বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তার ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি কয়েকটি পিলে চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। সে সময়ের মোসাহেবদের কিছু বক্তব্যের লাইন এখনো বোধশক্তিসম্পন্ন বাংলাদেশিদের কানে বাজে। তার মধ্যে একটি ছিল বিচারপতি এনায়েতুর রহিমের দেওয়া বক্তব্যে নিজেদের ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ হিসেবে দাবি করা।

আজ থেকে ঠিক বছর দু-এক আগে ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভা হয়। সেই সভায় ‘বিচারপতিদের সরাসরি শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী পান্ডা হিসেবে কুখ্যাত আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

তিনি কোনোরকম রাখঢাক না রেখেই তখন স্পষ্টবাক্যে বলেছিলেন, ‘একটা কথা আমি বারবার বলি, সুযোগ পেলেই বলি। আমরা বাংলাদেশের বিচারপতিরা, আমরা হলাম শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ... বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত হবে না, যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উন্মেষ ঘটে।’ এনায়েতুর রহিম মূলত এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিচারিক অপকর্ম এবং ভোটডাকাতির পক্ষে বৈধতা উৎপাদন করেছিলেন। আর তার ভয়াবহতা আমরা নিজ চোখে দেখেছি।

পুলিশের পোশাক গায়ে চাপিয়ে রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থান থেকে ফয়দা নেওয়া, মতান্তরে সরাসরি রাজনীতি করার লোভ ফ্যাসিবাদী আমলে অনেকের মধ্যে দেখা গিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, ২০১১ সালে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদিন ফারুককে সংসদ ভবনের সামনে বেদম মারধরের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ও তৎকালীন সহকারী কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার মিলে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে জয়নুল আবেদিন ফারুককে। বলা যেতে পারে, এই রাজনৈতিক আক্রমণ থেকে পরবর্তীকালে ‘ভাতের হোটেলের দানব হারুন’ তৈরি হয়েছিল।

চাকরির শুরুতেই সরাসরি ‘ছাত্রলীগ’ পরিচয় নিয়ে আসা তারপর পোশাকি দানব হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী পুলিশের ভয়াবহ তাণ্ডব সবাই গত জুলাই-আগস্টে দেখেছেন। এই পোশাকি দানব যদি আবার খোলস পাল্টে নতুন রূপে আবির্ভূত হতে যায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে তার প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করাটা নৈতিক দায়িত্ব। কারণ এরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালনে যতটা আগ্রহী, তার থেকেও ঢের আগ্রহী তোষামোদি করে আরো ভালো থাকতে অতি বিপ্লবী রাজতে। আমরা যদি শুরুতেই এই মোসাহেব চরিত্রগুলোকে জবাবদিহির ভেতরে আনতে ব্যর্থ হয়। তাদের মধ্য থেকেই জন্ম নিতে পারে আগামীর হারুন, বিপ্লব কুমার সরকার কিংবা বেনজীর আহমেদ।

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে? এখনো যদি পুলিশরা ফ্যাসিবাদী আমলের ভঙ্গুর অবকাঠামোকে অনুসরণ করে? এখনো বিচারপতিররা যদি এনায়েতুর রহিমের মতো ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ হিসেবে তাদের ছলাকলা জারি রাখে, তবে এখানে পরিবর্তন এলো কোথায়?

খবরে প্রকাশ, গত মঙ্গলবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিন তথা ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস চত্বরে আয়োজিত জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও জুলাইযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপা আর আসবে না, কাকা আর হাসবে না।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘শত্রুরা সাইবার যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে, এটা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। জুলাইয়ে আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে লড়েছেন। এখন পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি থেকে দূরে থাকতে হবে। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ আপনাদের পরাজিত করতে পারবে না।’

যাই হোক, চট্টগ্রামের এই পুলিশ কর্মকর্তা আওয়ামী আমলে রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্য বিপদে পড়েছিলেন। তাকে সারদা পুলিশ একাডেমির তুচ্ছ দায়িত্ব দিয়ে ফেলে রাখা হয়। তারপর আরো কম গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং হিসেবে পুলিশ হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছিল।

পাশাপাশি তাকে তার প্রাপ্য প্রোমোশন থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে রাগ, ক্ষোভ কিংবা আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া পুলিশ হিসেবে তার কাজ নয়। পোশাক পরে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করার সময় তার এমন বক্তব্য কোনোভাবেই সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের বরদাশত করা উচিত হবে না।

পূর্বতন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এ ধরনের প্রবণতা থেকেই কুখ্যাত ‘ভাতের হোটেলের হারুন’, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি বিরোধী দল দলনের মাস্টারমাইন্ড বেনজীর আহমেদ কিংবা বিপ্লব কুমার সরকারদের মতো হিংস্র ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটেছিল। ব্যক্তিপর্যায়ে তারা রাজনৈতিক ফায়দা নিতে গিয়ে মানবাধিকারকে পুরোপুরি ভূলুণ্ঠিত করেছিল।

শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বেচ্ছায় ফিরবেন, নাকি বাংলাদেশ সরকার নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে ফিরিয়ে আনবে, সেটি পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। তারপর দেশের প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেখানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার ওপর অর্পিত কাজটাই শুধু করতে পারেন। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে পুলিশ অফিসার হিসেবে শুধু সেই কর্তব্য পালনের একজন কুশীলব হতে পারেন মাত্র। আর সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের মতো গালভরা বক্তব্য দেওয়া মোটেও তার কাজ নয়।

শেখ হাসিনার সব থেকে বড় অপরাধ আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ফাংশন করতে না দেওয়া। আইন-আদালত থেকে শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিযুক্ত কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ একদিকে যেমন শেখ হাসিনার ভোটডাকাতির সহযোদ্ধা হয়েছিলেন। বিপরীতে শেখ হাসিনাও তাদের দিকে বেশ করে ‘কলাটা-মুলোটা’ বাড়িয়ে দিয়েছেন ‘তুতু-লেলে-চুকচুক’ করে। আর এগুলোর সম্মিলিত ফল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিল ভয়াবহ ফ্যাসিবাদ।

রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ধ্বংসের সেই চক্র থেকে বের হয়ে, অসততা আর অপকর্মের তিরোধানে আমরা যদি এখনই কাজ করতে না পারি, তবে হাজারো শহীদের রক্তদানে আগত জুলাইয়ে আমাদের অর্জন পুরোপুরি বৃথা হয়ে যাবে। শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া সেই ভঙ্গুর অবকাঠামোর কপি-পেস্ট করে যদি অভিন্ন রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকে, তার ফল হবে আরো কয়েকগুণ বেশি ভয়াবহ।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থানস্খলন যদি থামানো না যায়, তবে অপেক্ষায় থাকেন নতুন মডেলের হাসিনার আবির্ভাব তথা হাসিনাবাদের পুনরুজ্জীবনের জন্য। তখন নতুন করে গুম-খুন আর অভিনব ডিজাইনের যে আয়নাঘর নির্মিত হবে, সেখানে আপনার জন্য নিঃশব্দে-নীরবে একটা গুমটিঘর বরাদ্দ হয়ে যাবে কবে, টেরই পাবেন না। আপনার যখন সংবিৎ ফিরবে, চেয়ে দেখবেন দুমদাম কয়েকটা গুলি হবে। আপনার বডির সঙ্গে বাঁধা হবে কয়েকটা সিমেন্টের ব্যাগ। তারপর ইলিয়াস আলী কিংবা চৌধুরী আলমের মতো করে লাশগুলো গুম করা হবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে শীতলক্ষ্যা কিংবা তুরাগের কোথাও গিয়ে ভেসে উঠলেও উঠতে পারে আপনার সেই সিমেন্টের বস্তাবাঁধা শবদেহ।

আইনের রক্ষক হয়েও রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার জন্য চট্টগ্রামের এই পুলিশ সুপারের উচিত হবে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করা। তার মধ্য দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বিনয়ের সুন্দর একটা উদাহরণ তৈরি হবে। পাশাপাশি নতুন ধরনের হাসিনাবাজি, শাহবাগিতা এবং আয়নাঘর সংস্কৃতির জন্ম নেওয়ার পথ আপাতত রুদ্ধ করে দিতে পারে এই সৎ প্রচেষ্টা। একদিকে নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব যেমন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রাখা। অন্যদিকে গণমাধ্যমের উচিত এ ধরনের ফ্যাসিবাদের ঘোড়ারোগ তথা প্রাতিষ্ঠানিক ও পোশাকি অসততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

লেখক : গবেষক, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, আমার দেশ