গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ শাসনের অধীনে এমন অগণিত নৃশংস ঘটনার সাক্ষী হয়েছে, যা নির্মমতা, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত দায়মুক্তির এক ভয়াল সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। সেই অন্ধকার সময়ের অনেক ট্র্যাজেডির মধ্যে একটি ঘটনা আজও জাতির স্মৃতিকে পোড়াতে থাকে—২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে দিবালোকে এক নিরীহ দরজি বিশ্বজিৎ দাসকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা।

বিশ্বজিৎ ছিলেন না কোনো রাজনীতিবিদ, এমনকি কোনো বিক্ষোভকারীও নন—তিনি ছিলেন শুধু ভুল সময়ে ভুল জায়গায়। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। রাজনৈতিক উন্মাদনার শিকার হন তিনি। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়ে প্রতিটি মুহূর্ত আর পথচারীরা ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে শাসকদলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা তাকে হায়েনার মতো আক্রমণ করে। তাকে লোহার রড, ধারালো অস্ত্র ও কাঠের বৈঠা দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় যতক্ষণ না তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে মারা যান। ঘাতকরা পালায়নি—তারা বুক ফুলিয়ে স্থান ত্যাগ করে।

সেদিন শুধু একজন মানুষ নিহত হননি—জাতীয় বিবেকের একটি অংশও মারা গিয়েছিল। অথচ আজও সেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আমরা এখনো মনে করি, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের সেই বিভীষিকাময় ঘটনাগুলোর কথা, যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে তার দলীয় কর্মীদের ‘লাঠি-বৈঠা’ নিয়ে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। ওইদিন ফার্মগেট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিরোধী দলের কয়েকজন কর্মীকে হত্যা করা হয়। অনেক হামলাকারীকে দেখা যায় নিহতদের মরদেহের ওপর নাচতে। কিন্তু সেসব অপরাধের বিচারও হয়নি।

বিনিয়োগে বড় বাধা শ্রমিক অসন্তোষবিনিয়োগে বড় বাধা শ্রমিক অসন্তোষ

এরপর আসে ১/১১-এর সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জনগণ আশা করেছিল একটি শুদ্ধি অভিযান, একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রসংস্কার। কিন্তু সেই আশাও ভেঙে যায় প্রশাসনিক দ্বিধা এবং রাজনৈতিক আপসের কারণে।

এরপর আসে ২০২৪ সালের জুলাই—একটি মোড় পরিবর্তনের সময়। জনগণ ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি, নির্বাচন জালিয়াতি এবং জাতীয় মর্যাদার অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এটি শুধু একটি সরকার পরিবর্তন ছিল না—এটি ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। মানুষ একটি নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখেছিল—একটি সমাজ যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে এবং মানবজীবনের মূল্য আবার ফিরবে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্ন ম্লান হয়ে যেতে থাকে। জাতীয় ঐক্য, যা ছিল বিপ্লবের প্রাণ, তাতে ফাটল ধরে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তি ও নাগরিক সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। আজ আবার বিভক্তি, অবিশ্বাস ও বিভ্রান্তিই জাতীয় জীবনের প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছে।

বিপ্লবের পর, এমনকি নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে, মবোক্রেসি বা গণপিটুনির নতুন রূপে ফিরে আসা শুরু হয়েছে। হ্যাঁ, আমরা মানুষ, আমরা অপরাধীদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে পারি—তবে আমরা ২১০০ শতাব্দীর নাগরিক। আমরা সভ্য বিশ্বে বাস করি, বর্বর আচরণ করার অধিকার আমাদের নেই। অপরাধ যতই জঘন্য হোক, ন্যায়বিচারের একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ হলো আইনের শাসন। রাস্তায় জনগণ নিজ হাতে শাস্তি দিতে পারে না—এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

তবু ২০২৫ সালের ৯ জুলাই, আমরা আরো এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম। সোহাগ নামের খেটে খাওয়া এক ক্ষুদ্র ভাঙারি ব্যবসায়ীকে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে দিবালোকে পাথর দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাকে একের পর এক পাথর মেরে শেষ করে ফেলা হয়—এরপর দেখা যায়, কিছু ব্যক্তি মৃতদেহের ওপর নৃত্য করছে। গোটা জাতি হতবাক হয়ে যায়। কোনো পুলিশ ছিল না। কেউ এগিয়ে আসেনি। শুধু নীরবতা। দূর থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত জনগণ শুধু অবলোকন করছিল।

আমরা জাতি হিসেবে কোথায় যাচ্ছি? সরকার কেন ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে—যেখানে জনগণ এত ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে? এখন অনেক নাগরিক প্রশ্ন করছেন : প্রধান উপদেষ্টা কি তার নোবেল পুরস্কারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করছেন?

যদি তা-ই হয়, তাহলে প্রশ্ন করতে হয়—একটি নোবেল পুরস্কারের মূল্য কী, যদি একজন সাধারণ নাগরিক নিজের দেশেই নিরাপদ না থাকে?

যখন কোনো রাষ্ট্র তার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন সে তার নৈতিক অধিকার হারাতে শুরু করে। নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার কোনো বিলাসিতা নয়—এগুলো রাষ্ট্রের ভিত্তি।

সোহাগ হত্যার ঘটনায় ভিডিও ফুটেজে স্পষ্টভাবে ঘাতকদের চিহ্নিত করা গেছে। তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এনে প্রয়োজনে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া উচিত, যাতে অন্যদের জন্য এটি একটি হুঁশিয়ারি হয়। এটি প্রতিশোধ নয়, এটি ন্যায়বিচার।

যদি আইন ন্যায়বিচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আইন পরিবর্তন করতে হবে এবং এটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে করা যেতে পারে। অসাধারণ সময়ে, অসাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণই সময়ের দাবি।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বলেছেন, পুলিশ সদস্যরা এখনো মানসিক ট্রমায় ভুগছেন এবং তারা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। এটি কোনো গ্রহণযোগ্য অজুহাত নয়। যদি বর্তমান পুলিশ বাহিনী জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে তাদের বরখাস্ত করা উচিত। বাংলাদেশে হাজার হাজার দক্ষ তরুণ-তরুণী রয়েছেন, যারা এই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। দ্রুত নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চার-পাঁচ মাসের মধ্যে একটি নতুন বাহিনী মোতায়েন করা সম্ভব।

এর পাশাপাশি, দেশে ৫০,০০০-এর বেশি সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য রয়েছেন, যারা ৫০ বছরের নিচে, সুস্থ, শিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত। এরা একটি রেডিমেড ওয়ার্কফোর্স। তাদের দুই বছরের চুক্তিতে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে তাৎক্ষণিক সক্ষমতা অর্জন সম্ভব—অতিরিক্ত বোঝা ছাড়াই।

রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। একে অন্যকে ঘায়েল করার পরিবর্তে, প্রতিটি দলকে নিজেদের শুদ্ধিকরণ করতে হবে—অপরাধীদের বহিষ্কার করতে হবে এবং আইনের হাতে তুলে দিতে হবে। যে রাজনৈতিক দল খুনিদের আশ্রয় দেয়, তারা নৈতিকভাবে সেই অপরাধে সহভাগী হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হতে হবে সচেতন, সক্রিয় ও দায়িত্ববান। কেউ যদি কাজ করতে না চায়, তাহলে তাকে অবিলম্বে সরে দাঁড়াতে হবে। চাকরি ত্যাগ করে বাড়ি চলে যেতে হবে।

সেনাবাহিনী, যারা এবার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা পেয়েছে, তাদেরও সময় এসেছে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের। সেনাবাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবেÑকোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রভাব ছাড়াই এবং গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

হ্যাঁ, পূর্ববর্তী সরকারের অপব্যবহারের কারণে আজ সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মের ওপর কিছু ‘দাগ’ পড়েছে—তবু সেনাবাহিনীকে সাহস করে সঠিক কাজটাই করতে হবে—জনগণের ও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে নিরপেক্ষভাবে। আর কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। না রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে, না মন্ত্রণালয়গুলোর, না পুলিশের, না সেনাবাহিনীর। জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এক বছর পার হয়েছে বিপ্লবের পর থেকে; কিন্তু এখনো সরকারের নরম মনোভাব দেশের ভবিষ্যৎকে আবার অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের রক্ত কোনোভাবেই যেন আবার ভেসে না যায় ভয়, বিশৃঙ্খলা ও জনপিটুনির হাত ধরে।

জনগণ দাবি করেছিল এবং প্রাপ্যতা রয়েছে—ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ভিত্তিতে গঠিত একটি দেশ। এখনই সময় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার।

এটি যেন আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতার অধ্যায় না হয়। বরং হোক দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নতুন সূচনা—একটি এমন জাতির জন্য, যারা বহুদিন ধরে শুধু সহ্য করেছে, ত্যাগ করেছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

সূত্র, আমার দেশ