকোর্সের এক প্রান্তে ইউরোপিয়ান সিভিল, মিলিটারি ও ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই টেনিস কোর্ট ছিল। এই ক্লাবে শুরুতে শুধু ইউরোপিয়ানদের প্রবেশাধিকার ছিল। যেহেতু রমনা এলাকায় তখন ইংরেজ অফিসারদের বসবাস ছিল এবং ঢাকা ক্লাবে আর্মেনীয় ও ইংরেজ ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেশি ছিল, সুতরাং ধরে নেওয়া যায় টেনিস খেলাটা তখনো ইউরোপিয়ানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯২৬ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ঢাকা গেজেটের তথ্যাবলি থেকে দেখা যায়, এসএ ইউসুফ নামে একজন খেলোয়াড় প্রায় ইউরোপিয়ান খেলোয়াড়দের বিপক্ষে টেনিস খেলায় জিতে যেতেন। ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়ারী ক্লাব ১৯৩০-এর দশকে টেনিস কোর্ট চালু করে। তত দিনে ঢাকার বাসিন্দারাও টেনিস খেলায় মেতে ওঠেন। তবে খেলাটা সবসময়ই অভিজাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত ‘পাকিস্তান অ্যাফেয়ার জার্নাল’ থেকে দেখা যায়, নবাব খাজা নাজিমউদ্দিন খুব ভালো টেনিস খেলতেন। তিনি একাধারে হকি, ফুটবল, টেনিস ও শুটিংয়ে ভালো নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। ১৯৩৭ সালে তিনি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি ছিলেন এবং ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় হকি ফেডারেশনেরও সভাপতি ছিলেন। নবাব পরিবারের অন্য একজন সদস্য খাজা ফজলুল হক ১৯৫০ ও ’৬০-এর দশকে অফিসার্স ক্লাব ও ঢাকা ক্লাবের নামকরা টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। ডাবলস ও মিক্সড ডাবলসে তিনি নিয়মিত চ্যাম্পিয়ন হতেন। খাজা ফজলুল হক ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে খাদ্য বিভাগ থেকে অবসর নেন এবং ১৯৯১ সালে পরলোকগমন করেন। ব্রিটিশ বাংলাদেশে টেনিসের বিকাশে টাঙ্গাইলের খান বাহাদুর আবদুল হালিম খান গজনবীর অবদানও অনস্বীকার্য। তিনি ঢাকা ক্লাবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি ১৯৪০ সালে কলকাতা মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি টাঙ্গাইল ও ঢাকায় স্থিত হন।
ডেটলাইন গোপালগঞ্জ, কার কী অর্জন-বিসর্জনডেটলাইন গোপালগঞ্জ, কার কী অর্জন-বিসর্জন
বাংলাদেশের টেনিসের বিকাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল অনন্য অবদান। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি স্যার ফিলিপ হার্টগ লাইব্রেরির পাশাপাশি জিমনেসিয়াম, ফুটবল, ক্রিকেট ও টেনিস কোর্টের জন্য আলাদা স্থান নির্বাচন করেছিলেন এবং নিয়মিত শিক্ষকদের নিয়ে এই খেলাগুলো প্রত্যক্ষ করতেন। ব্রিটিশ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃহল টেনিস প্রতিযোগিতা হতো। টেনিস প্রতিযোগিতায় কখনো এসএম হল কখনো ফজলুল হক মুসলিম হল চ্যাম্পিয়ন হতো। কার্জন হলে ঘাসের কোর্টে ১৯৪০ ও ’৫০-এর দশকে বরেণ্য অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন খেলতেন অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে। তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকা টেনিস টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন। মুক্তিযুদ্ধের পরে কার্জন হলের ঘাসের কোর্টের স্থানে নতুন ভবন নির্মিত হলে টেনিস কোর্ট বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্লাব-সংলগ্ন স্থানে চলে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সেসময় ঢাকা বিভাগের ১৫টি কলেজের মধ্যে নিয়মিত ফুটবল, ক্রিকেট ও টেনিস টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হতো সরকারি উদ্যোগে। ব্রিটিশ আমলের সব গেজেট ও রিপোর্ট থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের প্রতিটি কলেজে তখন অ্যাথলেটিক ক্লাব ছিল এবং শিক্ষকরা নিয়মিত খেলাধুলা চর্চার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতেন। আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতা হতো নিয়মিত, যা বর্তমান বাংলাদেশেও তেমন একটা দেখা যায় না।
পাকিস্তানের জন্মের পর ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের খালেদ সালাহউদ্দিন ১২ বছর বয়সে পাকিস্তান জুনিয়র টেনিস টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন। খালেদের বাবা ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের একজন সচিব। খালেদ ভাই অফিসার্স ক্লাবে মাঝেমধ্যে খেলতে আসতেন। ১৯৭০ ও ’৮০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৈয়দ ফজলে রাব্বি জাতীয় পর্যায়ে খুব ভালো টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি টেনিস ফেডারেশনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে খেলাটি মূলত কলকাতা, মাদ্রাজ, দিল্লি ও লাহোরে বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই শহরগুলোয় ব্রিটিশ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের স্টেশন থাকায় ব্রিটিশ অফিসার ও এদেশীয় টেনিসপ্রেমীদের মধ্যে নিয়মিত প্রতিযোগিতা হতো। বঙ্গভঙ্গের পর কলকাতা থেকে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে রমনা এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন এবং রমনা রেসকোর্সের পাশে টেনিস কোর্ট চালু করেন, যা পরে ঢাকা ক্লাব হিসেবে গড়ে ওঠে। এ ছাড়া ঢাকা কলেজের টেনিস কোর্টটিও ঘুরেফিরে পুরোনো বিভিন্ন রিপোর্টে এসেছে। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। এ সময় ঢাকার জৌলুস কমে যায় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কমে আসে। এক ইংরেজ অফিসার ঢাকাকে এতই ভালোবাসতেন যে, ১৯১১ সালের পর তিনি এ শহরকে তার প্রেমিকার সঙ্গে তুলনা করেন। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ অফিসারদের তেমন লেখাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের সামাজিক জীবনের তথ্যচিত্রও দুর্লভ হয়ে ওঠে। ঢাকা তথা বাংলাদেশের টেনিসের ওপর সংগত কারণে খুব বেশি উপাত্ত পাওয়া যায় না। নবাব পরিবারের অনেক সদস্য টেনিসপ্রেমী হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক কিছু হারিয়ে যায়। ফলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের টেনিস-সংক্রান্ত তথ্যও হারিয়ে যায়। টেনিসের উপকরণ ব্যয়বহুল হওয়ায় বর্তমান বাংলাদেশেও খেলাটি শহর ও জেলা পর্যায়ে সাধারণ মানুষের নাগালে পৌঁছায়নি। ১৯৩৯ সালে ঘৌস মোহাম্মদ উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছিলেন, অথচ ভারত ভাগের পর আর তেমন কোনো খেলোয়াড় একক খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নাম করতে পারেননি। নতুন বাংলাদেশে টেনিস ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিরা সামনের দিনগুলোয় দু-একজন খেলোয়াড়কে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিয়ে যেতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক : উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা